‘বাবা, তুমি কেঁদো না, আমি ভালো হয়ে যাব’
সাত বছরের শিশু আফরিনকে গত রাতে দাফন করা হয়েছে। আজ শুক্রবারও বাড়িতে ছিল মানুষের আনাগোনা। প্রতিবেশী ও স্বজনদের হাসপাতালের শয্যায় থাকা আফরিনের ছবি দেখাচ্ছিলেন আর স্মৃতিচারণা করছিলেন বাবা আজিজুল হক। হু হু করে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ‘ঢাকায় হাসপাতালে নেওয়ার পর আফরিন আমাকে কাঁদতে দেখে চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলেছিল, “বাবা, তুমি কেঁদো না, আমি ভালো হয়ে যাব।”’
আজিজুল হক বলছিলেন, তাঁর কলিজার টুকরাটা শুধু পানি চেয়েছিল। পানি পানে চিকিৎসকের বারণ ছিল। খুব অল্প পানি দেওয়া হয়েছিল। তবুও ছোট্ট মেয়েটি তা সহ্য করেছে। বুধবার রাতে ও দিনে সে বিশ্ববিদ্যালয় স্কুলের অধ্যক্ষের সঙ্গে কথা বলেছে। কিন্তু পা কাটার পর সে কেমন যেন হয়ে গেল। ওর পেটের দিকে কিডনি ফেটে গিয়েছিল।
আদরের ধন নেই। কী খাব, কী করব। প্রতিদিন মা–বাবা ছাড়া কিছুই বুঝত না সে। ওর চাঞ্চল্যেই দিন শুরু হতো। দিন পেরিয়ে রাত হতো। এখন আর রাত-দিন কিছুই নেই।
গত বুধবার সকালে বাবার সঙ্গে মোটরসাইকেলে স্কুলে যাওয়ার পথে রাজশাহী নগরের খড়খড়ি বাইপাসের বামনশিখড় এলাকায় ট্রাকচাপায় আফরিন আহত হয়। তার ডান পায়ের ওপর দিয়ে ট্রাকটি চলে যায়। পরে তৎক্ষণাৎ তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে যন্ত্রণায় ছটফট করছিল শিশুটি। পরে বিকেলে চিকিৎসকের পরামর্শে আফরিনকে ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) পাঠানো হয়। সেখানে আফরিনকে বাঁচাতে তার ডান পা কাটা হয়। এরপর অবস্থা আশঙ্কাজনক হলে তাকে সিএমএইচে ভর্তি করা হয়। সেখানেই বেলা আড়াইটার দিকে সে মারা যায়। ট্রাকচাপায় তার পায়ের ওপরে পেট ও মূত্রনালিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
দুর্ঘটনার পর থেকে মা মাসুরা বেগমের মুখে খাবার দেওয়া যায়নি। স্বজনদের অনেকেই চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। বিলাপ করতে করতে বলছিলেন, আদরের ধন নেই। কী খাবেন, কী করবেন। প্রতিদিন মা–বাবা ছাড়া কিছুই বুঝত না আফরিন। ওর চাঞ্চল্যেই দিন শুরু হতো। দিন পেরিয়ে রাত হতো। এখন আর রাত-দিন নেই। বাবার সঙ্গে সে প্রতিদিন স্কুলে যেত। লক্ষ্মী মেয়ের মতো সকালে উঠেই স্কুলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতো।
আফরিনের সঙ্গে গত বুধবার থেকে ছিলেন দুই ফুফু। বড় ফুফু গোলাপজান বলেন, গত ৯ মার্চ আফরিন আট বছরে পা দিল। এ উপলক্ষে আফরিন তাঁকে বলেছিল, তিন পাউন্ডের কেক লাগবে। জন্মদিনে ও মা–বাবা, দাদা-দাদিকে পাশে বসিয়ে ছবি তুলেছে। ফ্রেম ঠিক করার জন্য বলেছে, ‘এভাবে বসো, ওভাবে বসো।’ ও অনেক স্মার্ট ছিল। স্কুলে কী হতো, তা বাড়িতে এসে বলত। প্যান্ট-শার্ট পরতে চাইত। আর বলত, শহরের মেয়েরা প্যান্ট-শার্ট পরে। এই বলেই গোলাপজান কাঁদতে শুরু করেন।
আফরিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্কুলের প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। তার বাবা আজিজুল হক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশনা দপ্তরের অফিস সহায়ক। আফরিনরা দুই বোন। সে ছিল বড়।
আফরিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্কুলের প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। তার বাবা আজিজুল হক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশনা দপ্তরের অফিস সহায়ক। আফরিনরা দুই বোন। সে ছিল বড়।
আজ সকালে রাজশাহীর পবা উপজেলার পারিলা ইউনিয়নের হাট রামচন্দ্রপুর গ্রামে আফরিনের বাড়িতে যাওয়ার আগে দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কয়েকজন শ্রমিক মাটিকাটার কাজ করছেন। গত বুধবার সকালেও তাঁরা একই কাজ করছিলেন। ঘটনার সময় তাঁরা পাশেই সকালের খাবার খাচ্ছিলেন। তাঁদের চোখের সামনেই দুর্ঘটনা ঘটে। ওই শ্রমিকদের মধ্যে আনারুল ইসলামসহ কয়েকজন দুর্ঘটনার পর আফরিনকে রক্তাক্ত অবস্থায় ভ্যানে তুলে দেন। আনারুল প্রথম আলোকে বলেন, দুর্ঘটনার সময় ট্রাকটি শিশুটির পায়ের ওপর দিয়ে চলে যায়। পরে একটু সামনে যাওয়ার পর ঘাবড়ে গিয়ে চালক ও সহকারী পালিয়ে যান। তাঁরা আফরিনকে ভ্যানে তোলার জন্য তাঁদের ডেকেছিলেন। কিন্তু তাঁরা না শুনে পালিয়ে যান।
এলাকাবাসী ও আফরিনের পরিবার বলছে, রাস্তাটি আঁকাবাঁকা। চালকেরা বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালান। আফরিনের হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন তাঁরা। এ ঘটনায় চালক ও সহকারীকে অভিযুক্ত করে গত বুধবার রাতে নিহত আফরিনের দাদা বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সাত্তার একটি মামলা করেছেন। তবে পুলিশ এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
নগরের মতিহার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনোয়ার আলী বলেন, অভিযুক্ত ব্যক্তিরা পলাতক। তাঁদের দ্রুত গ্রেপ্তার করা হবে।
মধ্যরাতে দাফন করা হলেও দিনে কয়েকবার আফরিনের কবরের পাশে তার পরিবার গেছে। শুক্রবার জুমার নামাজের পরও যান। কবরের ওপরে কাঁচা বাঁশের বেড়া ফেলে রাখা হয়েছে। দেখে মনে হবে বয়স্ক মানুষের কবর। কিন্তু আফরিনের তো বয়স সাত। আর এক পা তো ঢাকায় থেকে গেছে।