স্বাধীন পুলিশ কমিশন জরুরি

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় পুলিশে পদায়নের ক্ষেত্রে মোটা অঙ্কের ঘুষ লেনদেনের কথা শোনা গেছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের নৌপরিবহন এবং বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন সেমিনারে বক্তব্য দেন। ঢাকা, ৯ নভেম্বরছবি: নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌজন্যে

নির্মমতা, গুম এবং বিরোধী কণ্ঠ দমনে পুলিশকে ব্যবহার করা হতো—দেশে গত ১৫ বছরের বাস্তবতা অনেকটা এমনই ছিল। যে কারণে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে পুরো পুলিশ বাহিনী বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে পুলিশকে পেশাদার ও জনমুখী সেবাদানকারী সংস্থায় পরিণত করতে ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। এই সংস্কারপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন করা জরুরি।

‘জনমুখী পুলিশ সেবা নিশ্চিতকল্পে পুলিশ কমিশন গঠন ও অন্যান্য সংস্কারের প্রস্তাব’ শীর্ষক সেমিনারে বিশিষ্টজনদের আলোচনায় এসব বিষয় উঠে এসেছে। আলোচকদের মধ্যে ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা, সাবেক সচিব, পুলিশের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। শনিবার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট হলে এই সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেমিনারের আয়োজক নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্স (এসআইপিজি)।

সেমিনারে বলা হয়, এর আগেও দুবার (২০০৭ ও ২০১৩ সালে) পুলিশের সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা না থাকায় ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে শেষ পর্যন্ত সেসব উদ্যোগ আলোর মুখ দেখেনি। তাই পুলিশ সংস্কার প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোকে সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন। এর কারণ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পুলিশ বাহিনীর সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু করলেও সেটি বাস্তবায়ন করবে জাতীয় নির্বাচনের পর ক্ষমতায় আসা কোনো না কোনো দলীয় সরকার।

পুলিশকে দানবিক করা হয়েছে। পুলিশকে মানবিক করতে হলে স্বাধীন পুলিশ কমিশন করতে হবে।
এম সাখাওয়াত হোসেন, উপদেষ্টা, অন্তর্বর্তী সরকার

সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে অন্তর্বর্তী সরকারের নৌপরিবহন এবং বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, পুলিশের ভেতর থেকেই এখন একটি কমিশন গঠনের দাবি উঠেছে। বিগত সরকারের সময়ে পুলিশকে ‘দানবিক’ করা হয়েছে। পুলিশকে মানবিক করতে হলে স্বাধীন পুলিশ কমিশন করতে হবে।

গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথমে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার দায়িত্বে ছিলেন এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, বিগত সরকারের সময়ে পুলিশে পদায়নের ক্ষেত্রে মোটা অঙ্কের ঘুষ লেনদেনের কথা শোনা গেছে। ঘুষ–বাণিজ্যের যেসব তথ্য তিনি জেনেছেন, সেটি দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) বলেছেন। একজন পুলিশ সুপার নিয়োগে দুই কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। এমনকি ঢাকায় একজন ওসির (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) পদায়নেও দুই কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। তিনি বলেন, এটা যদি হয়, তাহলে এই পুলিশ থেকে কোনো কিছুই প্রত্যাশা করা যায় না। পুলিশে ‘বাণিজ্য’ বন্ধ করতে হলে নিয়োগপ্রক্রিয়ার পরিবর্তন করতে হবে, স্বচ্ছতা আনতে হবে।

সেমিনারে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পুলিশের বিশেষ শাখার সাবেক প্রধান বাহারুল আলম বলেন, তিনটি প্রক্রিয়ায় ভিন্ন ভিন্ন পদে পুলিশে নিয়োগ হয়। সেগুলো হলো কনস্টেবল, এসআই (উপপরিদর্শক) এবং সহকারী পুলিশ সুপার বা এএসপি (বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে)। নিম্ন পদে যাঁরা নিয়োগ পান, তাঁদের অনেকে যোগ্য হলেও উচ্চ পদে যেতে পারেন না। এই নিয়োগপ্রক্রিয়া সংস্কার করে তিনটির বদলে দুটি প্রক্রিয়া চালু করা গেলে সমস্যা হয়তো কিছুটা লাঘব হবে।

পুলিশের জবাবদিহি ও দায়িত্বশীলতা আগে যা ছিল, গত ১৫ বছরে সেটি নষ্ট হয়ে গেছে বলে মনে করেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব এস এম জহুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে পুলিশকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। আগে জেলা পর্যায়েও আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় জনপ্রতিনিধিদের প্রশ্নের মুখে পড়তে হতো পুলিশ কর্মকর্তাদের। গত ১৫ বছরে পুলিশ রাজনৈতিকভাবে এতটাই জড়িয়ে পড়েছে যে তাদের আর জবাবদিহি করতে হয় না।

শুদ্ধি প্রক্রিয়া প্রয়োজন

সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আবদুল হান্নান চৌধুরী। তিনি বলেন, পুলিশ সদস্যদের সর্বোচ্চ নৈতিক এবং নীতিগত মান বজায় রেখে দায়িত্ব পালন করতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় নিরপরাধ ব্যক্তিও পুলিশের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হন, কখনো কখনো অপরাধী পার পেয়ে যান। সংস্কারের মধ্য দিয়ে পুলিশে পরিবর্তন আসবে বলে আশা করেন তিনি।

পুলিশের নিয়োগপ্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন বলে মনে করেন উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মোশাররফ হোছাইন। তিনি বলেন, বর্তমান বাস্তবতায় পুলিশের মনোবল কীভাবে ফিরিয়ে আনা যায়, সেই বিষয়টি সংস্কারপ্রক্রিয়ায় বিবেচনায় নেওয়া জরুরি।

পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মাহবুবুল করিম বলেন, পুলিশ সংস্কারকে বিচ্ছিন্নভাবে বিবেচনা করা যাবে না। সব সংস্কার প্রচেষ্টাকে একই ধারায় বিবেচনা করা জরুরি। কারণ, পুলিশ এই সমাজের অংশ। এখন একটি জাতীয় শুদ্ধি প্রক্রিয়ার প্রয়োজন।

সেমিনারে সঞ্চালক ছিলেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শেখ তাওফিক এম হক। আরও বক্তব্য দেন জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম) চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ।

সেমিনারে পুলিশ সংস্কার–সংক্রান্ত একটি ধারণাপত্র তুলে ধরেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক রিজওয়ানুল ইসলাম এবং পলিটিক্যাল সায়েন্স ও সোশিওলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ইশরাত জাকিয়া সুলতানা। ধারণাপত্রে বলা হয়, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্স পরিচালিত তিনটি জরিপে দেখা গেছে, পুলিশ বাহিনীর ওপর জনগণের আস্থা নাটকীয়ভাবে কমেছে। ২০১৫ সালে এই হার ছিল ৪৫ শতাংশ, যা ২০২৪ সালে ১১ দশমিক ১ শতাংশে নেমে এসেছে। পুলিশকে জননিরাপত্তা ও মানবাধিকার রক্ষার বাহিনী হিসেবে নয়, বরং রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।