দেশে বিভিন্ন গণমাধ্যমের নাম, লোগো ও ফেসবুক ফটোকার্ডকে কাজে লাগিয়ে ভুয়া ও অপতথ্যের প্রচার আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর এই হার আরও বেড়েছে বলে রিউমার স্ক্যানারের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাসে অভ্যুত্থানের পূর্ববর্তী সময়ে গণমাধ্যমকে জড়িয়ে ১৯৯টি অপতথ্যের ঘটনা তুলে ধরেছে তথ্য যাচাইকারী বা ফ্যাক্ট চেকার প্রতিষ্ঠানটি। আর অভ্যুত্থানের পর থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১২৫টি ফ্যাক্ট চেকে অপতথ্য তুলে ধরেছে রিউমার স্ক্যানার।
রিউমার স্ক্যানারের প্রতিবেদনে বলা হয়, অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে গণমাধ্যমকে জড়িয়ে অপতথ্যের ঘটনাগুলোয় ভুয়া ফটোকার্ড, নাম ও লোগো ব্যবহার, প্রকাশিত সংবাদের সম্পাদিত স্ক্রিনশট, সম্পাদিত ফটোকার্ড এবং প্রকাশিত সংবাদের শিরোনাম বিকৃত করে প্রচার করা হয়েছে। এসব ঘটনায় বিদেশি ৩টিসহ ২৮টি গণমাধ্যমকে জড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি এসেছে যমুনা টেলিভিশনের নাম। এ সময় গণমাধ্যমকে জড়িয়ে অপতথ্যের সবচেয়ে বেশি শিকার হয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এসব অপতথ্যের প্রতিটিই ফেসবুকে প্রচারিত হয়েছে। ছড়িয়েছে সামাজিক যোগাযোগের অন্যান্য মাধ্যমেও।
গণমাধ্যম যখন অপতথ্য প্রচারের হাতিয়ার
২০২৩ সালে গণমাধ্যমের নাম, লোগো, শিরোনাম এবং নকল ও ভুয়া ফটোকার্ড ব্যবহার করে ১৪৫টি অপতথ্য প্রচার করা হয়। চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে একই কায়দায় ৩২৪টি অপতথ্য প্রচারের প্রমাণ পেয়েছে রিউমার স্ক্যানার। এর মধ্যে গণ–অভ্যুত্থানের পূর্ববর্তী সময়, অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে ৫ আগস্টের মধ্যে ১৯৯টি অপতথ্যের প্রচার হলেও পরের প্রায় দুই মাসে ১২৫টি অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে।
রিউমার স্ক্যানারের বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, প্রথম সাত মাসে গড়ে ২৮টি অপতথ্যের প্রচারে গণমাধ্যমকে জড়ানো হয়েছে। পরের দুই মাসে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ৬২–তে। এই ১২৫টি অপতথ্যের মধ্যে গণ–অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময় থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছে ৪৮টি। বাকি ৭৭টি শনাক্ত হয়েছে ১ থেকে ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে।
অপতথ্য প্রচারে নানা কৌশল
গত আগস্টে দেশের পূর্বাঞ্চলে ব্যাপক বন্যা হয়। এতে ফেনীতে শিশুসহ ৪২৮ জন, নোয়াখালীতে ৩৮৫ জন এবং কুমিল্লায় ১০৩ জন মারা গেছে দাবি করে যমুনা টিভির নকশাসংবলিত একটি ফটোকার্ড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়। আদতে যমুনা বা অন্য কোনো গণমাধ্যম মৃত্যুর এমন কোনো সংখ্যা উল্লেখ করেনি।
এভাবে গণমাধ্যমকে নকল করে ভুয়া ফটোকার্ড বানিয়ে অপতথ্য ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। গণ–অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে ভুয়া ফটোকার্ডের মাধ্যমে ছড়ানো ৭৮টি গুজব শনাক্ত করেছে রিউমার স্ক্যানার। এ ছাড়া কোনো ভুয়া তথ্যের সূত্র হিসেবে গণমাধ্যমের নাম বা লোগো ব্যবহার। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের স্ক্রিনশট সম্পাদনা করে ভিন্ন তথ্য জুড়ে দেওয়া। প্রকাশিত ফটোকার্ড সম্পাদনা করে প্রকৃত তথ্য পাল্টে দিয়ে ভুয়া তথ্য বসিয়ে প্রচার। গণমাধ্যমের শিরোনাম বদলে দিয়ে ভিন্ন শিরোনামে প্রচারের মাধ্যমে জনমনে বিভ্রান্তির জন্ম দিয়ে চলেছেন অপপ্রচারকারীরা।
অপতথ্যের প্রচার বেশি ফেসবুকে
