তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র, সমুদ্রবন্দর ও রেললাইনে দিনবদলের স্বপ্ন এলাকাবাসীর

মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে পুরোদমে চলছে তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ
ছবি: প্রথম আলো

কক্সবাজার শহর থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরে মহেশখালী উপজেলার দ্বীপ ইউনিয়ন মাতারবাড়ী। এর পশ্চিম দিকে বঙ্গোপসাগরের উপকণ্ঠে নির্মিত হচ্ছে ২৭৫ মিটার উঁচু একটি চিমনি। ৩০-৪০ জন শ্রমিক এটির শেষ পর্যায়ের কাজ করছেন। এর চারপাশে নির্মিত হচ্ছে পাওয়ার হাউস, কোল ইয়ার্ড, সাবস্টেশনসহ নানা অবকাঠামো। দেশের বৃহৎ মাতারবাড়ী তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকায় গিয়ে এ দৃশ্যের দেখা মেলে।

প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড। দেশি-বিদেশি ১০ হাজার শ্রমিক–কর্মকর্তা রাতদিন কাজ করে প্রকল্পের নির্মাণকাজ এগিয়ে নিচ্ছেন। কাজের অগ্রগতি ৬৭ শতাংশ। আগামী আড়াই বছরের মধ্যে বাকি কাজ শেষ হলে এ প্রকল্প থেকে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যোগ হবে জাতীয় গ্রিডে।

তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের পাশেই হচ্ছে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর। আর এ বন্দরের মালামাল পরিবহনের জন্য তৈরি হচ্ছে ২৬ কিলোমিটার রেলপথ। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে স্থানীয় লোকজনের কর্মসংস্থান হবে, ঘটবে ব্যবসা–বাণিজ্যের প্রসার—স্থানীয় লোকজন এমনটাই স্বপ্ন দেখছেন।  

তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজে ব্যস্ত শ্রমিকেরা
ছবি: প্রথম আলো

৭ মার্চ দুপুরে তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, হাজারো শ্রমিক কাজে ব্যস্ত। দেশি–বিদেশি প্রকৌশলীরা কাজের তদারকি করছেন। প্রকল্পের উত্তর–পশ্চিম পাশে তৈরি হয়েছে ২ হাজার ১৫০ মিটার লম্বা পাথরের বাঁধ। এর পাশে ১৪ কিলোমিটারের গভীর চ্যানেল। চ্যানেলে নোঙর করা প্রকল্পের মালামাল নিয়ে আসা চারটি জাহাজ। জেটি দিয়ে জাহাজের মালামাল খালাস হচ্ছে। চ্যানেলের পাশে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও বিদেশি কোম্পানির কার্যালয়, কর্মকর্তা–কর্মচারী ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের থাকার ডরমেটরি।

মাতারবাড়ীর ১ হাজার ৬০০ একরের পরিত্যক্ত লবণ মাঠে গড়ে উঠছে তাপবিদ্যুৎ উৎপাদনের এ মেগা প্রকল্প। প্রতিদিন জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজন প্রকল্প এলাকায় আসছেন কর্মযজ্ঞ দেখতে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ দৃশ্যমান হওয়ায় এলাকার জমির দামও বেড়ে যাচ্ছে। মাতারবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ উল্লাহ বলেন, এসব উন্নয়নের চিত্র দেখে মানুষ আগামীর স্বপ্ন বুনছেন। প্রকল্পের কাজ যতই এগিয়ে যাচ্ছে, এলাকার দৃশ্যপটও তত পাল্টে যাচ্ছে।

প্রকল্পের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জাপানি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সুমিতমো করপোরেশন, তোশিবা করপোরেশন ও আইএসআইয়ের তত্ত্বাবধানে ১৭টি দেশের অন্তত ১ হাজার ১৫০ বিদেশি নাগরিক এই তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পে কাজ করছেন। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে প্রথম ইউনিটে ৬০০ মেগাওয়াট এবং একই বছরের জুলাইয়ে দ্বিতীয় ইউনিটে আরও ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বরাদ্দ প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাপানের উন্নয়ন সংস্থা জাইকা দিচ্ছে ২৮ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকা। অবশিষ্ট টাকা বাংলাদেশ সরকারের।

এ প্রকল্প নিয়ে কথা হয় মাতারবাড়ীর লবণচাষি এজাহার মিয়ার (৫০) সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এলাকার দেড় হাজারের বেশি একর জমি আমরা প্রকল্পের জন্য দিয়েছি। এর একটিই কারণ—উন্নয়ন। এখন গভীর সমুদ্রবন্দরের দিকে তাকিয়ে আছি সবাই। এটি হলে মাতারবাড়ীর সঙ্গে সরাসরি চট্টগ্রাম-ঢাকার রেল ও সড়কপথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা পাবে। পাশাপাশি ব্যবসা–বাণিজ্যে মাতারবাড়ীর গুরুত্ব বেড়ে যাবে।’

সংযোগ সড়ক নির্মিত হলেই বাণিজ্যিকভাবে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের কাজ শুরু হবে। ২০২৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে এ সমুদ্রবন্দর চালু হওয়ার কথা। কোল পাওয়ারের এক কর্মকর্তা বলেন, ৭ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়কের কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালের অক্টোবরে। ৩২০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ সড়কের কাজ আড়াই বছরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করা যায়নি। এখন পর্যন্ত অর্ধেকের বেশি কাজ শেষ হয়েছে।

তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পে মালামাল খালাসের বন্দর চ্যানেল
ছবি: প্রথম আলো

কক্সবাজার-২ (মহেশখালী-কুতুবদিয়া) আসনের সাংসদ আশেক উল্লাহ রফিক বলেন, মহেশখালী-মাতারবাড়ীকে ঘিরে ৩৪টি প্রকল্প নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এগুলোর মধ্যে তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, তরলীকৃত প্রাকৃতি গ্যাস (এলএনজি) টার্মিনাল, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প অন্যতম। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে এলাকাটি বাণিজ্যিক হাব হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। তখন আর্থসামাজিক উন্নয়ন যেমন ঘটবে, তেমনিভাবে যাতায়াতব্যবস্থায়ও আমূল পরিবর্তন হবে। বাড়বে পর্যটনশিল্পের প্রসার।

এদিকে ১৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে কক্সবাজারের চকরিয়া থেকে মাতারবাড়ী পর্যন্ত ২৬ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর থেকে সরাসারি রেলপথে কনটেইনার ঢাকায় পরিবহন করা যাবে। মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গেও যুক্ত হবে এ রেলপথ।

ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ডাবল লাইন ডুয়েল গেজ নির্মাণ সমীক্ষা প্রকল্পের এবং বাংলাদেশ রেলওয়ের পরিচালক (প্রকৌশল) মো. আবিদুর রহমান বলেন, এ রেললাইন নির্মাণের ফিজিবিলিটি স্টাডি শেষ হয়েছে। প্রকল্পের নকশাও তৈরি হয়ে গেছে। বর্তমানে অর্থায়নের জন্য বিভিন্ন দাতা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। প্রকল্পে সাড়ে ৪০০ একর জমির দরকার। এ ছাড়া ২৬ কিলোমিটারের মধ্যে দুটি বড় নদী ও কয়েকটি খালও আছে।