চট্টগ্রামের উড়ালসড়ক
‘অনুমানে’ প্রকল্প, ব্যয় বাড়ছে ১,৩০০ কোটি টাকা
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা স্বীকার করলেন, তড়িঘড়ি করে অনুমানের ওপর প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল। প্রকল্পটির মেয়াদও চার বছর বাড়ছে।
চট্টগ্রামে নগরের লালখান বাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত যে উড়ালসড়ক বা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে, সেটির প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল ‘অনুমানে’র ভিত্তিতে ‘তড়িঘড়ি’ করে। এখন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ব্যয় বাড়ছে প্রায় ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। সঙ্গে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ছে চার বছর। যদিও প্রকল্পটি বাস্তবায়ন শেষ হওয়ার কথা তিন বছরে।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) ১৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই উড়ালসড়ক প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। নির্মাণকাজ পেয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স-র্যাঙ্কিন জেভি।
নথিপত্র অনুযায়ী, ২০১৭ সালের জুলাই মাসে উড়ালসড়ক প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন পায়। নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালের জুনে। শুরুতে নির্মাণের ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। নতুন করে ব্যয় প্রায় ৪ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা নির্ধারণ করে এবং মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়ে সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) সম্প্রতি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে।
সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক মো. মাহফুজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সংশোধিত ডিপিপি এখনো চূড়ান্ত অনুমোদন হয়নি।
ব্যয় বাড়ছে যেসব খাতে
শুরুতে এই প্রকল্পে মূল অবকাঠামো নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ২ হাজার ৫১২ কোটি টাকা। কিন্তু এখন নতুন করে প্রস্তাবিত ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৩ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক লাফেই ব্যয় বেড়েছে ৯৪০ কোটি টাকা।
প্রকল্পের নথি অনুযায়ী, বৈদ্যুতিক খুঁটি সরানোর কাজে ১৮ কোটি টাকার পরিবর্তে ব্যয় হবে ২০০ কোটি টাকা। বাড়তি ব্যয় হবে এলইডি বাতি স্থাপন, ভূমি অধিগ্রহণ, স্থাপনার ক্ষতিপূরণ ও সড়ক সংস্কারে। উড়ালসড়কের মূল ডিপিপিতে ধরা না হলেও সংশোধিত ডিপিপিতে ব্যয়ের ১০টি নতুন খাত যুক্ত করা হয়েছে। এতে বাড়তি ব্যয় হচ্ছে ১৬৩ কোটি টাকা। নতুন খাতের মধ্যে রয়েছে নিরাপত্তাব্যবস্থার জন্য ২০০টি সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন, টোলপ্লাজা স্থাপন, পানিনিষ্কাশন-ব্যবস্থা তৈরি, সৌন্দর্যবর্ধন, তদারকির জন্য ভবন ও নিয়ন্ত্রণকক্ষ নির্মাণ, পদচারী-সেতু নির্মাণ এবং শব্দ প্রতিবন্ধকতা ব্যবস্থা তৈরি।
ব্যয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সিডিএর যুক্তি হচ্ছে, বিভিন্ন সংস্থার আপত্তির কারণে কিছু এলাকায় উড়ালসড়ক নির্মাণের স্থান পরিবর্তন করতে হয়েছে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের পরামর্শে উড়ালসড়কের পাইল, পিয়ার, পাইল ক্যাপের আকৃতি পরিবর্তন করতে হয়েছে। নগরের দেওয়ানহাট এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইনের ওপর প্রথমে ‘পিসি গার্ডার ব্রিজ’ করার কথা ছিল। এখন ‘ব্যালান্সড ক্যান্টিলিভার প্রগ্রেসিভ বক্স গার্ডার’ হিসেবে নকশা করা হয়েছে। উড়ালসড়কের র্যাম্প (গাড়ি ওঠানামার পথ) নির্মাণে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় এখন পিসি গার্ডারের পরিবর্তে আরসিসি বক্স গার্ডার হিসেবে নকশা দিয়েছে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান।
‘অনুমান’ ও ‘তড়িঘড়ি’
অবশ্য প্রকল্পটির সঙ্গে যুক্ত সরকারি কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, শুরুতে এটি নেওয়া হয়েছিল অনুমানের ভিত্তিতে ব্যয় প্রাক্কলন এবং তড়িঘড়ি করে।
গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ব্যয় পর্যালোচনা কমিটির প্রধান অতিরিক্ত সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিনই তড়িঘড়ি আর অনুমানের ভিত্তিতে প্রকল্প তৈরির কথা উল্লেখ করেন। তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাইও (ফিজিবিলিটি স্টাডি) ভালোভাবে করা হয়নি। ওই সময় যদি ডিপিপি ঠিকভাবে করা হতো, তাহলে তখনই ব্যয়ের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়ে যেত। তিনি বলেন, এখন বিশেষজ্ঞদের দিয়ে বিস্তারিত সম্ভাব্যতা যাচাই করতে গিয়ে নির্মাণকাজের ধরন ও নকশা পরিবর্তন করতে হয়েছে। এ জন্য ব্যয় বাড়ছে।
সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, শুরুতে বন্দর কর্তৃপক্ষ নকশা ও নির্মাণ স্থান নিয়ে কোনো আপত্তি জানায়নি। কিন্তু কাজ শুরুর পর মূল সড়কের ওপর নির্মাণের ব্যাপারে আপত্তি তুলে ধরে। এ জন্য নকশা পরিবর্তন করতে হয়েছে। এই কারণে ভূমি অধিগ্রহণ ও স্থাপনার ক্ষতিপূরণও বেড়ে গেছে। অবশ্য তিনিও স্বীকার করেন, শুরুতে ভালোভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই না করেই প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল।
এদিকে সূত্র জানিয়েছে, বাস্তবায়ন যথা সময়ে শেষ না হওয়ায় এখন নির্মাণসামগ্রীর বাড়তি দামও প্রকল্পের ব্যয় বাড়াচ্ছে।
‘এটা সারা দেশের চিত্র’
উড়ালসড়কের নির্মাণকাজ শেষ হলে নগরের যানজট কমবে বলে আশা করা হয়। কারণ, নগরের ব্যস্ততম একটি সড়কের ওপর দিয়ে এই উড়ালসড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। তবে নির্মাণকাজের দীর্ঘসূত্রতা নগরবাসীর জন্য ভোগান্তি তৈরি করেছে। গত বর্ষায় নির্মাণকাজের এলাকায় ভাঙাচোরা সড়কের কারণে ব্যাপক দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে মানুষকে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, শুরুতে গোঁজামিলের মাধ্যমে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। অনুমোদনের পর লাগামছাড়া খরচ বাড়ে। এটি শুধু চট্টগ্রামের নয়, সারা দেশের চিত্র। এটি অত্যন্ত খারাপ সংস্কৃতি। তিনি বলেন, এই সংস্কৃতির জন্য সংস্থাগুলোর চেয়ে মন্ত্রণালয়ের দায় বেশি। আবার মন্ত্রণালয়ের চেয়ে পরিকল্পনা কমিশনের দায় আরও বেশি।