রমনা হত্যাকাণ্ড: কী ঘটেছিল ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ

ঠিক ৫১ বছর আগে ১৯৭৪ সালের মার্চে দেশব্যাপী দুর্ভিক্ষ, চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা, আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীদের দুর্নীতি, সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টির শ্রেণিশত্রু খতমের কর্মসূচি, জাসদের সরকারবিরোধী আন্দোলন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ নানামুখী তৎপরতায় টালমাটাল দেশের পরিস্থিতি। ওই সময়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এম মনসুর আলীর মিন্টো রোডের বাসভবন ঘেরাও কর্মসূচি দেয় জাসদ। ওই কর্মসূচিতে রক্ষীবাহিনী ও পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান জাসদের ৬ জন নেতা–কর্মী। চুয়াত্তরের ১৭ মার্চের ঘটনা ইতিহাসে ‘রমনা হত্যাকাণ্ড’ নামে পরিচিত। সেই ঘটনা নিয়ে আজকের ফিরে দেখা।

দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত সেই হত্যাকাণ্ডের খবর

দিনটি ছিল রোববার, সরকারি ছুটির দিন। তারিখের হিসেবে ১৭ মার্চ, ১৯৭৪। ওই দিন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫৪তম জন্মবার্ষিকী। অবশ্য ওই মার্চ মাসেই তিনি বেশ অসুস্থ ছিলেন। তাই উন্নত চিকিৎসার জন্য রুশ সরকারের আমন্ত্রণে ১৯ মার্চ সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজধানী মস্কো যান। তাঁর ঢাকা ত্যাগের দুইদিন আগেই ঘটে সেই ঘটনা।

কী ঘটেছিল সেদিন

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে ১৭ মার্চ পল্টনে জনসভা করে জাসদ। সভা শেষে দলের সভাপতি মেজর (অব.) এম এ জলিল ও সাধারণ সম্পাদক আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বে নেতা–কর্মীরা মিছিল নিয়ে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব.) এম মনসুর আলীর রমনায় মিন্টো রোডের সরকারি বাসভবন ঘেরাও করতে যান। ওই সময় মন্ত্রী কেরানীগঞ্জে ছিলেন। সন্ধ্যা পৌনে ছয়টার দিকে মিছিলকারীরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও করে স্লোগান দিতে থাকেন। তাঁরা মন্ত্রীর বাড়ির লোহার গেটে আগুন ধরানোর চেষ্টা করেন ও ভেতরে ইটপাটকেলও ছোড়েন। পুলিশও বাসার ভেতর থেকে কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ে মিছিলকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়; শুরু হয় সংঘর্ষ। এ সময় ঘটনাস্থলে আসেন রক্ষীবাহিনীর সদস্যরাও। মূল ঘটনা ঘটে এরপরেই। এক পর্যায়ে পুলিশ বেশ কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে। পুলিশকে সহায়তা দিতে থাকে রক্ষীবাহিনী। তারা বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি করে। মেজর জলিল ও আ স ম রব, শাজাহান সিরাজ, মমতাজ বেগমসহ জাসদের অনেক নেতা–কর্মীকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ির সামনের রাস্তায় আহত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। ওই সময় পুলিশ জাসদের প্রায় অর্ধশত নেতা–কর্মীকে আটকও করে। সে সময়ই গুলিতে নিহত হন ৬ জন।

‘ইত্তেফাক’ জানায়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাও কর্মসূচিতে পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীর হামলায় আহত ৩৬ জনকে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে ছেড়ে দেওয়া হয়। ১৬ জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে তিনজন মারা যান। আহতদের মধ্যে সাতজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাঁরা হলেন বাচ্চু মিয়া, কাজী মোস্তফা, আবুল কাশেম, আব্দুল বারেক, শাহজালাল, ফরহাদ, আবদুল হাই, শহীদুল্লাহ, আবুল হোসেন, মাঈনুদ্দীন খান বাদল, শামসুদ্দীন আজাদ, মোহাম্মদ বেলায়েত ও একজন অজ্ঞাতনামা। হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ইডেন কলেজের ছাত্রী মুকুল দেসাই, জাহাঙ্গীর ও শহীদুল হক। এর মধ্যে মুকুল দেসাই ও শহীদুল হকের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

