মানিকগঞ্জে বিভিন্ন গণপরিবহন থেকে বছরে ১০ কোটি টাকার বেশি চাঁদা তোলা হয়। জেলা পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের ব্যানারে এই চাঁদা ওঠানো হয়। ক্ষমতাসীন দলের নেতারাই এসব সমিতির নিয়ন্ত্রক। গণপরিবহন থেকে চাঁদাবাজি বন্ধে পুলিশ বা হাইওয়ে পুলিশের তৎপরতা দেখা যায় না। উল্টো বাসমালিকদের অভিযোগ, পুলিশ ভাগ নেওয়ায় তাঁদের চাঁদা বেশি দিতে হচ্ছে।
বাসমালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মানিকগঞ্জের ৭০০ যাত্রীবাহী বাস থেকে প্রতিদিন গড়ে ৩০০ টাকা চাঁদা নেওয়া হচ্ছে। বছর শেষে বাসে চাঁদার অঙ্ক দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ৭ কোটি টাকা। আর জেলায় আড়াই হাজারের বেশি তিন চাকার সিএনজি ও অটোরিকশা থেকে চাঁদা আসে প্রায় আড়াই কোটি টাকা। এ ছাড়া দেড় শতাধিক ছোট মিনিবাস, মাইক্রো ও ভাড়ায় চালিত সেডান গাড়ি থেকেও চাঁদা নেওয়া হয় প্রায় ৭০ লাখ টাকা।
পুলিশ, বাসমালিক, স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পরিবহন মালিক সমিতির নেতা ও পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলামের লোকেরা চাঁদা তোলার সঙ্গে জড়িত। জাহিদুল নিজেকে জেলা বাস-মিনিবাস-মাইক্রোবাস-অটো টেম্পো ওনার্স গ্রুপের সভাপতি হিসেবে দাবি করেন। তাঁর সঙ্গে জেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি ও জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আবদুল জলিলও আছেন।
জেলা পুলিশ সুপার রিফাত রহমান প্রথম আলোকে বলছেন, অভিযোগ ছাড়া চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। ইতিমধ্যে তাঁরা বেশ কয়েকটি অভিযোগ পেয়েছেন এবং এসব অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা হয়েছে। কমিউনিটি পুলিশের নামে কোনো চাঁদা নেওয়ার সুযোগ নেই জানিয়ে পুলিশ সুপার বলেন, ‘কেউ চাঁদা নিলে আমরা ব্যবস্থা নেব।’
শুভযাত্রা পরিবহন নামে মানিকগঞ্জ থেকে ঢাকার গুলিস্তান পর্যন্ত ৮০টি বাস চলাচল করে। শুভযাত্রা পরিবহনে বেশ কয়েকজন মালিকের বাস রয়েছে। এমনই একজন মালিক জানালেন, আয়ের অধিকাংশ অর্থই চাঁদা দিতে চলে যায়। প্রতিদিন বাসপ্রতি তাঁকে মানিকগঞ্জে ৭০০ টাকা ও গুলিস্তানে ৬০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে তাঁদের কাছ থেকে ৭০০ টাকা নিলেও ১৩০ টাকা নেওয়ার রসিদ দেওয়া হয়।
গোলডা হাইওয়ে থানার ওসি মনিরুল ইসলাম বলেন, তাঁরা পথেঘাটে চাঁদাবাজি বন্ধ করেছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো পরিবহন থেকে চাঁদা নেওয়ার কোনো অভিযোগ নেই।
মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডসংলগ্ন পৌর আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে আলাপকালে জাহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, জেলা বাস-মিনিবাস-মাইক্রোবাস-অটোটেম্পো ওনার্স গ্রুপের সভাপতি তিনি। তিন বছর আগে তিনি পরিবহন মালিক সমিতির দায়িত্ব নেওয়ার পর চাঁদাবাজ হটিয়ে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছেন। তাহলে চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠছে কেন—প্রশ্নের জবাবে জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘হয়তো কোনো কোনো পরিবহনমালিকের রুট পারমিট ঠিকমতো নেই। এ জন্য নানা জায়গায় টাকা দেন। কিন্তু বলার বেলা মালিক সমিতির নাম বলেন।’
জেলা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আবদুল জলিল দাবি করেন, তাঁরা শ্রমিকদের কল্যাণের উদ্দেশ্যে এই টাকা নেন। শ্রমিক কল্যাণটি কীভাবে করছেন—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ড্রাইভাররা অসুস্থ হয়, কারও মেয়ের বিয়ে হলে এই টাকা দেওয়া হয়। এ ছাড়া অফিস খরচ ও স্টাফ আছে, এসব কাজে টাকা লাগে।’
