উড়োজাহাজের ধাক্কায় গরুর মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে কমিটি, ৪ আনসার প্রত্যাহার
কক্সবাজার বিমানবন্দরে উড্ডয়নের সময় বাংলাদেশ বিমানের একটি উড়োজাহাজের পাখার ধাক্কায় দুটি গরুর মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে আজ বুধবার চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রত্যাহার করা হয়েছে আনসারের চারজন সদস্যকে। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যার ওই ঘটনায় বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পান উড়োজাহাজটির ৯৪ জন যাত্রী।
কক্সবাজার বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক মো. গোলাম মোর্তুজা হোসেন আজ প্রথম আলোকে বলেন, উড়োজাহাজের সঙ্গে গরুর ধাক্কা লাগার সময় রানওয়ের দায়িত্বে ছিলেন আনসার বাহিনীর চারজন সদস্য। দায়িত্ব পালনে অবহেলার অভিযোগে এই চারজনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এ ঘটনায় সংশ্লিষ্টদের গাফিলতি খুঁজতে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। বিমানবন্দরের কয়েকটি পয়েন্টে সীমানাপ্রাচীর সংস্কারের কাজ চলছে। দ্রুত কাজ শেষ হলে জন ও প্রাণী প্রবেশ বন্ধ হয়ে যাবে। কেটে যাবে নিরাপত্তাঝুঁকিও।
বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক ও পুলিশ সুপার মো. নাইমুল হক বলেন, মঙ্গলবার বিকেল ৫টা ৫৫ মিনিটের দিকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ফ্লাইট (বিজি ৪৩৪ বোয়িং) রানওয়ের ১৭ নম্বর ডেলটা পোস্টের সামনে দিয়ে উড্ডয়নের সময় উড়োজাহাজের ডান পাখায় ধাক্কা লেগে গরু দুটি গুরুতর আহত হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যায়। তবে উড়োজাহাজটি ৯৪ জন যাত্রী নিয়ে সফলভাবেই উড্ডয়ন করে। এটি উড্ডয়নের পরপর আরও দুটি উড়োজাহাজ (নভোএয়ার ও ইউএস–বাংলা) উড্ডয়ন করে।
উড়োজাহাজের সঙ্গে গরুর ধাক্কা লাগার সময় রানওয়ের দায়িত্বে ছিলেন আনসার বাহিনীর চারজন সদস্য। দায়িত্ব পালনে অবহেলার অভিযোগে এই চারজনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
এপিবিএন সদস্যরা বলেন, উড়োজাহাজ উড্ডয়নের সময় কয়েকটি গরু রানওয়ের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ দুটি গরু রানওয়ের ওপর চলে এলে উড়োজাহাজ সামনে পড়ে যায়। কুয়াশার কারণে গরুগুলো ঠিকমতো দেখা যাচ্ছিল না। বিমানের ডান পাশের পাখার ধাক্কা লেগে গরু দুটি ঘটনাস্থলেই মারা গেছে।
আজ বিকেলে কক্সবাজার বিমানবন্দর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বিমানবন্দরের কোল ঘেঁষে নুনিয়াছড়া, কুতুবদিয়াপাড়া, নুনিয়াছড়া শেষ মাথা, ৬ নম্বর এলাকার অনেকাংশে নেই কোনো গাইডওয়াল। আবার যেটুকু আছে তা–ও জরাজীর্ণ। এসব অংশ দিয়ে অবাধে রানওয়ের ওপর দিয়ে এপার-ওপার যাতায়াত করছেন স্থানীয় লোকজন। রানওয়েকে চলাচলের ‘শর্টকাট’ পথ হিসেবে ব্যবহার করছেন সাধারণ মানুষ। প্রাচীরের ভেঙে পড়া অংশ দিয়ে বা যেখানে দেয়াল নেই, গরু–ছাগলসহ বিভিন্ন প্রাণী প্রায়ই ঢুকে পড়ছে সেসব স্থান দিয়েই।
ব্রিটিশ আমলে তৈরি কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীতকরণ প্রকল্প শুরু হয় ২০১৫ সালের ২ জুলাই। পুরোপুরি কাজ শেষ না হলেও ২০১৭ সালের ৬ মে থেকে রানওয়েটিতে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট ওঠানামা করছে। রোহিঙ্গা শরণার্থী ব্যবস্থাপনাসহ নানা কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হিসেবে এর উদ্বোধন করেন। পর্যটন ও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কেন্দ্র করে প্রতিদিনই আকাশপথে কক্সবাজার আসছেন দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার অগণিত কর্মকর্তা। এমন অবস্থায় মঙ্গলবার উড্ডয়নের সময় উড়োজাহাজের ধাক্কায় দুটি গরুর মৃত্যুর ঘটনা সাধারণ যাত্রীদের মনে আতঙ্ক ছড়িয়েছে।
কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) ফোরকান আহমদ বলেন, কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে যেমন বাড়ছে, তেমনি অবকাঠামোরও উন্নয়ন হচ্ছে। তবে সেভাবে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদারের অভাব রয়েছে। পর্যাপ্ত স্ক্যানার মেশিন নেই, বিমানবন্দরের চারদিকে গাইডওয়াল নেই। ফলে গরু-ছাগল ঢুকছে, রানওয়ে দিয়ে এপারের লোক ওপারে সহজে যাতায়াত করছে। এর ফল মঙ্গলবারের গরু মৃত্যুর ঘটনা। চালকের বুদ্ধিমত্তায় বিমানের ৯৪ জন যাত্রী প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন। অব্যবস্থাপনা দূর করা না হলে যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য কক্সবাজার-২ (মহেশখালী-কুতুবদিয়া) আসনের সাংসদ আশেক উল্লাহ রফিক বলেন, মঙ্গলবারের ঘটনায় মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির জরুরি বৈঠক হয়েছে বুধবার। সেখানে বিষয়টি নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়েছে। নিরাপত্তা–সম্পর্কিত সমস্যাগুলো শিগগিরই সমাধান করার সিদ্ধান্ত নিয়ে বৃহস্পতিবার থেকেই ভাঙ্গা গাইডওয়াল নির্মাণ শুরু এবং প্রাচীর নির্মাণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেখানে নিরাপত্তাপ্রহরী বাড়াতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যে পাইলট মঙ্গলবারের ঘটনায় বিমানটিকে বুদ্ধির সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করে নিরাপদে অবতরণ করিয়েছেন, তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়েছে সংসদীয় কমিটি।
বর্তমানে কক্সবাজার বিমানবন্দরে বাংলাদেশ বিমান, নভোএয়ার ও ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের ৯-১০টি উড়োজাহাজ দৈনিক আসা-যাওয়া করে। এর মধ্যে বোয়িং ৭৩৭ বিমানও রয়েছে। এ ছাড়া আসা-যাওয়া করে ৫ থেকে ৬টি কার্গো বিমানও।
বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, ২০১৬ সালে কক্সবাজার বিমানবন্দরের উত্তরে নাজিরারটেক উপকূলের অদূরে বঙ্গোপসাগরে একটি কার্গো উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে বিদেশি পাইলটসহ তিনজনের মৃত্যু হয়। কার্গো উড়োজাহাজটি কক্সবাজার থেকে চিংড়ি পোনা নিয়ে যশোর যাচ্ছিল। এ ছাড়া ২০১৭ সালে একটি বেসরকারি উড়োজাহাজের চাকায় পিষ্ট হয়ে রানওয়েতে মারা যায় তিনটি কুকুর।