সরকারের চোখে 'জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী', বন্ধ সামহোয়ারইন ব্লগ
‘জাতীয় স্বার্থ’ পরিপন্থী কর্মকাণ্ডের জন্য বাংলা ভাষার প্রথম কমিউনিটি ব্লগ সামহোয়ারইন ব্লগ বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। অশ্লীলতা ও জুয়ার বিরুদ্ধে চলমান অভিযানের মধ্যেই ব্লগটি বন্ধ করে তারা। ব্লগের লেখকেরা বলেছেন, অসত্য তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন নেতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করায় সচেতন লেখক ও নাগরিক হিসেবে তাঁরা হতবাক।
অশ্লীলতা ও জুয়ার ওয়েবসাইট বন্ধে করতে ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে বা আইআইজিগুলোকে ১৭ ফেব্রুয়ারি একটি তালিকা পাঠায় বিটিআরসি। সেই তালিকাতে সামহোয়ারইন ব্লগের নাম ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। ঠিক কী কারণে ব্লগটিকে ব্লক করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, সে নিয়ে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) ও পুলিশের সাইবার অপরাধ দমন বিভাগ কেউ পরিষ্কারভাবে কিছু বলছে না।
বিটিআরসির জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক মো. জাকির হোসেন খাঁন প্রথম আলোকে বলেন, ‘জাতীয় স্বার্থপরিপন্থী কর্মকাণ্ড করার দায়ে ব্লগটি ব্লক করে দেওয়ার নির্দেশনা আসে। তার ভিত্তিতেই টেকনিক্যাল বডি হিসেবে বিটিআরসি তার কাজ করেছে।’ ব্লগটি জাতীয় স্বার্থ পরিপন্থী কী করেছে, জানতে চাইলে তিনি বিস্তারিত কোনো ব্যাখ্যা দেননি। কার নির্দেশে বন্ধ করা হয়েছে জানতে চাইলে বলেন, জাতীয় স্বার্থ যাঁরা দেখে থাকেন তাঁদের নির্দেশে ব্লক করা হয়েছে।
তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ও পুলিশের সাইবার অপরাধ দমন বিভাগের সঙ্গে আলাদা আলাদাভাবে যোগাযোগ করা হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, ব্লগটি বন্ধের বিষয়ে তাঁরা কিছু জানেন না। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা শেফায়েত হোসেন বলেন, অনেকেই এ বিষয়ে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। তিনি এ বিষয়ে ঠিক জানেন না। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বার্সেলোনায় আছেন। ফিরে এলে হয়তো বলা সম্ভব হবে।
এ দিকে সামহোয়ারইন ব্লগ বন্ধের প্রতিবাদে ব্লগের ৩৩ লেখক একটি বিবৃতি দিয়েছেন। তাঁরা বলেন, ব্লগটি বন্ধের হঠকারী সিদ্ধান্তে তাঁরা স্তম্ভিত, মর্মাহত ও উদ্বিগ্ন বোধ করছেন। তাঁরা আরও বলেন, সামহোয়ারইন ব্লগের অবদানকে যেখানে স্বীকৃতি ও মূল্যায়ন জানানো দরকার, সেখানে বিআরটিসি কেন এবং কোন উৎস থেকে তথ্য পেয়ে এই প্ল্যাটফর্মটিকে অশ্লীল হিসেবে চিহ্নিত করেছে, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। এই সিদ্ধান্তের পেছনে কারও ব্যক্তিগত ক্ষোভ বা আক্রোশ কাজ করছে কি না, তা–ও উন্মোচন হওয়া জরুরি। নইলে ভবিষ্যতে সামহোয়ারইন ব্লগের মতো আরও প্ল্যাটফর্ম—যারা দেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ এবং জ্ঞান ও যুক্তির চর্চাকে সমুন্নত রাখতে চায়, তারা কালোতালিকাভুক্ত হয়ে ক্ষতির মুখে পড়তে পারে।
বিবৃতিদাতারা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফাহমিদুল হক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল মামুন, লেখক রাখাল রাহা, গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার, আদিবাসী–বিষয়ক লেখক ও ব্লগার কুঙ্গ থাঙ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের লেখক ও প্রভাষক শারমিন রেজোওয়ানা প্রমুখ।
বাংলা ভাষার প্রথম কমিউনিটি ব্লগ হিসেবে ২০০৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে যাত্রা শুরু করে সামহোয়ারইন ব্লগ। ব্লগটি মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনাকে ধারণ করে। যাত্রা শুরুর পর থেকে সে সময়কার মন্ত্রিসভায় চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের অবস্থানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর পোস্ট প্রকাশ করত। এমনকি সেনা–সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও নিয়মিত সাহসী পোস্ট লিখেছেন ব্লগের লেখকেরা। এরই ধারাবাহিকতায় দেশে অনলাইন অ্যাকটিভিজমের সূচনা হয়। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের মঞ্চ হিসেবে ব্লগটি বিবেচিত হতো। বাংলা ভাষাকে ইন্টারনেটে জনপ্রিয় করায় এই মঞ্চের অবদান রয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত আছেন এক লাখের বেশি লেখক ও পাঠক।
এদিকে কন্টেন্ট বা ওয়েবসাইট ব্লক করার কাজ কোনো এনটিএমসি এর নাকি বিটিআরসির সেটি পরিষ্কার নয় বলে জানিয়েছেন সাইবার অপরাধ দমনে যুক্ত একজন পুলিশ কর্মকর্তা। নাম না প্রকাশ করার শর্তে তিনি বলেন, অনুসন্ধান বা তদন্ত করার এখতিয়ার পুলিশের। পুলিশ তদন্ত করে বলে দেবে কোনটা ব্লক করা যাবে আর কোনটা যাবে না। এটা না মেনে অন্য কেউ এখতিয়ারের বাইরে ব্লক করতে গেলে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি এবং তা আইনসিদ্ধ হবে না। অনেক সময় তা প্রমাণ নষ্ট করার মতো অপরাধও বটে। তাই পুলিশকে না জানিয়ে কোনো কিছুই ব্লক করা যাবে না।