চাঁদা তোলায় ভিন্ন পন্থা পাটুরিয়ায়
পাটুরিয়া বাস টার্মিনালে চাঁদা তোলা হয় ভিন্ন কৌশলে। এখানকার পরিবহন খাত নিয়ন্ত্রণ করেন শিবালয় সদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আলাল উদ্দিন ও স্থানীয় পরিবহন ব্যবসায়ী জসিম উদ্দিন।
কয়েকজন বাসচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গত ফেব্রুয়ারি মাসে পাটুরিয়ায় পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে জেলা মালিক সমিতির সভাপতি জাহিদুল ইসলাম ও জেলা শ্রমিক লীগের সাবেক সভাপতি বাবুল সরকারের সমর্থকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব হয়। এরপর থেকে শ্রমিক ও মালিক সংগঠনের নামে পাটুরিয়া বাস টার্মিনাল থেকে প্রকাশ্যে চাঁদা নেওয়া বন্ধ আছে। তবে চাঁদা নেওয়া হচ্ছে ভিন্ন কৌশলে।
কৌশলটা কী? জানতে চাইলে পরিবহনশ্রমিকেরা বলেন, প্রতিটি কোম্পানির বাস কাউন্টারে ২ থেকে ৩ জন করে সুপারভাইজার থাকেন। তাঁরা তাঁদের নিজ নিজ কোম্পানির বাস থেকে চাঁদা তোলেন।
শিবালয় সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলাল উদ্দিন জেলা মালিক সমিতিরও সদস্য। তিনি অবশ্য পরিবহন খাত নিয়ন্ত্রণের কথা অস্বীকার করে বলেন, তাঁর নূরে কাবা পরিবহনের পাঁচটি বাস আছে। এর বাইরে পরিবহন খাত নিয়ে চিন্তা করার সময় তাঁর নেই।
পাটুরিয়া বাসস্ট্যান্ডে চাঁদা তোলার বিষয়ে শিবালয় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফিরোজ কবির বলেন, সুপারভাইজারদের মাধ্যমে গোপনে চাঁদা ওঠানোর বিষয়টি তাঁর জানা নেই।
ছোট পরিবহনে বড় চাঁদাবাজি
জেলায় চলাচল করা তিন চাকার ছোট যানবাহনগুলোর সংখ্যা কত, তার সঠিক হিসাব নেই। তবে কয়েকজন সিএনজিচালক বলেন, জেলার সাত উপজেলায় অন্তত ৭০০ সিএনজির রুট পারমিট আছে।
মানিকগঞ্জ শহরে ৫০০ থেকে ৬০০টি তিন চাকার পরিবহন থেকে পরিবহন মালিক সমিতির ব্যানারে চাঁদা তোলা হয়। জেলা পরিবহন মালিক সমিতি এখানেও নিয়ন্ত্রণ করে।
সমিতির সভাপতি জাহিদুল অবশ্য দাবি করেছেন, তাঁরা প্রতি অটোরিকশা থেকে ২০ টাকা ও সিএনজি থেকে ৩০ টাকা নেন। এর মধ্যে মানিকগঞ্জ পৌরসভাকে অটোরিকশাপ্রতি ১০ টাকা ও সিএনজি থেকে ২০ টাকা দেওয়া হয়।
মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডের পাশে জয়রা সড়কে কথা হয় একজন সিএনজিচালকের সঙ্গে। তিনি জয়রা-তিল্লি-কলিয়া সড়কে সিএনজি চালান। বললেন, প্রতিদিন তাঁকে মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে ৪০ টাকা দিতে হয়। এর বাইরে মাসোহারা হিসেবে ৩০০ টাকা দিতে হয়।
মানিকগঞ্জ পৌরসভার প্রধান নির্বাহী প্রকৌশলী বিল্লাল হোসেন বলেন, পৌরসভা শুধু যাত্রীবাহী বাসের জন্য বাস টার্মিনাল ইজারা দিয়েছে। অটোরিকশা বা সিএনজি থেকে পার্কিং চার্জ নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড থেকে সাভারের নবীনগর ও মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড থেকে ঘিওরের বানিয়াজুরী পর্যন্ত হাইওয়ে মিনি পরিবহনের নামে ৪০টি ছোট মিনিবাস চলাচল করে। এদের রুট পারমিট নেই। এই বাসের কয়েকজন মালিক বলেন, তাঁরা পরিবহন মালিক সমিতিকে চাঁদা দিয়ে গাড়ি রাস্তায় নামিয়েছেন। প্রতি বাসের জন্য প্রতিদিন ৪০০ টাকা দিতে হচ্ছে।
পরিবহন মালিক সমিতির নেতা জাহিদুলের ছোট ভাই মাহিদুল ইসলাম ভাড়ায় চালিত মাইক্রোবাস ও প্রাইভেট কারগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি জেলা রেন্ট-এ-কার মালিক সমিতির সভাপতি। মাসে গড়ে এক হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয় তাঁদের।