পাঠকের লেখা–৪২
আমাদের রেডিওর দিনগুলো
প্রিয় পাঠক, প্রথম আলোয় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে আপনাদের লেখা। আপনিও পাঠান। গল্প-কবিতা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা। আপনার নিজের জীবনের বা চোখে দেখা সত্যিকারের গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা। শব্দসংখ্যা সর্বোচ্চ ৬০০। দেশে থাকুন কি বিদেশে; নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায়: [email protected]
শীতের সকাল। মোরগ ডাক দিয়েছে সেই কখন, লেপের ওম ছেড়ে বেরোতে আলাদা সাহস আর উদ্যম দরকার। তখনই বেজে উঠল এক শীলিত কণ্ঠস্বর—সকাল সাতটা। রেডিও বাংলাদেশ। খবর পড়ছি ইমরুল চৌধুরী।
আমাদের সকালটা শুরু হতো সাতটার খবর দিয়ে। পড়তেন আসমা আহমেদ মাসুদ, ইমরুল চৌধুরী, সরকার কবির উদ্দিন, ফারুক হোসাইন।
ইমরুল চৌধুরীকে বেশি ভালো লাগত। কণ্ঠটা কাতর; কিন্তু কী অসাধারণ আবেদনময়! সরকার কবির উদ্দিন পড়তেন ভয়েস অব আমেরিকার মতো করে। তখনকার রেডিওর খবরের ভিন্ন একটা সুর ছিল। এখনকার মতো সাদামাটা ছিল না।
আমাদের রেডিওটা ছিল দুই ব্যান্ডের। কাঠের বাক্স। আকারে বড়। আব্বা শুনতেন খবর। আমরা ভাইবোনেরা গান, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান আর নাটক।
সকাল আটটায় শুরু হতো খুলনা কেন্দ্রের জনপ্রিয় রম্যনাটিকা অচিন্ত্য কুমার ভৌমিকের লেখা আয়না। সুরত আলীর হাসি আর বিখ্যাত সংলাপ ‘মারাত্মক সিরিকাস’-এ মন ভরে যেত। সঙ্গে ইজ্জত আলী আর ময়না ভাবি। সামাজিক অসংগতি নিয়ে তাঁরা ফুটিয়ে তুলতেন মনোহর বিদ্রূপ।
একই সময়ে মাঝেমধ্যে চলে যেতাম চট্টগ্রাম কেন্দ্রে। ওখানে হতো ‘চলমান চট্টগ্রাম’। কুইজ থাকত। বিজয়ীদের নাম প্রচার করা হতো। রেডিওতে নিজের নাম শুনতে কী যে ভালো লাগত তখন!
এর আগে সাড়ে সাতটায় ধরতাম আকাশবাণী কলকাতা। শুনতাম ‘প্রাত্যহিকী’। অসাধারণ সব চিঠি পড়া হতো ওখানে। এ মুহূর্তে মনে পড়ছে পত্রলেখক মীনা শর্মাকে। আমিও লিখতাম। মীনা শর্মার সঙ্গে চিঠিতে যোগাযোগ ছিল আমার।
দুপুরের পর ঢাকা ‘খ’ কেন্দ্রে শুরু হতো বিজ্ঞাপন তরঙ্গ। মা-চাচিরা সিনেমার গান ছেড়ে দিয়ে রান্নাবান্না করতেন—‘ও পরদেশি, আবার তুমি আসবে ফিরে, আমায় কথা দাও...’।
শুক্রবার বেলা দুইটায় থাকত নাটক। রাত ১০টায়ও নাটক থাকত। আমরা গোল হয়ে বসে শুনতাম। খুলনা কেন্দ্রের নাটক বেশি ভালো লাগত। ওখান থেকে বিশ্বসাহিত্যের নাটক প্রচার হতো বেশি। লাড্ডু, দ্য লাস্ট লিপ...এখনো মনে আছে।