সেই ঘটনায় আহতদের ছবি প্রকাশ করেছিল বাংলার বাণী

‘ইত্তেফাক’ জানায়, ঘটনাস্থল থেকে জাসদের ২০ জনকে আটক করা হয়। তাঁরা হলেন এম এ জলিল, আ স ম আবদুর রব, মমতাজ বেগম, মাঈনুদ্দিন খান বাদল, রোজী, লীনু, বাণী, নাজিরুদ্দিন রশীদ, ইকবাল, জয়নুল আবেদীন, খন্দকার আজিজুল হক, মজিবুর রহমান চৌধুরী, মজনু বাবুল, আজহারুল হক এবং আসাদুল্লাহ। রবের পায়ে গুলি লাগে আর জলিলকে পেটানো হয় বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। 

পত্রিকার পাতায় হত্যাকাণ্ডের খবর

ঘটনার পরের দিন ১৮ মার্চ ‘দৈনিক আজাদ’–এর শিরোনাম ছিল—‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ির সামনে সংঘর্ষে পুলিশের গুলিতে ৩ জন নিহত, আহত ১৮, গ্রেপ্তার ৪০ জন।’
‘ইত্তেফাক’–এর শিরোনাম ছিল—‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবনের সামনে বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ, ৬ জন নিহত, জলিল–রবসহ ১৭ জন গ্রেপ্তার।’ বাংলার বাণীর শিরোনাম ছিল—‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন আক্রমণ করার দুঃখজনক পরিণতি।’ তারা ৪ জন নিহতের খবর দেয়। বাংলার বাণী সরকারি প্রেসনোটে তিনজন নিহতের খবরটিও ছাপে।

বাংলার বাণী পত্রিকায় প্রকাশিত সেই ঘটনার প্রতিবেদন

নিহত ও আহতদের পরিচয়

‘ইত্তেফাক’–এর খবরে বলা হয়, সন্ধ্যা পৌনে ছয়টার দিকে জাসদের নেতা–কর্মীদের সঙ্গে পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীর সংঘর্ষে আহত ৬ জন হাসপাতালে মারা যান। এর মধ্যে প্রদীপ চন্দ্র পাল ও মোজাম্মেল হক এবং অজ্ঞাতনামা দুজন মারা যান ঢাকা মেডিকেলে। আর হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে মাহফুজুল্লাহ ও ঢাকা সিটি কলেজ জাসদ ছাত্রলীগের সম্পাদক জাহাঙ্গীর মারা যান।

ইত্তেফাকে প্রকাশিত প্রতিবেদন

প্রেসনোট ও জাসদের বিবৃতি

দৈনিক আজাদ ১৮ মার্চ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ইস্যুকৃত প্রেসনোট ছাপে। এতে বলা হয়—‘একদল উচ্ছৃঙ্খল মিছিলকারীদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকার্যে নিয়োজিত ব্যক্তিদের গুলিতে ৩ ব্যক্তি নিহত এবং ১৮ জন আহত হয়েছে। মিছিলকারীরা আইন ও শৃঙ্খলা কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের উপর হামলা চালিয়েছিল। ৪০ জন মিছিলকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং অধিকাংশকেই ঘটনাস্থলে গ্রেফতার করা হয়। বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।’ 

পত্রিকায় প্রকাশিত প্রেসনোট

এদিকে বাংলার বাণী জাসদের প্রেস বিজ্ঞপ্তি ছাপে। এতে বলা হয়, ১৭ মার্চের ঘটনায় পুলিশের লাঠিপেটা ও রক্ষীবাহিনীর গুলিবর্ষণে ওয়াপদার শ্রমিক মফিজউল্লাহসহ বহু মানুষ নিহত ও নিখোঁজ হয়েছেন। আর ৪৫ জন মহিলাসহ প্রায় ৩০০ নেতা–কর্মী আহত হয়েছেন। এ ঘটনায় মেজর জলিল, রব এবং মমতাজ বেগমসহ প্রায় ২৫০ জনকে গ্রেপ্তার হয়েছে বলে বিবৃতিতে দাবি করে জাসদ।

