লিখে দেওয়া জমিতে বাড়ি করেছেন ছেলে, সেখানে ঠাঁই হলো না মায়ের
বিবাহ বিচ্ছেদের পর ফিরোজা বেগমকে তিন কাঠা জমি দিয়েছিলেন তাঁর স্বামী। কিন্তু ফিরোজা সেই জমি লিখে দেন একমাত্র ছেলেকে। ভেবেছিলেন, ছেলে ওই জমিতে বাড়ি করে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকবেন। আর তাঁদের সঙ্গে হেসেখেলে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবেন ফিরোজা। সেই জমিতে তিনতলা বাড়ি উঠেছে। ছেলে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সুখে–শান্তিতে বসবাস করছেন সেখানে। শুধু ফিরোজার ঠাঁই হয়নি। ছেলের ‘অত্যাচারে’ বাধ্য হয়ে ১৫ বছর ধরে মেয়ে ও আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে থাকছিলেন অসহায় এ নারী। এবার তাঁর ঠাঁই হলো বৃদ্ধাশ্রমে।
ফিরোজা বেগম (৭০) গাজীপুরের টঙ্গীর আরিচপুর এলাকার বাসিন্দা। একমাত্র ছেলে ইসমাইল তাঁকে বাড়িতে আশ্রয় দিতে চান না এবং নির্যাতন করেন, এই অভিযোগে শনিবার (১২ মার্চ) সকালে ফিরোজাকে নিয়ে টঙ্গী পূর্ব থানায় আসেন স্বজনেরা। এ সময় পুলিশের হস্তক্ষেপে ফিরোজাকে পাঠানো হয় রাজধানীর উত্তরখানের একটি বৃদ্ধাশ্রমে।
তবে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে ফিরোজার ছেলে মো. ইসমাইল বলেন, ‘আমার মায়ের মানসিক সমস্যা আছে। তাই মাঝেমধ্যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। তাঁকে কেউ অত্যাচার বা মারধর করেনি। এসব মিথ্যা কথা।’
শনিবার দুপুরে থানায় গিয়ে কর্তব্যরত কর্মকর্তার কক্ষে একটি সোফায় বসে থাকতে দেখা যায় ফিরোজা বেগমকে। তাঁর চেহারায় বার্ধ্যকের ছাপ। চোখেমুখেও ক্লান্তি।
স্বজনেরা ও পুলিশ জানায়, ফিরোজার দুই ছেলেমেয়ে। ছেলে ইসমাইল পেটে থাকা অবস্থায় স্বামী তাঁকে তালাক দেন। এরপর তিনি ছেলেকে কোলেপিঠে করে বড় করে তোলেন। এর মধ্যে স্বামীর দেওয়া তিন কাঠা জমি ছেলেকে লিখে দেন ফিরোজা। সেখানে ইসমাইল তিনতলা বাড়ি করেন। এর মধ্যে ইসমাইল বিয়ে করেন। এরপর থেকে মায়ের ওপর অত্যাচার শুরু করেন তিনি। তাঁর চিকিৎসা ও খাওয়াদাওয়ার কষ্ট তো ছিলই। ছেলের হাতে মারও খেতে হয়েছে তাঁকে। আর এসব কারণে ১৫ বছর ধরে তিনি থাকছেন মেয়ে ও আত্মীয়স্বজনের বাড়ি। কিন্তু তাঁরাও এখন ক্লান্ত। তাই বাধ্য হয়েই তাঁকে থানায় নিয়ে আসেন স্বজনেরা।
চাচাতো বোন হাসনারা বেগমের কাছে এক বছর ধরে ছিলেন ফিরোজা। হাসনারা বেগম বলেন, ছেলে ইসমাইলের বাসায় ফিরোজাকে ঠিকমতো খাবার দেওয়া হতো না। ছোট একটা রুমে থাকতে দেওয়া হতো। এ কারণে ফিরোজা অসুস্থ হয়ে পড়তেন। তাঁর (হাসনারার) বাসায় ছয় মাস থাকার পর মাস দুই আগে ছেলের বাসায় রেখে আসা হয়েছিল ফিরোজাকে। সেখানে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসনারা তাকে দেখতে যান। ওই সময় ফিরোজা তাঁর পা জড়িয়ে ধরে তাঁকে হাসনারার বাড়িতে নিয়ে যেতে বলেন। এখন হাসনারা নিজেও অসুস্থ। তাই উপায় না দেখে ফিরোজাকে নিয়ে থানায় এসেছেন।
টঙ্গী পূর্ব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. জাবেদ মাসুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা অভিযোগ শোনার পর ছেলেকেও ডেকেছিলাম। ছেলে এসে শেষ পর্যন্ত মাকে নিতে রাজি হয়। কিন্তু ফিরোজা কোনোভাবেই ছেলের সঙ্গে যাবেন না। তাঁর (ফিরোজা) ভাষ্য, প্রয়োজনে রাস্তায় থাকবেন, তবুও ছেলের কাছে যাবেন না। পরে মানবিক দিক বিবেচনা করে তাকে রাজধানীর উত্তরখানে একটি বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর ব্যবস্থা করি।’
ওসি বলেন, মূলত অত্যাচার আর অবহেলার কারণেই ছেলের প্রতি মায়ের এমন অনাগ্রহ দেখা দিয়েছে।