বেলা পড়ে এলে মনোযোগ দিতাম বিজ্ঞাপনী ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে। মূলত সিনেমার প্রচার ছিল ওগুলো। মাজহারুল ইসলাম শুরু করতেন—‘হ্যাঁ ভাই...’। তবে এই অনুষ্ঠানগুলোকে জনপ্রিয় করে তোলেন নাজমুল হুসাইন। তাঁর অসাধারণ সৃজনশীলতায় শ্রোতারা হুমড়ি খেয়ে পড়তেন হেনোলাক্স সুরের পরশ, মার্কোলাক্স সুর মেহফিল, হাঁস মার্কা নারকেল তেল গানের দোলায়। এসব অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে সৌভিক রেহমান প্রীণন, বিলাপিনী, তানজিনা পিয়াস রেখা, ইকবাল খন্দকার, শিমু, রোমান মোল্লা, ইব্রাহিম খলিলুল্লাহসহ অনেক শ্রোতা রীতিমতো তারকা বনে গিয়েছিলেন।
সন্ধ্যায় শুরু হতো ‘দেশ আমার মাটি আমার’, সৈনিক ভাইদের জন্য অনুষ্ঠান ‘দুর্বার’, ‘সুখী সংসার’। দুর্বারে সপ্তাহে এক দিন থাকত অনুরোধের আসর। ওটা ছিল আকর্ষণীয়। সুখী সংসার শুরু হলে আব্বা রেডিওটা নিয়ে যেতেন। কারণ, সাড়ে সাতটায় বিবিসি। আতাউস সামাদ, মানসী বড়ুয়ারা সাগরপারের বন্ধুদের স্বাগত জানাতেন।
রাত সাড়ে আটটায় রেডিও বাংলাদেশের খবর (পরে বাংলাদেশ বেতার) ও সংবাদ পর্যালোচনা। নয়টায় উত্তরণে থাকতেন শফি কামাল। ১০টায় ভয়েস অব আমেরিকা। ইকবাল বাহার চৌধুরী, মাসুমা খাতুন কিংবা সরকার কবির উদ্দিন শুরু করতেন এভাবে—‘ভয়েস অব আমেরিকা ওয়াশিংটন। আমেরিকায় এখন দুপুর বারোটা, বাংলাদেশে রাত দশটা আর ভারতে রাত সাড়ে নয়টা।’ সরকার কবির উদ্দিনের শুরুটা ছিল ঢাকা রেডিও থেকে। পরে তিনি ভয়েস অব আমেরিকায় যোগ দেন।
রেডিও বাংলাদেশ ঢাকায় কখন থেকে যেন শুরু হয়েছিল নিশুতি অনুষ্ঠান। মনে পড়ছে না৷ রাত ১২টায় শুরু হতো। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বেবি নাজনীন গেয়েছিলেন—‘এলোমেলো বাতাসে উড়িয়েছি শাড়ির আঁচল’।
আর ছিল ফুটবল-ক্রিকেট খেলার ধারাভাষ্য।
নাজমুল হুসাইনের ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান আর ধারাভাষ্য শোনার জন্য পকেট-রেডিও রাখতাম। অনুষ্ঠান শেষে নাজমুল হুসাইন বলতেন, ‘ভালো থাকা হয় যেন।’ আর মালয়েশিয়ার কিলাত ক্লাব মাঠ থেকে চৌধুরী জাফর উল্লাহ শরাফতের বিখ্যাত কণ্ঠ ভেসে আসত—‘এইমাত্র বাংলাদেশের নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান আকরাম খান হাফ সেঞ্চুরি করার খ্যাতি অর্জন করেছেন...’
আমাদের বিনোদনের মাধ্যম ছিল সেই এক রেডিওই। আবাহনী-মোহামেডানের খেলা হতো ঢাকায়, রেডিওর কল্যাণে আমরা গ্রামবাসী বিভক্ত হয়ে যেতাম দুই ভাগে। খোদাবক্স মৃধা, মোহাম্মদ মুসা কিংবা আবদুল হামিদ হয়ে উঠেছিলেন আমাদের অতি চেনা আপনজন।
এখন তথ্যপ্রবাহ আর বিনোদনের দুয়ার উন্মুক্ত, অবারিত। তবু কেন জানি না, রেডিওকালের আবেগ এখন আর খেলা করে না; সেই সময়ের সুবাসটাই ছিল অন্য রকম, মায়াজড়ানো।
মাইনুল এইচ সিরাজী, সিরাজপুর, কোম্পানীগঞ্জ, নোয়াখালী