বিশ্লেষকেরা কী বলছেন 

মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ ‘জাসদের উত্থান ও পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি’ বইয়ের ১১১ পৃষ্ঠায় সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। সেখানে বলা হয়েছে: ‘আ স ম আবদুর রবের অভিজ্ঞতা ছিল এ রকম: আমাদের অনুমান ছিল মিছিলে পুলিশ বাধা দিতে পারে। তাই আমরা তিন ভাগ হয়ে তিনটি পথে যাই এবং পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনসুর আলীর বাসার সামনে জড়ো হই। চারদিকে স্লোগান চলছে। আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আমরা একটা স্মারকলিপি দেব। কিন্তু তিনি বাড়িতে ছিলেন না। ওই দিন তিনি কেরানীগঞ্জে একটা জনসভায় ছিলেন। কয়েকজনকে দেখলাম বাড়ির গেটে আগুন দিচ্ছে। লোহার গেট কী আগুনে গলে? হঠাৎ কোত্থেকে কয়েক ট্রাক পুলিশ আর রক্ষীবাহিনী এল। শুরু করল গুলি। জলিল ভাই, মমতাজ আর আমি একসঙ্গে ছিলাম। ইনু কমান্ড দিল, “সবাই শুয়ে পড়েন।” আমরা শুয়ে পড়লাম। বৃষ্টির মতো গুলি যাচ্ছে কানের পাশ দিয়ে, চুলের ভেতর দিয়ে। হঠাৎ দেখলাম, ইডেন কলেজের ছাত্রী মুকুল দেশাই গুলি খেয়ে পড়ে গেল। জাহাঙ্গীর আমার কাছেই ছিল। গুলি লেগে সঙ্গে সঙ্গেই মারা গেল।’

ওই রাতেই পুলিশ গণকণ্ঠ পত্রিকা অফিসে ঢুকে পত্রিকা প্রকাশের বিভিন্ন ম্যাটেরিয়াল নিয়ে যায়। পরদিন পত্রিকা প্রকাশ হয়নি। রাতেই গণকণ্ঠের সম্পাদক কবি আল মাহমুদকে আটক করে পুলিশ। পরের দিন আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে জাসদের বিরুদ্ধে মিছিল হয়। মিছিলকারীরা জাসদের অফিসে ব্যাপক ভাঙচুর করে আগুন দেয়।
ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত প্রেসনোট

প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিকের ভাষ্য

১৯৭৪ সালের মার্চে ‘গণকণ্ঠ’ পত্রিকার রিপোর্টার ছিলেন স্বপন দাসগুপ্ত। ১৭ মার্চ জাসদের অ্যাসাইনমেন্ট কাভার করতে চারজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাঁরা ছিলেন স্বপন দাসগুপ্ত, মোস্তফা জব্বার, সাঈদ তারেক এবং শাহ আলম (চিফ রিপোর্টার)। এর মধ্যে স্বপন দাসগুপ্ত ও শাহ আলম জনসভা কাভার করেছিলেন। আর মোস্তফা জব্বার (পরে শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভার মন্ত্রী) ও সাঈদ তারেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাও কাভার করতে মিছিলের সঙ্গে গিয়েছিলেন। 

বঙ্গবন্ধু রিপোর্টটি পড়ে ক্ষুব্ধ হয়ে মনি ভাইকে (বাংলার বাণীর সম্পাদক) গণভবনে ডেকে বলেছেন, ‘মণি, বাংলার বাণী তো আর বাংলার বাণী নাই, এটা গণকণ্ঠ (জাসদের পত্রিকা) হয়ে গেছে।’
মতিউর রহমান চৌধুরী, প্রধান সম্পাদক, মানবজমিন

স্বপন দাসগুপ্ত তাঁর ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিক্রমা ১৯৭২–১৯৭৫’ বইয়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন। বইয়ের ৮১ পৃষ্ঠায় তিনি লেখেন, ‘মিছিলের লক্ষ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর বাড়ির সামনে যাওয়া। মিছিলকারীরা সরকারবিরোধী ও ২৯ দফা বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকে। জাসদের সিদ্ধান্ত ছিল, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে একটি স্মারকলিপি দেওয়া। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সে সময়ে বাসায় ছিলেন না, তিনি কেরানীগঞ্জের এক জনসভায় ছিলেন। হঠাৎ মিছিলকারীদের মধ্যে কয়েকজন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসার গেটে আগুন লাগিয়ে দেয়, লোহার গেট, তাই আগুন ধরতে কিছুটা দেরি লাগছে। ঠিক এ সময়ে কয়েক ট্রাক পুলিশ ও রক্ষীবাহিনী এসে মিছিলকারীদের উপর গুলি চালায়। জনতা এদিক–ওদিক দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। এতে অনেকেই আহত হন।’