রিউমার স্ক্যানারের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গণমাধ্যমকে জড়িয়ে যেসব অপতথ্য প্রচারিত হয়, তার সিংহভাগের উৎপত্তি বা উৎস ফেসবুকে। ফেসবুক থেকে তা পরে টিকটক, এক্স (সাবেক টুইটার) ও ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্মগুলোয় ছড়িয়ে পড়ছে। অভ্যুত্থানের পরে অপতথ্য প্রচারের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ছিল না।
রাজনৈতিক বিষয়ে সবচেয়ে বেশি অপতথ্য
গণমাধ্যমকে জড়িয়ে নানা কৌশল অবলম্বনে গত দুই মাসে সবচেয়ে বেশি ভুল তথ্য (৪৭টি) প্রচার করা হয়েছে রাজনৈতিক বিষয়ে, যা মোট সংখ্যার ৩৮ শতাংশ। এ ছাড়া জাতীয় বিষয়ে ৩১ শতাংশ এবং খেলাধুলা বিষয়ে ৮ শতাংশ অপতথ্য ছড়ানো হয়েছে।
সবচেয়ে বেশি শিকার যমুনা টিভি
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান–পরবর্তী আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে অপতথ্য প্রচারে গণমাধ্যম হিসেবে সবচেয়ে বেশি ৫৩ বার জড়ানো হয়েছে যমুনা টিভিকে। গণমাধ্যমটির ফটোকার্ডের নকশা নকল করে অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে ৪৮টি। বাকি পাঁচটির মধ্যে তিনটিতে ভুয়া তথ্যের সূত্র হিসেবে গণমাধ্যমটির নাম ব্যবহার করা হয়েছে। এ ছাড়া সম্পাদিত ফটোকার্ড একটি এবং শিরোনাম বিকৃত করে প্রচার করা হয়েছে একটি ভুয়া তথ্য।
২৮টি গণমাধ্যমের তালিকায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৩টি অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে প্রথম আলোকে জড়িয়ে। এরপর যথাক্রমে রয়েছে আরটিভি, কালবেলা ও সময় টিভি।
সর্বাধিক অপতথ্য ড. ইউনূসকে নিয়ে
শেখ হাসিনার সরকারের পদত্যাগের পর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। নেতৃত্বে আসেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। রিউমার স্ক্যানারের বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে কাজ শুরুর পর থেকে নিয়মিতই ড. ইউনূসকে জড়িয়ে নানা গুজব ইন্টারনেটের বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারিত হয়ে আসছে।
গণ–অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে গণমাধ্যমকে জড়িয়ে অপতথ্য প্রচারের ক্ষেত্রেও ড. ইউনূসের বিষয়েই সবচেয়ে বেশি অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে। তাঁকে জড়িয়ে ২০টি অপতথ্য শনাক্ত করা হয়েছে, যেগুলো প্রচারের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমকে ভুয়া সূত্র হিসেবে সম্পৃক্ত করা হয়েছে।
এ তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরের দুই অবস্থানে রয়েছেন যথাক্রমে ক্রিকেটার ও সাবেক সংসদ সদস্য সাকিব আল হাসান এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ।
গণমাধ্যম ও নেটিজেনদের দায় কতটা
গণমাধ্যমকে জড়িয়ে প্রচারিত অপতথ্যগুলো অনেক নেটিজেনই কোনো প্রকার সতর্কবাণী উল্লেখ ছাড়াই সার্কাজম বা ব্যঙ্গাত্মক হিসেবে ধরে নিয়ে শেয়ার করেন। আদতে এভাবে অপতথ্যগুলোর প্রচার ও প্রসারের সুযোগ ঘটে।
গণমাধ্যমের নকল ফটোকার্ড দেখে বা কোনো পোস্টে দেওয়া তথ্যের সূত্রে গণমাধ্যমের নাম দেখেই বিষয়টি সত্য বলে ভেবে নেন, এমন লোকের সংখ্যাও কম নয়। অনেক ক্ষেত্রে এসব অপতথ্য সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যমের প্রতি পাঠক ও দর্শকদের বিশ্বাসে চিড় ধরাতে সক্ষম। কিছু ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের এগিয়ে যাওয়াকেও বাধাগ্রস্ত করে দিতে পারে এসব অপতথ্য।
গণমাধ্যমগুলো ইদানীং তাদের নামে গুজব ছড়ানো হলে পরবর্তী সময়ে তা নিয়ে পোস্ট করে জানাচ্ছে যে এটি তাদের প্রকাশিত কোনো তথ্য বা ফটোকার্ড নয়। তবে পদক্ষেপ হিসেবে এটিকে যথেষ্ট বলে মনে করে না রিউমার স্ক্যানার।
গণমাধ্যমকে ভুয়া সূত্র হিসেবে দাঁড় করিয়ে অপতথ্য ছড়ানোর প্রবণতা দিন দিন যেভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যমের কর্তৃপক্ষকে আইনি পথেও হাঁটার পরামর্শ দিয়েছে রিউমার স্ক্যানার।