২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

অন্যকে ফাঁসাতে থানায় বোমা মারতে বললেন সাংসদ

শাহীন চাকলাদার

যশোরের কেশবপুরের পরিবেশ আন্দোলনকর্মী সাইফুল্লাহর বিরুদ্ধে ‘ডাকাতির উদ্দেশে বোমা হামলা’ মামলা করতে স্থানীয় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) নির্দেশনা দিয়েছেন সাংসদ শাহীন চাকলাদার। চাকলাদার যশোর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও কেশবপুর (যশোর–৬) আসনের সংসদ সদস্য।

সপ্তাহ দুয়েক আগে কেশবপুর থানার ওসি জসিম উদ্দিনের মোবাইল ফোনে কল করে চাকলাদার এই নির্দেশনা দেন। সাংসদ যার বিরুদ্ধে মামলা করতে বলেছেন সেই সাইফুল্লাহ ওই এলাকার একজন পরিবেশবাদী কর্মী। পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) সঙ্গে মিলে তিনি কাজ করেন। সম্প্রতি ওই এলাকায় ‘মেসার্স সুপার ব্রিকস’ নামে অবৈধ ভাবে গড়ে ওঠা একটি ইট ভাটার বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট করেন সাইফুল্লাহ। আদালত ভাটা বন্ধের নির্দেশনাও দেন। আর এতেই ক্ষিপ্ত হন সাংসদ শাহীন চাকলাদার।
সাংসদ নিজের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সদস্য পরিচয়ের কথা উল্লেখ করে ওসি জসিম উদ্দিনকে বলেন, আপনি রাতেই থানায় বোম মারেন। তারপর সাইফুলের নামে মামলা করেন। এরপর বলেন, পুলিশকে সিভিল কাপড়ে পাঠিয়ে ইউভাটায় বোমা মেরে ডাকাতির উদ্দেশে হামলা এমন একটা মামলা দেন। তিনি ওসিকে বলেন, মামলা করতেই হবে, এটাই শেষ কথা। তাছাড়া তিনি ওসিকে ভর্ৎসনা করে বলেন, সাইফুল কেন বারবার আদালতে গিয়ে মামলা করে, ওসি হয়ে তিনি কী করেন?

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাংসদ শাহীন চাকলাদার গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের কথাবার্তা ওসির সঙ্গে তাঁর হয়নি। এটা কেউ টেম্পারিং করে বানিয়েছে। সাংসদ শাহীন চাকলাদার বলেন, ‘আমি যে এলাকার সাংসদ, সেটা জামায়াত–অধ্যুষিত। এখানে কেউ এটা বানিয়েছে। এ ধরণের কোনো কথা হয়নি। ওসিও আমাকে বলেছেন, এ ধরনের কোনো কথা হয়নি।’
এরপর সাংসদ এ প্রতিবেদকে একটি অডিও ক্লিপ পাঠান। তাতে তিনি ওসির সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া অডিওর বিষয়ে কথা বলেন।

ওসি জসিমউদ্দিন বলেছেন, এই কথোপকথনের বিষয়টি তাঁর স্মরণে নেই। তিনি বলেন, নানা কারণেই সাংসদের সঙ্গে তাঁর কথা হয়। সব মনে থাকে না।

উপজেলার উত্তর সাতবাড়িয়া গ্রামে ‘মেসার্স সুপার ব্রিকস’ নামে ইটভাটাটির অবস্থান। স্থানীয়রা বলছেন, আইনকানুন মনে এই ইটভাটাটি গড়ে ওঠেনি। ভাটাটির কার্যক্রম বন্ধের জন্যই স্থানীয় সাইফুল্লাহ আদালতে রিটটি করেন।

সাইফুল্লাহ প্রথম আলো বলেন, তিনি ভয়ের মধ্যে আছেন। ঢাকায় বেলার কার্যালয়ে তিনি যোগাযোগ করেছেন। কী করবেন এখনো বুঝতে পারছেন না।

ওসির সঙ্গে সাংসদের কথোপকথন প্রকাশের পর এটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। অনেকেই সাংসদের এমন কথার প্রতিবাদ জানিয়েছেন, ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। আবার অনেক রসাত্বক–মজাদার কথাও লিখেছেন। কেউ কেউ বলেন, এমন মিথ্যা মামলা এদেশের বহু মানুষের নামে আছে। যারা মিথ্যা মামলা করছে তাদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে এই প্রবণতা কমবে।

যশোর পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানালেন, অডিওর আলোচনা তাঁরা শুনেছেন। হাইকোর্টের রায় মানা হবে। এখানে অন্য কোনো প্রভাব কাজ করবে না। ওই ব্যক্তি (সাইফুল্লাহ) যিনি রিটটি করেছেন তাঁর নিরাপত্তার বিষয়টিও পুলিশ দেখভাল করবে। ওই কর্মকর্তা বলেন, কথোপকথনে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) যৌক্তিক অবস্থানই তারা প্রাথমিক ভাবে দেখতে পেয়েছেন। আরও পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হচ্ছে।

সংসদ সদস্য ও সাবেক জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেকের মৃত্যুর পর ১৪ জুলাই যশোর-৬ আসনে উপনির্বাচন হয়। এই উপনির্বাচনে বিজয়ী হন যশোর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার। শাহীন চাকলাদার সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানও ছিলেন।

শাহীন চাকলাদার ও ওসি মো. জসিম উদ্দিনের কথোপকথন:

প্রশ্ন :

ওসি: স্লামালাইকুম স্যার।

শাহীন চাকলাদার: সাতবাড়িয়ার সাইফুল্লাহ কিডা, চেনো?

