ভুয়া কাগজে সংরক্ষিত বনের জমি বিক্রি

>

• ময়মনসিংহের ভালুকা
• সংরক্ষিত বনের প্রায় ২০ কোটি টাকা দামের জমি ভুয়া নামে বেচাকেনা করা হয়েছে বলে অভিযোগ
• নামজারির আবেদন করতে গেলে জালিয়াতির তথ্য বেরিয়ে আসে

ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে সিরাজুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি ময়মনসিংহের ভালুকায় সংরক্ষিত বনের ১১ একর জমি রবিন টেক্সটাইলস লিমিটেড নামে এক প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। বাস্তবে ওই ব্যক্তির কোনো অস্তিত্ব না থাকলেও ভালুকার তৎকালীন সাবরেজিস্ট্রার শাহ কামাল মোল্লা জমি নিবন্ধন করে দিয়েছেন। জমির নামজারির আবেদন করতে গেলে জালিয়াতির এই তথ্য বেরিয়ে আসে।

জমি নিবন্ধনের এ জালিয়াতির বিষয়ে ময়মনসিংহের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) এ কে এম গালিভ খান তদন্ত করেছেন। তদন্তে সাবরেজিস্ট্রারকে দোষী সাব্যস্ত করে বলা হয়েছে, বিধিবহির্ভূতভাবে দলিল তৈরির মাধ্যমে সরকারের অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ বেহাত করতে সহায়তা করেছেন। এতে তাঁর কর্তব্যে অবহেলা, উদাসীনতা ও দায়িত্বহীনতার সত্যতা পাওয়া গেছে। গত ৬ সেপ্টেম্বর তদন্ত প্রতিবেদনটি জমা দেওয়া হয়। পরে ১৯ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক মো. সহিদুল্ল্যাহ স্বাক্ষরিত এক পত্রে পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়কে লোকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।

বন বিভাগ ও তদন্ত–সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ময়মনসিংহের শিল্পাঞ্চল বলে পরিচিত ভালুকা উপজেলার হবিরবাড়ি মৌজার বন বিভাগের গেজেটভুক্ত ১১ একর জমিতে সিরাজুল ইসলামের কোনো দখল ছিল না। জমি বিক্রির সময় তাঁর দখলের সমর্থনে কোনো তথ্য উপস্থাপন করতে পারেননি। গত বছরের ২৩ এপ্রিল সিরাজুল ইসলাম ও রবিন টেক্সটাইলের পক্ষে রবিন রাজন সাখাওয়াতের নামে দলিলটি করেন। জমির বর্তমান বাজারমূল্য আনুমানিক ২০ কোটি টাকা।

ময়মনসিংহের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) এ কে এম গালিভ খান প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার পর থেকে সিরাজুল ইসলাম উধাও। পুরো ঘটনায় তৎকালীন সাবরেজিস্ট্রার শাহ কামাল মোল্লার বিরুদ্ধে আনা অনিয়মের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। তবে রবিন টেক্সের মালিক রবিন রাজন সাখাওয়াৎ ভুয়া কাগজপত্রের এই দলিল দিয়ে জমি কেন কিনেছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এ ব্যাপারে রবিন রাজনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।

এদিকে সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সাবরেজিস্ট্রারকে কোটি টাকা দিয়ে এই দলিল নিবন্ধন করে নামজারির পর এই চক্রের ব্যাংকঋণ নেওয়ার কথা ছিল। এ জন্যই তারা নাম খারিজের আবেদন করে। তদন্ত–সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, জালিয়াতি করে সিরাজুল ইসলামের নামে দলিলটি তৈরি করা হয় নান্দাইল ভূমি কার্যালয় থেকে। সংখ্যালঘু এক ব্যক্তির কাছ থেকে জমিটি কেনা হয়। দলিল সম্পাদনের তারিখ উল্লেখ করা হয় ১৯৭০ সালের ৩০ এপ্রিল। এদিকে ১৯৭০ সালের কোনো একসময় নান্দাইল সাবরেজিস্ট্রি অফিসের সব নথি আগুনে পুড়ে যায়। তাই এ–সংক্রান্ত কাগজপত্র আর এখন কেউ দেখাতে পারছেন না।

তদন্ত কমিটি সূত্রে জানা গেছে, শাহ জামাল মোল্লা তদন্ত কমিটিকে বলেছেন, দলিল আটকে রেখে তদন্ত করার ক্ষমতা তাঁর নেই। এ ছাড়া ময়মনসিংহের বিভাগীয় বন কর্মকর্তার অনাপত্তি দলিলের পরচা, নামজারি, সার্ভেয়ারের প্রত্যয়ন, সহকারী কমিশনার (ভূমির) প্রত্যয়নপত্র উপস্থাপনের পর দলিল নিবন্ধনের পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি আছে বলেই তিনি দলিল নিবন্ধন করেছেন।

বন বিভাগ সূত্র জানায়, ভালুকার এ জমির মালিক বন বিভাগ। এ জমির যৌথ জরিপে দখলদারের তালিকায় সিরাজুল ইসলাম নামে কোনো ব্যক্তির অস্তিত্ব নেই। এ বিষয়ে ভালুকা বন বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা তাহের আলী বলেন, ‘এখানে স্পষ্টই বোঝা যায়, সাবরেজিস্ট্রার কাগজপত্রের সত্যতা যাচাই না করে ইচ্ছাকৃতভাবে দলিল রেজিস্ট্রি করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে আমরা মামলা করব।’

বন বিভাগের দাবি, হবিরবাড়ি মৌজায় ১৫৪ দাগের মোট ২৯৪ একর ভূমির মধ্যে ২০১ দশমিক ৫০ একর জমিকে সংরক্ষিত বন ঘোষণা করা হয়েছে। সিরাজুল ইসলাম তৎকালীন বন বিভাগীয় কর্মকর্তা মঈনুদ্দীন খান স্বাক্ষরিত একটি পত্র দেখান যেখানে লেখা ছিল, এই ১১ একর জমির ওপর বন বিভাগের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু তদন্তে দেখা যায়, বন বিভাগের কার্যালয় থেকে এ ধরনের কোনো চিঠি ইস্যু করা হয়নি। ওই স্মারকে অন্য চিঠি ইস্যু করা হয়েছে। জালিয়াতি করে তৈরি করা চিঠি যাচাই না করেই ভালুকার সাবেক সাবরেজিস্ট্রার দখল রেজিস্ট্রি করে দেন।

ভালুকা উপজেলার তৎকালীন সাবরেজিস্ট্রার শাহ কামাল মোল্লা বলেন, প্রভাবশালী মহল এ বিষয়ে চাপ প্রয়োগ করার ফলে দলিল রেজিস্ট্রি করতে বাধ্য হন তিনি। তবে তিনি কারও নাম বলতে চাননি।