‘মানবজমিন’ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
ছবি: মতিউর রহমান চৌধুরীর সৌজন্যে

‘মানবজমিন’ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী। ১৯৭৪ সালে ছিলেন ২৩ বছরের তরুণ রিপোর্টার। কাজ করতেন ‘বাংলার বাণী’ পত্রিকায়। ৫১ বছরের আগের সেই ঘটনা সম্পর্কে মতিউর রহমান চৌধুরী প্রথম আলোকে জানান, ১৭ মার্চ জাসদের জনসভার অ্যাসাইনমেন্ট কাভারের দায়িত্ব ছিল বাংলার বাণীর হামিদুর রহমানের। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসার সামনে জাসদ–পুলিশের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে আহত হয়ে তাঁকে হাসপাতালে যেতে হয়। তাঁর ছিল নাইট ডিউটি। কিন্তু কৌতূহলবশত জনসভা ও ঘেরাও কর্মসূচি দেখতে মিন্টো রোডে যান। অন্যান্য পত্রিকার রিপোর্টারের মতো তিনিও সংঘর্ষ চলাকালে প্রাণ বাঁচাতে মাটিতে শুয়ে পড়েন। ওই ঘটনার ছবি পরদিন ‘মর্নিং নিউজ’ পত্রিকায় ছাপা হয়। পরে সন্ধ্যায় অফিসে যাওয়ার পর সিটি এডিটর রকিব সিদ্দিকী তাঁকে বলেন, তিনি যেহেতু প্রত্যক্ষদর্শী, তাই যা ঘটেছে তাই যেন হুবহু নিউজ আকারে লিখে দেন। পরদিন ছবিসহ রিপোর্টটি লিড নিউজ হিসেবে ছাপা হয়। ওই নিউজে ৪ জন নিহতের কথা বলা হয়। কিন্তু রিপোর্টে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়।

তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ৩ জন মারা যাওয়ার কথা স্বীকার করে। অন্যদিকে জাসদ দাবি করে, তাদের ৫০ জন মারা গেছেন। জাসদের অনেক নেতা–কর্মী আহত হলেও ৫–৬ জনের বেশি মারা যাননি বলে জানান সাংবাদিক মতিউর রহমান চৌধুরী। আর সাংবাদিক স্বপন দাসগুপ্তের মতে, সরকারকে চাপে ফেলতে জাসদ তাদের ৫০ নেতা–কর্মী মৃত্যুর দাবি করে।

জনাব মতিউর রহমান চৌধুরী জানান, ‘‘পরদিন ১৮ মার্চ অফিসে গেলে ম্যানেজিং এডিটর আনোয়ারুল ইসলাম ববি তাঁকে ডেকে হাতে একটি চিঠি ধরিয়ে দিয়ে বলেন, ‘ইউর সার্ভিস ইজ নো লঙ্গার রিকোয়ার্ড।’ অর্থাৎ আমার চাকরি চলে যায় ওই নিউজ লেখার কারণে। ববি ভাই আমাকে বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু রিপোর্টটি পড়ে ক্ষুব্ধ হয়ে মনি ভাইকে (বাংলার বাণীর সম্পাদক) গণভবনে ডেকে বলেছেন, ‘মণি, বাংলার বাণী তো আর বাংলার বাণী নাই, এটা গণকণ্ঠ (জাসদের পত্রিকা) হয়ে গেছে।’

বিনা অপরাধে চাকরি চলে যাওয়ায় ভীষণ মন খারাপ হয় মতিউর রহমান চৌধুরীর। তাই জাতীয় প্রেসক্লাবে গিয়ে সাংবাদিক নেতা ও রাজনীতিবিদ নির্মল সেনের সঙ্গে দেখা করে ঘটনা খুলে বলেন।

ডাকসুর সাবেক জিএস ড. মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে ঘটনাটি সম্পর্কে জানান, ১৯৭৪ সালে তিনি ঢাকা কলেজের ছাত্র ছিলেন। ১৭ মার্চ রোববার ছিল সরকারি ছুটি। জাসদের সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও পরীক্ষা কারণে পল্টনের জনসভায় যাওয়া হয়নি তাঁর। সেই দিনের ঘটনায় তাঁর দুই বন্ধু প্রাণ হারিয়েছিলেন। তাঁরা হলেন ঢাকা সিটি কলেজ জাসদ ছাত্রলীগ নেতা জাহাঙ্গীর ও বরিশালের বিএম কলেজের ছাত্র জাফর। তাঁদের দুজনের বাড়ি বরিশালের গৌরনদীতে।

