এডিস মশা স্বভাব বদলেছে। তাই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে পরিবর্তন আনতে হবে। এ বছর গ্রামে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে। ডেঙ্গু মোকাবিলায় সবাইকে সক্রিয় থাকতে হবে। সবার অংশগ্রহণ থাকলে পরিস্থিতি গত বছরের মতো খারাপ হবে না।
রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে আজ মঙ্গলবার আয়োজিত ‘ডেঙ্গু মোকাবিলায় প্রস্তুতি, ২০২৪: আমরা কোথায়?’ শীর্ষক আলোচনা সভায় এসব কথা উঠে আসে।
নাগরিক সংগঠন ইউএসসি ফোরাম ও বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক যৌথভাবে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন ছাড়াও এ আয়োজনে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানী ও গবেষক, জনস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ, বিদেশি দূতাবাসের প্রতিনিধি, বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) প্রতিনিধি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, স্বাস্থ্যকর্মীরা অংশগ্রহণ করেন।
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মায়ের মারা যাওয়ার কথা জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন বলেন, ডেঙ্গুর ব্যাপারে তাঁর বিশেষ মনোযোগ আছে। তবে ডেঙ্গু মোকাবিলা একা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়। ডেঙ্গু মোকাবিলায় সবার সহযোগিতা দরকার। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, এ বছর গ্রামে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে।
চলতি বছর ডেঙ্গু চিকিৎসায় দেশের কোথাও স্যালাইনের ঘাটতি হবে না বলে আশ্বাস দেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। স্যালাইনের দাম বাড়ানো যাবে না বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে প্রথম উপস্থাপনায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, মানুষের ধারণা রাতে এডিস মশা কামড়ায় না, মশা শুধু স্বচ্ছ মিষ্টি পানিতেই বংশ বিস্তার করে। নিজের গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে এই কীটতত্ত্ববিদ বলেন, এডিস মশার স্বভাব বদলেছে। এরা রাতেও কামড়ায়; লোনা পানিতে, এমনকি নোংরা পানিতেও ডিম পাড়ে।
ডেঙ্গুর ব্যাপারে তাঁর বিশেষ মনোযোগ আছে। তবে ডেঙ্গু মোকাবিলা একা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়। ডেঙ্গু মোকাবিলায় সবার সহযোগিতা দরকার।
কবিরুল বাশার বলেন, গত বছর গ্রামাঞ্চলে ব্যাপকভাবে ডেঙ্গু ছড়িয়েছে। গ্রামে ডেঙ্গু ছড়ায় মূলত এডিস অ্যালবোপিকটাস। এখন গবেষণা করে দেখা দরকার, এডিস অ্যালবোপিকটাস বেশি পরিমাণে ডেঙ্গুর জীবাণু বহন করার সক্ষমতা অর্জন করেছে কি না। মশার ওষুধের অকার্যকারিতার তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে নতুন পথে হাঁটতে হবে।
ডেঙ্গু শনাক্তের কিট উদ্ভাবন করেছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রেফারেন্স ইনস্টিটিউট ফর কেমিক্যাল মেজারমেন্ট (বিআরআইসিএম)। প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক মালা খান বলেন, তাঁদের উদ্ভাবিত কিট দিয়ে ঘরে বসেই যেকোনো ব্যক্তি ডেঙ্গু পরীক্ষা করতে পারবে। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর এই কিটের অনুমোদন দিয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এই কিট ব্যবহার করতে পারে। তিনি আরও বলেন, দেশে দৈনিক সর্বোচ্চ ২০ হাজার মানুষের ডেঙ্গু শনাক্তের পরীক্ষা হয়। দৈনিক ৫০ হাজার কিট তৈরির সক্ষমতা তাঁদের আছে।
এডিশ মশা নিয়ে কবিরুল বাশারের বক্তব্যের সূত্র ধরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, মশা যেহেতু স্বভাব বদলেছে, তাই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে পরিবর্তন আনতে হবে। এ ছাড়া তিনি বলেন, রোগতত্ত্ব রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর), জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান বিআরআইসিএমের উদ্ভাবিত কিট পরীক্ষা করে দেখবে। তারপর এই কিট ব্যবহারের ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সিদ্ধান্ত নেবে।