প্রশ্ন :

ওসি: সাতবাড়িয়া, সাইফুল্লাহ আছে, স্যার ওই ইট ভাটার একটা বিষয় নিয়ে সাইফুল্লাহ, ‘বেলা’য় যেয়ে মামলা-টামলা করে আর কী। বাজে একটা ছেলে স্যার।

শাহীন চাকলাদার: আপনি এখন রাত্তিরে থানায় বোম মারেন একটা। মারায়ে ওর নামে মামলা করতে হইবে। পারবেন? আপনি থাকলে এগুলো করতে অইবে। না অইলে কোন জায়গায় করবেন? আমি যা বলছি, লাস্ট কথা ইডাই। যদি পারেন ওই এলাকা ঠান্ডা রাখতি, আমি বন ও পরিবেশ বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সদস্য। ওখানে কারও বাপের ক্ষমতা নেই। সে (সাইফুল্লাহ) বারবার যেয়ে কেন করে, আপনি কী করেন?

প্রশ্ন :

ওসি: ও তো স্যার হাইকোর্টের কাগজ নিয়া আসে বারবার।

শাহীন চাকলাদার: আরে কোথার হাইকোর্ট-ফাইকোর্ট। কোর্ট-ফোর্ট যা বলুক, বলুইগ্যা। আমাদের খেলা নাই? খেলা নাই?

প্রশ্ন :

ওসি: হাইকোর্টে স্যার...

শাহীন চাকলাদার: ওসি হলি, ওসি কিন্তু ডায়নামিক হইতে অয়। আজকে বাগারপাড়া ওসি আসছিল আমার কাছে। ওরে আবার চৌগাছায় দিয়ে দিচ্ছি। ও ওসি..চেনেন? বাগাড়পাড়া ওসিকে চেনেন?

প্রশ্ন :

ওসি: চিনি না আবার স্যার? মামুন সাহেবরে?

শাহীন চাকলাদার: কথা বইলেন তার সাথে। তাকে নিয়ে আসতেছি চৌগাছায়। আপনে ওকে যেকোনো ভাবে, যেকোনো লোক দিয়ে, কাইলকে যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটায়ে কালকে কাজটা করেন, ওকে?

প্রশ্ন :

ওসি: স্যার, দেখি স্যার। কী হয়েছে স্যার? ও কি ডিস্টার্ব করতেছে আবার?

শাহীন চাকলাদার: ও কী ডিস্টার্ব করবে? আচ্ছা, বন ও পরিবেশ অফিসে আমি আছি। কার বাপের ক্ষমতা আছে এখানে আসবে! আমি বলছি কী, একটা আপনি খেলা খেলে ওকে ভেতরে নিয়ে আসেন। কথা বুঝেন নাই?

প্রশ্ন :

ওসি: স্যার, স্যার। দেখবোনে স্যার।

শাহীন চাকলাদার: কেমন অফিসার আপনি, আল্লাই জানে। কাজ দিলি কাজ পারেন না।

প্রশ্ন :

ওসি: হা হা হা হা স্যার। সব কাজই তো করি, স্যার।

শাহীন চাকলাদার: সব কাজ করেন, না? তালিপরে যেকোনো ভাটায় যেয়ে, দরকার হলি পুলিশের দিয়ে লোক দিয়ে সিভিলে বোম ফাটায় দিয়ে চলে আসুক। বলতে হবি যে হামলা করেছে ডাকাতি করার জন্য। এটা ছিল অমুক। একটা বানাই দিলে অয়া গেল।

প্রশ্ন :

ওসি: ও স্যার, ওই যে, ওই যে, বেলার যে কাগজটা আসছে, ওডা দেখছেন স্যার আপনে? হাইকোর্টের কাগজটা।

শাহীন চাকলাদার: বেলা-ফেলা আমি দেখবোনে, আমি তো স্থায়ী কমিটির সদস্য।

প্রশ্ন :

ওসি: হাইকোর্টের কাগজটা স্যার।

শাহীন চাকলাদার: হাইকোর্ট কী বলেছে?

প্রশ্ন :

ওসি: গতকাল একটা কাগজ আসছে হাইকোর্টের থেকে স্যার।

শাহীন চাকলাদার: কী আছে?

প্রশ্ন :

ওসি: আমি দেখাবনে স্যার কালকে। কালকে সকালে হোয়াটসঅ্যাপে দিয়ে দেবোনে আপনারে, স্যার। হাইকোর্ট থেকে স্পষ্ট নির্দেশনা আসছে ওই যে, সুপার ব্রিকস বন্ধ রাখার নির্দেশ দিসে স্যার।

শাহীন চাকলাদার: আমাদের এলাকায় স্কুল-কলেজ বাদে আমি আমার এলাকায় কোনো ব্রিকস বন্ধ করব না। যে যেই দিগ্যা। আমি করব না।

প্রশ্ন :

ওসি: কাগজটা তো দেখবেন, স্যার। কী লিখছে, স্যার।

শাহীন চাকলাদার: ঠিক আছে, ওকে।

বেলার নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, সাইফুল্লাহ তাঁদের নেটওয়ার্ক মেম্বার। তিনি বলেন, একজন ইটভাটার মালিকের পক্ষ হয়ে একজন সাংসদের এমন অবস্থান প্রমাণ করে, পরিবেশ নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা কতটা নাজুক অবস্থার মধ্যে আছেন। পুলিশকে চাপ দেওয়ার জন্য সাংসদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। এই সাংসদ আদালতকে মানতে চান না। তিনি কীভাবে আইনপ্রণেতার ভূমিকায় থাকতে পারেন?