১০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্থিরতা, সাতটিরই কারণ ছাত্রলীগ
দেশের আটটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও দুটি সরকারি কলেজে বর্তমানে যে অস্থিরতা চলছে, এর মধ্যে সাতটির কারণ হচ্ছে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক দ্বন্দ্ব ও প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা। ছাত্রলীগের এসব কর্মকাণ্ডে সম্প্রতি সিলেটে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুরের হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ এবং যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা চলছে। এর মধ্যে কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ ছিল। এর ফলে বাড়ছে সেশন জটের আশঙ্কা।
ছাত্রলীগের দ্বন্দ্বসহ বিভিন্ন কারণে গত ছয় বছরে অন্তত ৫০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সময়ে অনির্ধারিতভাবে বন্ধ করতে হয়েছে। এসব ঘটনায় শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই অন্তত ১৫ জন খুন হয়েছেন। নিজেদের স্বার্থ নিয়ে সরকার-সমর্থক শিক্ষকদের নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলনের কারণে অচলাবস্থা চলছে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্রলীগের সাংগঠনিক দ্বন্দ্বসহ বিভিন্ন ঘটনায় সবচেয়ে বেশি বন্ধ ছিল কুষ্টিয়ায় অবস্থিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়টি সাড়ে পাঁচ মাস অনির্ধারিতভাবে বন্ধ ছিল। এর মধ্যে বাস দুর্ঘটনায় এক ছাত্রের নিহত হওয়ার ঘটনায় সৃষ্ট পরিস্থিতিতে গত রোববার আবার অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয় বিশ্ববিদ্যালয়টি। এতে সেখানে সেশনজট দীর্ঘ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
প্রথম আলোসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্ন ঘটনায় গত ছয় বছরে বিভিন্ন সময়ে বন্ধ রাখা বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী প্রথম আলোকে বলেন, গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক অস্থিরতায় ক্লাস ও পরীক্ষা পিছিয়ে অন্তত ছয় মাসের সেশনজটের সৃষ্টি হয়। সংঘাত-সংঘর্ষে এখন সেশনজট আরও বাড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এসব ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এই অশান্ত পরিস্থিতিতে তাঁরা ক্ষুব্ধ, হতাশ ও উদ্বিগ্ন। তবে শিক্ষার পরিবেশ স্বাভাবিক রাখার জন্য যা যা করা দরকার, তাই করবেন। এ জন্য তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে সাহসী ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান তিনি।
গত ২০ নভেম্বর সিলেটে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ক্ষমতাসীন ছাত্রলীগের দুই উপদলের মধ্যে সংঘর্ষে একজন ছাত্র নিহত হওয়ার ঘটনায় অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। অথচ এখন প্রায় সব বিভাগের সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল। এর আগে ২০১৩ সালের ১২ মে ছাত্রলীগের দুই উপদলের সংঘর্ষে গ্রীষ্মকালীন ছুটি এক সপ্তাহ এগিয়ে আনা হয়। নাম প্রকাশ না করে একজন শিক্ষার্থী প্রথম আলোকে বলেন, এখানে বর্তমানে প্রায় ছয় মাসের সেশনজট আছে। এখন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধে আরও কয়েক মাস পিছিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ ও শিবিরের সংঘর্ষে দুজন মারা যাওয়াসহ কয়েকটি ঘটনায় ৭৩ দিন বন্ধ ছিল। সর্বশেষ ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কোন্দলে গত ৯ ও ১০ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস-পরীক্ষা হয়নি। এখানে ছাত্রলীগের কোন্দল এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। এই উত্তেজনার রেশ কাটতে না কাটতেই একটি ছাত্রাবাসের নিয়ন্ত্রণ নিতে সংগঠনটির তিনটি পক্ষের তৎপরতায় আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠছে ক্যাম্পাস। এর আগে ২০১২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগ ও শিবিরের সংঘর্ষে দুজন মারা যাওয়ার ঘটনায় ৫৮ দিন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ছিল।
ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত ১০ মাসেই ৫২ দিন ক্লাস-পরীক্ষা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাপঞ্জি অনুযায়ী সরকারি ও অন্যান্য ছুটি বাদ দিয়ে গত ১০ মাসে ১৯০ দিন ক্লাস-পরীক্ষা হওয়ার কথা থাকলেও হয়েছে মাত্র ১৩৮ দিন। এ কারণে এ বছর দুটি সেমিস্টার শেষ হওয়ার কথা থাকলেও মাত্র একটি শেষ হয়েছে। সর্বশেষ ময়মনসিংহ শহরের ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের মহড়ার প্রতিবাদে সাধারণ শিক্ষার্থীরা গত ১৮ ও ১৯ নভেম্বর ক্লাস বর্জন করেন। এর আগে গত ১ এপ্রিল ছাত্রলীগের এক অংশের হাতে মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী ও একই সংগঠনের নেতা সায়াদ ইবনে মোমতাজ নিহত হওয়ার ঘটনায় ২৩ দিন ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ ছিল।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক শফিউল ইসলামকে হত্যার ঘটনায় ১৫ নভেম্বর থেকে অস্থিরতা চলছে। এর আগে গত ২ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্ধিত ফি ও সান্ধ্যকোর্স চালুর প্রতিবাদে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় পুলিশ ও ছাত্রলীগ। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ৩ মার্চ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে। এতে টানা ৩৫ দিন বন্ধ থাকে। এ বছরের ৪ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলে নিজকক্ষে খুন হন হল ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রস্তম আলী আকন্দ। এর পর দুই দিন ক্যাম্পাসে ধর্মঘট পালন করে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ।
পূর্ব ঘটনার জের ধরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ২৩ নভেম্বর ছাত্রলীগের এক পক্ষের ওপর আরেক পক্ষের কর্মীরা হামলা চালান। এ ঘটনায় গুরুতর আহত এক ছাত্রের বাবা ছাত্রলীগের ১৩ জনের নামসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। এ নিয়ে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক দ্বন্দ্ব আবার মাথাচাড়া দিল।
নকলের দায়ে ছাত্রলীগের দুই নেতাকে বহিষ্কারের প্রতিবাদে ও উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে দিনাজপুরের হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে গত মাসে ধর্মঘট পালন করেছে ছাত্রলীগ। ফলে ব্যাহত হয় স্বাভাবিক কার্যক্রম। এ নিয়ে এখনো সেখানে উত্তেজনা বিরাজ করছে। দিনাজপুর মেডিকেল কলেজে ছাত্রলীগের পাল্টাপাল্টি কমিটি নিয়ে গত ১৮ নভেম্বর সংঘর্ষ হয়। এখানে তিন মাস রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
পদোন্নতির সুবিধার দাবিতে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ২৭ অক্টোবর থেকে অচলাবস্থা চলছে। সরকার-সমর্থক শিক্ষকেরাই এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আন্দোলনকারী শিক্ষকেরা গত ৯ নভেম্বর সব ধরনের প্রশাসনিক পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। পাশাপাশি তাঁরা উপাচার্য এ কে এম নূর উন নবীকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছেন। এর আগে উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ২০১২ সালে প্রায় ৮০ দিন ক্লাস-পরীক্ষা হয়নি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে গত ১১ নভেম্বর ছাত্রলীগের সঙ্গে শিবিরের সংঘর্ষ হয়। এছাড়া কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের কর্মীরা নিজেরাও মারামারি করেছেন। এ কারণে কলেজটিতে উত্তেজনা চলছে।
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আইনানুযায়ী সেখানে রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকলেও ছাত্রলীগ কমিটি গঠন করে। এ নিয়ে গত জুলাই মাসে ছাত্রলীগের এক কর্মী খুন হন। এ ঘটনায় কয়েক দিন ছাত্রলীগ সভাপতি সুব্রত বিশ্বাসকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ কারণে সেখানে চাপা উত্তেজনা চলছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, প্রথম কথা হলো, সব না হলেও অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ্য লোকদের উপাচার্য না করার কারণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। আর ছাত্রলীগ এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের ওপর তারা ছড়ি ঘোরাচ্ছে, টাকা কামাচ্ছে। শিক্ষার স্বার্থে যেকোনোভাবেই হোক, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কারণ, এসব কারণে সেশনজটে পড়ে সবচেয়ে ক্ষতির মুখে পড়ছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম আলোর প্রতিনিধি ও এসব এলাকার প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক )