সুখবর
শণ, তালপাতায় এল সুদিন
বগুড়ার শেরপুরে স্থানীয় কাঁচামাল আর নারীদের শ্রমে তৈরি হচ্ছেবিভিন্ন ধরনের হস্তশিল্প। রপ্তানি হচ্ছে বিশ্বের ৫০টি দেশে।
১৯৮৫ সাল। বাংলা দিনপঞ্জিতে তখন কার্তিক মাস। শেরুয়া ও ধড়মোকামের মতো গ্রামীণ জনপদের মানুষের হাতে কাজ নেই। ঘরে ঘরে অভাব আর ভাতের জন্য কষ্ট। অভাবের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকার অদম্য চেষ্টা তঁাদের। এরই মধ্যে ঢাকার একজন ব্যবসায়ী এসে বললেন কাজের কথা। নারীদের হাতে তুলে দিলেন কাশফুলের খড় ও শণ। তাই দিয়ে নারীরা শুরু করলেন ডালা-ঝুড়ির মতো শৌখিন হস্তশিল্প তৈরি।
আস্তে আস্তে তিন গ্রামজুড়ে শুরু হয়ে গেল এই কর্মযজ্ঞ। নারীদের তৈরি করা পণ্য বিদেশে রপ্তানি শুরু করলেন ওই ব্যবসায়ী। তাঁর পথ ধরে একে একে এল আরও ১০-১২টি হস্তশিল্প রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান। এ কাজ করে নিজেরা তো দারিদ্র্য জয় করলেনই, গ্রামীণ হাজারো নারীকে সচ্ছল-স্বাবলম্বী হওয়ার পথ দেখালেন বগুড়ার শেরপুর উপজেলার শেরুয়া ও ধড়মোকাম গ্রামের নারীরা।
জেলা শহর বগুড়া থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরের গ্রাম শেরুয়া ও ধড়মোকাম থেকে শৌখিন হস্তশিল্প তৈরির কর্মযজ্ঞ এখন ছড়িয়ে পড়েছে উপজেলার শাহ বন্দেগী, কুসুম্বি, গাড়িদহ, মহিপুর, খানপুর ইউনিয়নের আরও ১৮-২০টি গ্রামে। ১০–১২ হাজার নারী জড়িয়ে আছেন হস্তশিল্প তৈরির এই কর্মযজ্ঞে। খড়, শণ, তালপাতা, হোগলাপাতার রকমারি নানা হস্তপণ্য তৈরির কাজ করে দারিদ্র্য ঘুচিয়েছেন অনেক নারী। এসব পণ্য রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায়।
সকাল-সন্ধ্যা কর্মমুখর
হেমন্তের এক সকালে সরেজমিনে দেখা গেল, ঘরে ঘরে নারীদের হস্তশিল্প তৈরির কর্মযজ্ঞে সরগরম হয়ে উঠেছে গাড়িদহ ইউনিয়নের বনমরিচা গ্রাম। বাড়ির উঠানে, গাছের ছায়ায় বসে নারীরা হরেক রকমের হস্তজাত পণ্য তৈরি করছেন। কেউ তৈরি করছেন ডালা, কেউ ঝুড়ি, কেউ আবার নানা হস্তজাত পণ্য। গ্রামের এক গাছতলায় বসে ডালা তৈরি করছিলেন পাঁচজন নারী। তাঁদের একজন হলদিপাড়ার কদভানু বেগম প্রথম আলোকে বলেন, সারা বছর ঘরে ঘরে হস্তপণ্য তৈরির এ কাজ হয়। যমুনার বালুচরের কাশবন থেকে কাশফুলের গাছ ও শণ সংগ্রহ করেন গ্রামের পুরুষেরা। নারীরা তা দিয়ে পণ্য তৈরি করেন।
হাতের কাছেই কাঁচামাল
কারিগরেরা জানান, হস্তজাত ঝুড়ি তৈরির কাঁচামাল তালপাতার উপকরণ আসে পাশের কাহালু উপজেলা থেকে। অন্যদিকে কাশফুলের গাছ, উলু ও শণ আসে বগুড়ার সারিয়াকান্দি ও সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার যমুনা নদীর দুর্গম চরাঞ্চল থেকে। আর স্থানীয়ভাবে হোগলাপাতার জোগান আসে। কাশফুলের গাছ প্রতি কেজি পাঁচ টাকায় বিক্রি হয়।
বুলবুলি বেগম নামের এক কারিগর বলেন, তালগাছের পাতা হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে আঁশ বের করা হয়। এ আঁশ দেখতে ঠিক বেতের মতো। এ ছাড়া হোগলাপাতা ও কাশফুলের গাছ শুকিয়ে ঝুড়ি তৈরির কাঁচামাল প্রস্তুত করা হয়। পরে তালপাতার শুকনা আঁশ, হোগলাপাতা আর কাশফুলের গাছ বা উলু প্লাস্টিকের দড়ি দিয়ে হাতে বুনে ঝুড়ি তৈরি করা হয়।
সম্প্রতি উপজেলার গোসাইবাড়ি গ্রামে সাদিয়া হ্যান্ডিক্রাফট নামে একটি প্রতিষ্ঠানে গিয়ে দেখা গেল, ১৫-১৬ জন নারী হস্তজাত পণ্য তৈরির কাজ করছেন। কেউ কুকুর ও বিড়াল রাখার বাস্কেট, কেউ ডালা, কেউ পাতিল, কেউ লন্ড্রি বাস্কেট তৈরি করছেন।
আছে মধ্যস্বত্বভোগীও
নারীদের কাছ থেকে পণ্য সংগ্রহের জন্য প্রতিটি গ্রামে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর এজেন্ট রয়েছে। ২০–১০০ জন নিয়ে গঠিত সমিতির নারী সদস্যরা তাঁদের পণ্য দেন এজেন্টের কাছে। এজেন্টরা রপ্তানিকারক ১০-১২টি প্রতিষ্ঠানের কাছে সরবরাহ করেন।
কারিগরদের অভিযোগ, তাঁরা কষ্ট করে পণ্য তৈরি করলেও মোটা অঙ্কের লাভ চুষে নেন স্থানীয় এজেন্টরা। একজন কারিগর বলেন, তালপাতার একটি ঝুড়ি ও লন্ড্রি ঝুড়ি তাঁদের কাছ থেকে ৪৫০ টাকায় কিনে এজেন্টরা ৬৫০ টাকায় রপ্তানিকারকদের কাছে বিক্রি করেন। বিড়াল-কুকুরের ঝুড়ি ১২০-১৪০ টাকায় সংগ্রহ করে ২৩০-২৫০ টাকায় সরবরাহ করেন। বড় আকারের ঝুড়িতে কারিগরেরা পান ৩৫০ টাকা। অথচ রপ্তানিকারকদের কাছে ৪৫০–৫০০ টাকায় বিক্রি করা হয়।
বগুড়ার নারীদের তৈরি হস্তপণ্য বিদেশের বাজার দখল করেছে। এর মাধ্যমে বিশ্ববাণিজ্যে বগুড়া আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল। নারীরা নিজেরা উদ্যোক্তা হতে চাইলে চেম্বার সহযোগিতা দেবে।
বছরে ২৫ কোটি টাকার বাণিজ্য
হস্তশিল্পপণ্যের কারিগর, এজেন্ট ও রপ্তানিকারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শেরপুর উপজেলার নারীদের তৈরি হস্তশিল্পপণ্য সংগ্রহ করে ১০-১২টি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তা রপ্তানি করছে। এর মধ্যে রয়েছে ক্ল্যাসিক্যাল হ্যান্ড মেইড প্রোডাক্টস লিমিটেড বিডি, ডগিম্যান বাংলাদেশ লিমিটেড, সান ট্রেড লিমিটেড, ঢাকা হ্যান্ডিক্রাফটস বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সব মিলিয়ে বগুড়ার শেরপুরের নারীদের তৈরি প্রায় ২৫ কোটি টাকার পণ্য বিশ্বের প্রায় ৫০টি দেশে রপ্তানি করা হয়।
বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাসুদুর রহমান বলেন, বগুড়ার নারীদের তৈরি হস্তপণ্য বিদেশের বাজার দখল করেছে। এর মাধ্যমে বিশ্ববাণিজ্যে বগুড়া আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল। নারীরা নিজেরা উদ্যোক্তা হতে চাইলে চেম্বার সহযোগিতা দেবে।