‘মা, মা’ বলে কাঁদছে মীম
ছলছল চোখে শুধু ‘মা, মা’ বলে কাঁদছে ৯ বছর বয়সের ছোট্ট মীম। আর কোনো কথা মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না। মাঝেমধ্যে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে আর একটু স্বাভাবিক হলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকছে আশপাশে থাকা মানুষের মুখের দিকে। তাকে কোলে নিয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছেন অনেকেই। সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষাও যে তাঁদের নেই। আবার অনেকেই তাকে জড়িয়ে ধরেই কান্নায় ভেঙে পড়ছেন।
আঘাতে মুখের ওপরটা এখনো ফুলে আছে মীমের। আজ মঙ্গলবার সকালে বাবা, মা ও ছোট দুই বোনের লাশ দাফন করার পর দুপুরের দিকে তাকে নিয়ে গেছেন নানা মো. সবুর মিনা। আপাতত সেখানেই আশ্রয় হয়েছে তার।
মীমের দাদার বাড়ি খুলনার তেরখাদা উপজেলা সদরের পারোখালী গ্রামে। ওর নানাবাড়ি একই উপজেলায় হলেও অন্য ইউনিয়নে। নানা মো. সবুর মিনা একজন কৃষক। তিনি অনেকটা ধরা গলায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘কীভাবে যে কী হয়ে গেল বুঝতে পারছি না। আমার সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। এখন এই মেয়েকে নিয়ে আমি কী করব, কীভাবে মানুষ করব?’
কার কাছে থাকতে চাও, প্রশাসনের এমন প্রশ্নের জবাবে নানার বাড়িতে থাকার আগ্রহ প্রকাশ করে মীম। এ কারণে আপাতত তাকে সেখানেই রাখা হয়েছে। তবে তার চাচারা বলেন, নানার বাড়ি থাকলেও চাচাদের পক্ষ থেকে সার্বিক দেখভাল করা হবে।
আজ মঙ্গলবার সকালে বাবা, মা ও ছোট দুই বোনের লাশ দাফন করার পর দুপুরের দিকে তাকে নিয়ে গেছেন নানা মো. সবুর মিনা। আপাতত সেখানেই আশ্রয় হয়েছে তার।
ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন মীমের বাবা মনির শিকদার। প্রায় চার মাস আগে সেখানে তিন মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে যান তিনি। গত রোববার রাতে মারা যান মীমের দাদি লাইলী বেগম। রাতে ওই খবর শুনে মাকে শেষবারের মতো দেখতে গতকাল সোমবার ভোরে মীমসহ তিন সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি আসছিলেন বাবা মনির শিকদার। সকাল সাড়ে সাতটার দিকে স্পিডবোটে পদ্মা নদী পার হওয়ার সময় নোঙর করে থাকা বালুবাহী বাল্কহেডের সঙ্গে স্পিডবোটের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে নদীতে ডুবে মারা যান ২৬ জন। এর মধ্যে রয়েছেন মীমের বাবা মনির শিকদার (৪০), তাঁর স্ত্রী হেনা বেগম (৩৫), তাঁদের মেয়ে সুমি (৬) ও রুমি (৪)। পাঁচ সদস্যের পরিবারটির একমাত্র সদস্য হিসেবে শুধু জীবিত আছে বড় মেয়ে মীম। নিজেদের একটি ব্যাগ ধরে ভেসে ছিল সে। পরে তাকে স্থানীয়রা উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়।
সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে বাবা, মা ও দুই বোনের লাশ নিয়ে বাড়ি ফেরে মীম। এরপর শুরু হয় স্বজনদের মাতম। একই বাড়িতে পাঁচজনের মৃত্যুর ঘটনায় এলাকার মানুষ চোখের পানি আটকে রাখতে পারেননি। মঙ্গলবার সকাল নয়টার দিকে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে মীমের দাদির কবরের পাশেই তার বাবা, মা ও দুই বোনকে দাফন করা হয়।
মীমের তিন চাচা ও এক ফুফু রয়েছেন। বাবা মনির শিকদার ছিলেন তাঁর ভাইবোনদের মধ্যে চতুর্থ। ২০০৪ সালে দাদা আলম শিকদার মারা যাওয়ার পর বড় দুই চাচা আলাদা হয়ে যান। একই সঙ্গে ছিলেন ছোট চাচা মো. কামরুল শিকদার ও বাবা মনির শিকদার। বড় দুই চাচা কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। আর ছোট চাচা কামরুল শিকদারের নারায়ণগঞ্জে ছোট ব্যবসা রয়েছে।
ওই বাড়িতে এখন থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। জানাজা শেষে দুপুরের মধ্যেই বিদায় নিয়েছেন অধিকাংশ আত্মীয়স্বজন। মীমের ছোট চাচা কামরুল শিকদার বলেন, বেশ কয়েক দিন ধরে অসুস্থ ছিলেন তাঁদের মা লাইলী বেগম। ওই খবর পেয়ে গত শুক্রবার তিনি নারায়ণগঞ্জ থেকে বাড়ি আসেন। রোববার রাত আটটার দিকে তাঁদের মা মারা যান। রাতেই ভাই মনিরকে সে খবর জানানো হয়। সবার সিদ্ধান্ত ছিল, সকালে মনির এসে পৌঁছালে মায়ের দাফন করা হবে। কিন্তু সকাল থেকে মনিরের মোবাইল নম্বর বন্ধ থাকায় পরিবারের সদস্যরা আর অপেক্ষা করেননি। সকাল ১০টায় তাঁদের মায়ের জানাজা ও দাফন অনুষ্ঠিত হয়। এর কিছু সময় পরই নৌ দুর্ঘটনার খবর আসতে থাকে। খবর পেয়ে পরিবারের কয়েকজন শিবচরে ছুটে যান। সেখানে গিয়ে তাঁরা মনির ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের লাশ শনাক্ত করেন।
কামরুল শিকদার বলেন, তাঁর অন্য ভাইদের আর্থিক অবস্থা খুব বেশি ভালো নয়। এ কারণে মীমকে দেখভাল তাঁকেই করতে হবে। এখন মীম তার নানা-নানির কাছে থাকতে চেয়েছে, এ কারণে যাওয়ার সময় নানিরা তাকে নিয়ে গেছেন। পরবর্তী সময়ে তার ব্যাপারে পারিবারিকভাবে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।