মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সাত সদস্যের প্রায় ৩৩ কোটি টাকা মূল্যের জমির খোঁজ পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এ ছাড়া চক্রের গ্রেপ্তার হওয়া ১৩ সদস্যের মোট ১৩৫টি ব্যাংক হিসাবে
৬৫ কোটি টাকা জমা পড়ার তথ্যও এসেছে সিআইডির হাতে। এর মধ্যে ৬৪ কোটি টাকা তাঁরা ইতিমধ্যে তুলেও নিয়েছেন।
সিআইডি বলছে, ২০০৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১৩ বছরে মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করেই চক্রের সদস্যরা বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। বেশি সম্পদ গড়েছেন চক্রের দুই হোতা স্বাস্থ্যশিক্ষা ব্যুরোর মেশিনম্যান আবদুস সালাম খান ও তাঁর খালাতো ভাই জসিম উদ্দিন ভূঁইয়া ওরফে মুন্নু।
শুধু সালাম-জসিম নন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের এই চক্রের অন্তত আট সদস্যের নিজেদের মধ্যে আত্মীয়তা রয়েছে। জসিমের স্ত্রী শারমিন আরা জেসমিন, জসিমের বড় বোন শাহজাদি আক্তার ওরফে মিরা, দুই ভগ্নিপতি আলমগীর হোসেন ও জাকির হোসেন, জসিমের ভায়রা সামিউল জাফর ওরফে সেটু এবং ভাতিজা এম এইচ পারভেজ খান চক্রের সদস্য। এর মধ্যে শাহজাদি ছাড়া বাকিরা কারাগারে রয়েছেন। শাহজাদির বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ, তিনি ফাঁস করা প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে মেডিকেলে ভর্তি হন। ইতিমধ্যে তিনি এমবিবিএস পাস করেছেন।
সিআইডি জানিয়েছে, এই আটজন ও জসিমের নাবালক সন্তানদের নামে মোট সাড়ে ৪২ একর জমির ৭৪টি দলিল পাওয়া গেছে। এসব জমির দাম প্রায় ৩৩ কোটি টাকা।
জসিমের বাড়ি মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরের খানবাড়িয়ায়। জসিম ও তাঁর চক্রের ছয় সদস্যের জমির বেশির ভাগই ২০০৬ সালের পর কেনা। কিছু কিছু জমি তাঁরা আত্মীয়ের নামে কিনে পরে নিজেদের নামে করে নেন। সিআইডি সূত্র জানায়, মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলা সাবরেজিস্ট্রি অফিস থেকে জসিম ও তাঁর স্ত্রীর প্রায় ৩২ একর এবং জসিমের মা জহুরা ভূঁইয়ার নামে ২ একর ৯ শতাংশ জমির দলিল পাওয়া গেছে।
আত্মীয়স্বজন মিলে ১৩ সদস্যের চক্র। তাঁদের ৩৩ কোটি টাকার জমি, কারখানা ও বাড়ি-গাড়ি পেয়েছে সিআইডি। গ্রেপ্তার ১৩, জামিনে ১ জন। দোষ স্বীকার ৪ জনের।
সালামের নামে মানিকগঞ্জে প্রায় সাড়ে ৩ একর এবং তাঁর স্ত্রী নাসরিন আক্তারের নামে সিঙ্গাইরে পৌনে ১৩ শতাংশ, আলমগীর হোসেনের নামে ৬১ শতাংশ, এম এইচ পারভেজ খানের নামে ১০ শতাংশ জমির দলিল পাওয়া যায়। সিআইডি আরও জানিয়েছে, জসিমের মিরপুর-১ নম্বর সেকশনের এইচ ব্লকের ১ নম্বর সড়কে দুটি বাড়ি, দুটি গাড়ি ও একটি মোটরসাইকেল রয়েছে। রাজধানীতে দুটি পোশাক কারখানারও মালিক জসিম।
প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের গ্রেপ্তার হওয়া ১৩ সদস্যের ১৩৫টি ব্যাংক হিসাব পাওয়া গেছে। এর মধ্যে জসিমের ৩৩, তাঁর স্ত্রী শারমিন আরার ১৩, জসিমের বোন শাহজাদির ৪, জাকির হোসেনের ৮, আলমগীরের ৪, পারভেজ খানের ৫ এবং সালাম খানের ১টি ব্যাংক হিসাবে বিপুল অর্থ লেনদেন হয়েছে। মোট ১৩৫টি ব্যাংক হিসাবে ৬৫ কোটি টাকা জমা করা হয়। প্রায় ৬৪ কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়। এর মধ্যে জসিমের ব্যাংক হিসাবে প্রায় ৪২ কোটি, মুহাম্মদ ময়েজ উদ্দিন আহমেদ প্রধানের (চক্রের সদস্য) ব্যাংক হিসাবে প্রায় ৩৭ কোটি এবং শারমিন ও সালামের ব্যাংক হিসাবে প্রায় ৬ কোটি টাকা করে লেনদেন হয়।
প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্র সম্পর্কে অনুসন্ধান করছেন সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার জুয়েল চাকমা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, চক্রের অপরাধলব্ধ অর্থ ও সম্পদের অনুসন্ধান শেষ হয়েছে। এখন তাঁদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করার কাজ চলছে।
সিআইডি ২০১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনার তদন্তের সূত্র ধরে মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজের প্রশ্নপত্র ফাঁসের তথ্য পায়। এরপর গত বছরের জুলাইয়ে মিরপুর থেকে জসিমসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। তাঁদের তথ্যের ভিত্তিতে পরে সালামকে গ্রেপ্তার করা হয়।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় ১৪ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ১৫০ থেকে ২০০ সদস্যের বিরুদ্ধে পাবলিক পরীক্ষা আইনে মিরপুর থানায় মামলা করা হয়েছিল। সিআইডি জানিয়েছে, চক্রের মোট ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে জসিম, সালামসহ চারজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট সিআইডির একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, সালামের নেতৃত্বে জসিম প্রথমে পরিবারের সাত সদস্যকে নিয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্র গড়ে তোলেন। এই চক্রের সারা দেশে লোক আছে। মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের (সিপিসি) বিশেষ পুলিশ সুপার এস এম আশরাফুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, চক্রের যাঁরা এখনো ধরা পড়েননি, তাঁদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।