১৯৭৪ সালের ১৮ মার্চ প্রকাশিত আজাদ পত্রিকায় সেই ঘটনার প্রতিবেদন

ঘটনার আরও বিবরণ

লেখক মহিউদ্দিন আহমদের ‘বেলা–অবেলা বাংলাদেশ ১৯৭২–৭৫’ বইয়ে ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চের ঘটনার আরও বিবরণ পাওয়া যায়। সেখানে লেখা আছে: ‘‘১৭ মার্চের ঘটনার একটি বিবরণ পাওয়া যায় বিডিআরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানের লেখায়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসার আশপাশে পুলিশ, এক কোম্পানি রক্ষীবাহিনী ও এক কোম্পানি বিডিআর অপেক্ষমাণ ছিল। এদের সম্মিলিত নেতৃত্বে ছিলেন ঢাকার ডিআইজি আব্দুর রকিব খন্দকার। তিনি জাসদ নেতাদের বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন যে আর অগ্রসর হওয়া বিপজ্জনক হবে। ঠিক তখনই জিপে করে রক্ষীবাহিনীর এক ‘তরুণ ও কাণ্ডজ্ঞানহীন লিডার’ এসে হাজির হলো এবং চিৎকার করে বলল, রক্ষীবাহিনী, তোমরা এখনো চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখছ কী? গুলি চালাও।’ বলেই তিনি নিজেই মেশিনগান হাতে নিয়ে বৃষ্টির মতো গুলি চালানো শুরু করলেন। গুলিতে বেশ কয়েকজন হতাহত হওয়ার পর জাসদ কর্মীরা রমনা মাঠের দেয়াল টপকে ওপাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল। খন্দকার ছিলেন মাঝামাঝি। তিনি মাটিতে শুয়ে প্রাণ বাঁচালেন।

গণভবন বাদ দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাও কর্মসূচি জাসদের রাজনীতির ‘ঐতিহাসিক ভুল’ ছিল। মূলত সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে দলের একটি অংশের নেতারা চাচ্ছিলেন ‘আন্ডারগ্রাউন্ডে’ চলে যেতে।
স্বপন দাসগুপ্ত, সাংবাদিক

ঘটনার পরপর মেজর জেনারেল খলিল পুলিশের আইজি নূরুল ইসলামের অফিসে যান। সেখানে রক্ষীবাহিনীর মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামান এবং ডিআইজি খন্দকার ও এসপি মাহবুবকেও ডেকে আনা হলো। কথাবার্তায় খুনখারাবির দায়িত্ব রক্ষীবাহিনীর ঘাড়েই পড়ল। পরদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অফিসে কনফারেন্স। তোফায়েল আহমেদসহ দু–একজন মন্ত্রী উপস্থিত। জাসদের এই বাড়াবাড়ির উত্তর কী দেওয়া যায়, তাই নিয়ে আলোচনা। জেনারেল খলিলের বর্ণনামতে: শুনেই এসেছি, ওই দিন দুপুরে আওয়ামী লীগের কর্মীরা বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে জাসদের অফিসটি তছনছ করে অগ্নিসংযোগ করবে। এ প্রসঙ্গে আলোচনার সময় ঢাকার ডিআইজি খন্দকার অনেকটা ভয়ে ভয়ে বললেন যে, পত্রিকার ফটোগ্রাফারদের সামনে এ রকম অগ্নিসংযোগ না করাই ভালো। এ কথায় অনেক তরুণ নেতা প্রতিবাদ করে উঠলেন। জাসদ যদি অবৈধভাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি আক্রমণ করতে পারে, তবে সেখানে নিয়মতান্ত্রিকতার প্রশ্ন ওঠে কেন? প্রয়োজন হলে তাদের অফিস জ্বালাতেই হবে; পত্রিকা যা–ই বলুক না কেন। খন্দকার চুপ করে গেলেন।’