এডিস মশার স্বভাব বদলেছে। এরা রাতেও কামড়ায়; লোনা পানিতে, এমনকি নোংরা পানিতেও ডিম পাড়ে।
সভায় রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক শেখ দাউদ আদনান বলেন, ডেঙ্গু পরীক্ষার ফি সরকারি হাসপাতালে ও বেসরকারি হাসপাতালে যথাক্রমে ৫০ ও ৩০০ টাকা। সরকারের কাছে ১২ লাখ রোগ শনাক্তের কিট মজুত আছে। তিনি বলেন, হাসপাতালে রোগী এলে একটি অ্যাপের মাধ্যমে নিবন্ধন করা হবে। এতে জানা যাবে, কোথায় রোগী বেশি বা কম। সেই তথ্যের ভিত্তিতে সরকার ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা জোরদার করতে পারবে।
অনুষ্ঠানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের জনস্বাস্থ্য পরামর্শক শাবানা আর চৌধুরীর ধারণকৃত বক্তব্যের ভিডিও চিত্র উপস্থাপন করা হয়। ভারতীয় ওই বিশেষজ্ঞ কলকাতায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, সরকারি হাসপাতালে তো বটেই, বেসরকারি হাসপাতালে কোনো ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হলে সরকারকে জানানো বাধ্যতামূলক। তিনি বলেন, স্বাস্থ্যকর্মীরা রোগীর বাড়ি যান। মশার উপস্থিতি আছে কি না, তা পর্যবেক্ষণ করেন। কোনো বাড়িতে বা প্রতিষ্ঠানে লার্ভা পাওয়া গেলে জরিমানা করা হয়। হাইকোর্টের নির্দেশে কলকাতায় ফগিং (ধোঁয়া দেওয়া) নিষিদ্ধ হয়েছে। তিনি বলেন, কমিউনিটি প্রতিনিধি, চিকিৎসা-স্বাস্থ্যকর্মী ও নীতিনির্ধারক—এই তিন শ্রেণির মানুষের সমন্বয়ে কলকাতায় ডেঙ্গু মোকাবিলা কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
বিআরআইসিএমের মহাপরিচালক মালা খান বলেন, তাঁদের উদ্ভাবিত কিট দিয়ে ঘরে বসেই যেকোনো ব্যক্তি ডেঙ্গু পরীক্ষা করতে পারবে। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর এই কিটের অনুমোদন দিয়েছে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে নারীস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ হালিদা হানুম আখতার বলেন, সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ডেঙ্গুতে পুরুষ বেশি আক্রান্ত হয়, কিন্তু মৃত্যু বেশি হয় নারীর। কেন নারীর বেশি মৃত্যু হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখার দাবি জানান তিনি।
এ পরিপ্রেক্ষিতে সাংবাদিকেরা বলেন, ডেঙ্গুর মৃত্যু পর্যালোচনা হলে কেন কার মৃত্যু হচ্ছে, কেন নারী বেশি মারা যাচ্ছে, তা জানা যেত। কিন্তু গত বছর থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মৃত্যু পর্যালোচনা বন্ধ রেখেছে।
অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ও ব্র্যাকের চেয়ারপারসন অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, বছরের চার মাস চলে গেছে। সবাইকে ডেঙ্গু মোকাবিলায় সক্রিয় থাকতে হবে। সবার অংশগ্রহণ থাকলে আশা করা যায়, গত বছরের মতো এ বছর পরিস্থিতি ততটা খারাপ হবে না।
ব্র্যাকের স্বাস্থ্য কর্মসূচির জ্যেষ্ঠ পরিচালক মো. একরামুল ইসলাম বলেন, ডেঙ্গু মোকাবিলা কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হলে মানুষকে সঠিক তথ্য দিতে হবে।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন ইউএসসি ফোরামের কর্মকর্তা আমিনুল হাসান ও ব্র্যাকের কর্মসূচি সমন্বয়কারী ইমরান আহমেদ চৌধুরী।
অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, তাঁর গবেষণা ফলাফল নিয়ে বৈজ্ঞানিক আলোচনা ও বিতর্ক হতে পারে। অনুষ্ঠান শেষে এ বিষয়ে হোসেন জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেছেন, বিজ্ঞানীদের নিয়ে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করা হবে। এতে বিতর্কের অবসান হবে।