তারা কি ফিরিবে আর...

‘ভুলি নাই ভুলা নাই মৃত্যুমিছিল: জেনোসাইড একাত্তর দায়বদ্ধতা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে শহীদদের স্মরণে মোমবাতি প্রজ্বালন করা হয়। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারেছবি: দীপু মালাকার

‘যারা স্বর্গগত তারা এখনো জানে
স্বর্গের চেয়ে প্রিয় জন্মভূমি
এসো স্বদেশ ব্রতের মহা দীক্ষালোভী
সেই মৃত্যুঞ্জয়ীদের চরণচুমি’
গানের এই চরণগুলো ভেসে আসছিল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে। এই গান শুনে মনে প্রশ্ন জাগে, মোহিনী চৌধুরীর কথাগুলো আজ কেন শহীদ মিনারে।

একটু এগিয়ে গিয়ে দেখা যায়, মোমবাতি প্রজ্বালন করা হয়েছে। ২৫ মার্চ কালরাতের শহীদদের স্মরণে গান গাইছেন একদল শিল্পী। গানটি শেষ হতে না হতেই আবারও তাঁরা গেয়ে উঠলেন—
‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্ত লাল রক্ত লাল রক্ত লাল’
সে সময় তাঁদের চেহারায় মোমবাতির আভা। সেই চেহারায় ফুটে উঠছে নানা দাবি। গোবিন্দ হালদারের গানের কথায় যেন সেই দাবিগুলোই তুলে ধরছিলেন—
‘আর দেরি নয় উড়াও নিশান
রক্তে বাজুক প্রলয় বিষাণ
বিদ্যুৎ গতি হউক অভিযান
ছিঁড়ে ফেলো সব শত্রু জাল, শত্রু জাল’

মঙ্গলবার সন্ধ্যা পৌনে সাতটায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘ভুলি নাই ভুলি নাই মৃত্যুমিছিল: জেনোসাইড একাত্তর দায়বদ্ধতা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে মোমবাতি প্রজ্বালন শেষে এভাবেই সব প্রজন্মের কাছে একাত্তরের গণহত্যার ইতিহাস তুলে ধরেন শিল্পীরা। স্মরণ করেছেন কালরাতের শহীদদের।

মোমবাতি প্রজ্বালন ও শহীদ স্মরণের এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বাংলাদেশ গণসংগীত সমন্বয় পরিষদ। অনুষ্ঠানের শুরুতে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সন্‌জীদা খাতুনের মৃত্যুতে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

মোমবাতি প্রজ্বালনের আগে বাংলাদেশ গণসংগীত সমন্বয় পরিষদের সভাপতি কাজী মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমরা তরুণ প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তুলে ধরতে আজকের এই আয়োজন করেছি। একই সঙ্গে ২৫ মার্চ কালরাতের নির্মম গণহত্যা আন্তর্জাতিক মহলে স্বীকৃতি লাভের দাবি জানাচ্ছি।’

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শহীদদের স্মরণে মোমবাতি প্রজ্বালন করা হয়
ছবি: দীপু মালাকার

বাংলাদেশ গণসংগীত সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর হামলার কথা স্মরণ করে বলেন, ‘মুক্তির আন্দোলনের প্রমাণ আজ আমার পেছনেই মহিরুহ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে—কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, যেখান থেকেই আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনের যাত্রা শুরু হয়েছিল।’

মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ জয় পেলেও মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি বলে মন্তব্য করেন মানজার চৌধুরী। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বৈষম্যহীন যে সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা হয়েছিল, সে সমাজ কখনো কোনোভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এর ফলে দেশে পর পর বেশ কয়েকটি গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে। সর্বশেষ ২০২৪–এর জুলাই গণ-অভ্যুত্থান।

একাত্তরের ২৫ মার্চের কালরাতের শহীদদের স্মরণে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বাংলাদেশ গণসংগীত সমন্বয় পরিষদ
ছবি: দীপু মালাকার

মানজার চৌধুরী বলেন, যদি শুধু বড়লোকেরা, বড়রা মুক্তি পায়, সেই মুক্তি সার্বিক হবে না। এ দেশের সাধারণ মানুষ, রিকশাচালক ও শ্রমিকেরা বঞ্চনা থেকে মুক্তি পেলে বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। একই সঙ্গে ৭১–এর চেতনা সমুন্নত থাকবে।

কথা হচ্ছিল ২৫ মার্চ কালরাতের ভয়াবহতা দেখেছেন এমন একজনের সঙ্গে। তিনি আজকের আয়োজনে সবার সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে গাইছিলেন—
‘কত বিপ্লবী বন্ধুর রক্তে রাঙা
বন্দিশালায় ঐ শিকল ভাঙা
তারা কি ফিরিবে আর
তারা কি ফিরিবে এই সুপ্রভাতে
যত তরুণ অরুণ গেছে অস্তাচলে’
ওই ব্যক্তির নাম ফকির সিজার, বাংলাদেশ গণসংগীত সমন্বয় পরিষদের সহসভাপতি। তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যেকোনো মূল্যে চেয়েছিল আমাদের স্বাধিকার আন্দোলন রুখে দিতে। কিন্তু আমরা প্রস্তুত ছিলাম অনেক অনেক আগে থেকেই। একটি স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য।’