গণকণ্ঠ ও জাসদ অফিসে হামলা

স্বপন দাসগুপ্ত প্রথম আলোকে জানান, ঢাকার প্রথম পরিকল্পিত শহর ওয়ারীর টিপু সুলতান রোডে ছিল জাসদের পত্রিকা গণকণ্ঠের অফিস। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাও কেন্দ্র করে ঢাকায় থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছিল। ওই রাতেই পুলিশ গণকণ্ঠ পত্রিকা অফিসে এসে পত্রিকা প্রকাশের বিভিন্ন ম্যাটেরিয়াল নিয়ে যায়। ফলে পরদিন পত্রিকা প্রকাশ হতে পারেনি। পুলিশ রাতেই গণকণ্ঠের সম্পাদক কবি আল মাহমুদকে আটক করে সূত্রাপুর থানায় নিয়ে যায়। পরের দিন আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে জাসদের বিরুদ্ধে মিছিল বের করে। মিছিলকারীরা জাসদের অফিস ব্যাপক ভাঙচুর করে ও আগুন দেয়। অফিসের নিচে রাখা সিরাজুল আলম খানের ইতালিয়ান ল্যামব্রেটা মোটরসাইকেল আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়।

ইত্তেফাক পত্রিকায় ১৯৭৪ সালের ১৮ মার্চ প্রকাশিত প্রতিবেদন

মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক

‘রমনা গণহত্যার’ ঘটনায় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ৩ জন মারা যাওয়ার কথা স্বীকার করে। অন্যদিকে জাসদ দাবি করে, তাদের ৫০ জন নেতা–কর্মী মারা গেছেন। জাসদের অনেক নেতা–কর্মী আহত হলেও ৫–৬ জনের বেশি মারা যাননি বলে জানান সাংবাদিক মতিউর রহমান চৌধুরী। আর সাংবাদিক স্বপন দাসগুপ্ত জানান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও কর্মসূচিতে সর্বোচ্চ ছয়জন মারা যেতে পারে, এর বেশি নয়। তাঁর মতে, সরকারকে চাপে ফেলতে জাসদ তাদের ৫০ জন নেতা–কর্মী মৃত্যুর দাবি করে।

‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ রাজনীতিতে জাসদ

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাওয়ের ঘটনা নিয়ে ড. নজরুল ইসলাম ‘আগামী দিনের বাংলাদেশ ও জাসদের রাজনীতি’ বইয়ে উল্লেখ করেন। ৪১ পৃষ্ঠায় তিনি লেখেন, ১৯৭৪ সালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন আক্রমণ–উদ্ভূত ঘটনাবলির পর জাসদ এক অর্থে আত্মগোপনে চলে যায় এবং সামরিক অভ্যুত্থানের লক্ষ্যে সামরিক বাহিনীর ভেতরে এবং বাইরে গণবাহিনী গড়ে তোলায় মনোনিবেশ করে।

আজাদ পত্রিকায় ১৮ মার্চ জাসদের বক্তব্য প্রকাশিত হয়

এ বিষয়ে সাংবাদিক স্বপন দাসগুপ্ত বলেন, গণভবন বাদ দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাও কর্মসূচি জাসদের রাজনীতির ‘ঐতিহাসিক ভুল’ ছিল। মূলত সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে দলের একটি অংশের নেতারা চাচ্ছিলেন ‘আন্ডারগ্রাউন্ডে’ চলে যেতে। এরই অংশ হিসেবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও করে একটি টালমাটাল পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করা হয়। স্বপন দাসগুপ্ত আরও জানান, ১৭ মার্চের ঘটনার পর পার্টির নির্দেশে শাজাহান সিরাজ একটি তদন্ত রিপোর্ট জমা দেন; যেখানে তিনি উল্লেখ করেন, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাড়ি ঘেরাও কর্মসূচি জাসদের ‘ভুল সিদ্ধান্ত’ ছিল।’    

ঘটনার পরে জাসদের অনেক নেতা–কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বহু নেতা–কর্মীকে আটক করে। অনেকে আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যান। যেই পুলিশ ও রক্ষীবাহিনী গুলি চালিয়েছিল তাদের কাউকেই বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি। অন্যদিকে ‘হুলিয়া জারির’ ফলে প্রাণ নিয়ে আত্মগোপনে চলে যেতে হয় ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার ‘স্বপ্নদ্রষ্টা’ সিরাজুল আলম খানের রাজনৈতিক অনুসারীদের।