দলের একাংশের আপত্তির পরও বরিশাল মহানগর ও দক্ষিণ জেলা বিএনপির পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটির অনুমোদন দিয়েছে কেন্দ্রীয় বিএনপি। গতকাল শনিবার দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে এই সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। এ নিয়ে দলের পদবঞ্চিত অংশের নেতা–কর্মীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
গত কমিটির পদবঞ্চিত নেতাদের অভিযোগ, এক যুগ ধরে তাঁরা রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় থেকেছেন, জেল-জুলুম, হামলা-মামলা সহ্য করেছেন। অথচ এই সময়ে যাঁরা নিষ্ক্রিয় থেকে নীরব দর্শকের ভূমিকায় ছিলেন, তাঁদের দিয়ে আহ্বায়ক কমিটি করা হয়েছে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ৩ নভেম্বর বরিশাল মহানগর ও উত্তর-দক্ষিণ দুই জেলা কমিটি বিলুপ্ত করে আহ্বায়ক কমিটির ঘোষণা দেয় বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটি। এতে প্রতিটি কমিটিতে আহ্বায়ক ও দুজনকে যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়েছিল। মহানগর কমিটিতে মনিরুজ্জামান খানকে আহ্বায়ক এবং দক্ষিণ জেলা বিএনপিতে মজিবুর রহমান নান্টুকে আহ্বায়ক করা হয়। ওই সময় আহ্বায়ক ও যুগ্ম আহ্বায়কদের পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটি করে কেন্দ্রে জমা দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। সে অনুযায়ী ডিসেম্বরের শেষ দিকে ৪২ সদস্যের মহানগর কমিটি এবং ৪৭ সদস্যের দক্ষিণ ও উত্তর জেলা কমিটি করে কেন্দ্রে অনুমোদনের জন্য জমা দেওয়া হয়েছিল। নগর ও দক্ষিণ জেলা বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটির অনুমোদন দেওয়া হলেও উত্তর জেলা বিএনপির কমিটির এখনো অনুমোদন হয়নি।
নতুন আহ্বায়ক কমিটিতে নগর বিএনপির দীর্ঘদিনের সভাপতি মজিবর রহমান সরোয়ার ও তাঁর অনুসারীরা স্থান পাননি। তবে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জিয়া উদ্দীন সিকদারকে যুগ্ম আহ্বায়ক রাখা হয়। একই সঙ্গে উত্তর ও দক্ষিণ জেলা বিএনপির বর্তমান সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকেরাও বাদ পড়েছেন।
জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে মহানগর বিএনপির পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটি নিয়ে আপত্তি তোলেন দলটির সদ্য বিলুপ্ত কমিটির অন্তত ৩১ নেতা। তাঁরা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন। এতে ৪১ সদস্যের মহানগর কমিটিতে যাঁদের রাখা হয়েছে, তাঁদের ব্যাপারে তদন্ত করে পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটির অনুমোদনের দাবি করা হয়। কিন্তু তাঁদের এই আবেদন আমলে নেওয়া হয়নি।
আমি নাহয় দলের দুঃসময়ে নেতৃত্ব দিয়ে অন্যায় করেছি। কিন্তু দলের যাঁরা ত্যাগী নেতা, জেল-জুলুম, অত্যাচার, মিথ্যা মামলা ও হয়রানির শিকার হয়েছেন, তাঁরা কী অন্যায় করেছেন।
লিখিত ওই অভিযোগে নেতারা উল্লেখ করেন, পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটির অর্ধেকের বেশি নেতা ২০০৭ সালে সেনা–সমর্থিত সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর আর দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেননি। একই সঙ্গে বর্তমান সরকারের ১০ বছরের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে রাজপথে কোনো আন্দোলন–সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেননি। তাঁরা নিষ্ক্রিয় ছিলেন এবং ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে অনেকে সুসম্পর্ক রেখে ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন।
সদ্য বিলুপ্ত মহানগর কমিটির সহসভাপতি আব্বাস উদ্দীন অভিযোগ করেন, ‘আমরা যাঁরা এই সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলন–সংগ্রাম করতে গিয়ে জেল, জুলুম ও নির্যাতনের শিকার হয়েছি, তাঁদের কাউকে এই আহ্বায়ক কমিটিতে রাখা হয়নি। এমনকি মহানগরের ৩০টি ওয়ার্ডের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও সদ্য বিলুপ্ত কমিটির সঙ্গে কোনো ধরনের পরামর্শ করা হয়নি। ঘরে বসে নিজেদের লোকজন নিয়ে এই কমিটি গঠন করা হয়েছে।’
বরিশাল নগর ও জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে গত বছরের সেপ্টেম্বর মাস থেকে বরিশালে ব্যাপক আলোচনা চলছিল। মজিবর রহমান প্রায় ৩০ বছর ধরে নগর বিএনপির সভাপতি পদে ছিলেন। সাংসদ, হুইপ ও সিটি মেয়রের দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি। দলের সাংগঠনিক কাঠামোতে তাঁর শক্ত প্রভাব রয়েছে।
দলীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, মজিবর রহমানের এই প্রভাবের কারণে দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় অংশটি এবার আহ্বায়ক কমিটি করার জন্য একাট্টা হয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁরা এই কাজে সফল হন। এই অংশের পেছনে কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ও সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস আক্তারের প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে বলে দলে আলোচনা আছে।
মজিবর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বরিশালে শক্তিশালী বিএনপি আমাদের সম্মিলিত পরিশ্রমের ফসল। আমাকে বাদ দেওয়ার জন্য নাহয় তাঁরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন। আমি নাহয় দলের দুঃসময়ে নেতৃত্ব দিয়ে অন্যায় করেছি। কিন্তু দলের যাঁরা ত্যাগী নেতা, যাঁরা দুঃসময়ে রাজপথে ছিলেন, জেল-জুলুম, অত্যাচার, মিথ্যা মামলা ও হয়রানির শিকার হয়েছেন, তাঁরা কী অন্যায় করেছেন।’
অবশ্য নগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান ফারুক এমন অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, মূল কমিটি ১৭১ সদস্যের। এখন মাত্র ৪১ জন সদস্য নিয়ে আহ্বায়ক কমিটি হচ্ছে। পূর্ণাঙ্গ মূল কমিটি যখন হবে, তখন ত্যাগী যাঁরা বাদ পড়েছেন, তাঁরা স্থান পাবেন। আহ্বায়ক কমিটি গঠন করার পর কয়েকজন দলের কর্মসূচিতে আসছেন না, এটা দুঃখজনক। তাঁরা সবাইকে নিয়েই দল করতে চান।
এর আগে ২০১২ সালের নভেম্বরে সর্বশেষ বিএনপির মহানগর কমিটি এবং ২০১০ সালে উত্তর জেলা ও ২০১৪ সালে দক্ষিণ জেলা কমিটি গঠন করা হয়েছিল।