ফেসবুকে অনবরত ছবি পোস্ট করে হয়রানির শিকার হয় মেয়েরা
ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত না করে ইন্টারনেট ব্যবহার করায় মেয়েরা সহজেই সাইবার বুলিং ও হয়রানির শিকার হয়।
রাজধানীর নামকরা একটি স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ে মেয়েটি। একদিন জানতে পারে, তার ছবি দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। সেই অ্যাকাউন্ট থেকে আজেবাজে ছবি ও স্ট্যাটাস দেওয়া হচ্ছে। বন্ধুদের সহায়তায় ফেসবুক কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করে ভুয়া অ্যাকাউন্টি বন্ধ করা সম্ভব হয়। তবে যারা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত ছিল, তারা থেমে থাকেনি। মেয়েটির ফেসবুক আইডির মেসেঞ্জারে যৌন হয়রানিমূলক বার্তা ও ভিডিও পাঠানো শুরু করে। মেয়েটি এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী।
প্রথম আলোর কাছে সেই অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ওই তরুণী বলেন, প্রায় ছয় মাস এমন মানসিক যন্ত্রণায় ভোগার পর পরিবারকে বিষয়টি জানান। বকা খাবেন এবং ইন্টারনেট ব্যবহার বন্ধ হয়ে যাবে, এই ভয়ে পরিবারকে বলার সাহস পেতেন না। বয়স কম থাকায় ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা বা আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি নিয়ে তাঁর কোনো ধারণাও ছিল না।
সরকারের তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগের নতুন এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত না করে দায়িত্বহীনভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করার কারণে মেয়েরা খুব সহজে সাইবার বুলিং ও হয়রানির শিকার হয়। কম বয়সী মেয়েরা সাধারণত ফেসবুকে অনবরত তাদের ছবি পোস্ট করতে থাকে এবং সহজেই হয়রানির শিকার হয়। ইন্টারনেট ও ডিভাইসের সহজলভ্যতার কারণে গ্রামের চেয়ে শহরে সাইবার হয়রানির ঘটনা ঘটছে দ্বিগুণ। যৌন হয়রানিমূলক ভিডিও, বার্তা ও ছবির মাধ্যমে গ্রামে ৩৩ শতাংশ এবং শহরের ৬৪ শতাংশ মেয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছে। সাইবার হয়রানির ওপর এটি আইসিটি বিভাগের প্রথম গবেষণা।
‘সাইবার বুলিং অ্যাগেইনস্ট গার্লস অ্যান্ড উইমেন ওভার সোশ্যাল মিডিয়া’ শিরোনামে আইসিটি বিভাগের হয়ে করোনাকালের আগে জরিপটি পরিচালনা করে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব আইসিটি ইন ডেভেলপমেন্ট (বিআইআইডি)। শহর ও গ্রামের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ৫৮৪ জন শিক্ষার্থীর ওপর জরিপটি করা হয়। এর পাশাপাশি ছয়টি ফোকাসড গ্রুপে আলোচনা করা হয় ও মূল তথ্যদাতা হিসেবে ১২ জন শিক্ষক, গবেষক, অভিভাবক ও আইনজীবীর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। মৌলভীবাজার ও মানিকগঞ্জে মেয়েদের দুটি স্কুল, রাজধানীর নামকরা একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল, সরকারি ও বেসরকারি দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গবেষণাটিতে অংশ নেন।
তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ইন্টারেনেটের ব্যবহার গ্রামের চেয়ে শহরে বেশি বলে ডিজিটাল স্পেসে বুলিং ও হয়রানির ঘটনা শহরে বেশি ঘটছে। এ ছাড়া গ্রামে নানা ধরনের শারীরিক কর্মকাণ্ড রয়েছে। শহরের ছেলেমেয়েদের কাছে বিকল্প কিছু নেই। প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, সাইবার বুলিং ও হয়রানির বিষয়টি মাথায় রেখে সরকার ব্যক্তিসচেতনতা এবং পারিবারিক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিশু–কিশোর–কিশোরীদের নৈতিক মূল্যবোধ ও সচেতনতা সৃষ্টি এবং এ–সম্পর্কিত আইনি ব্যবস্থা সম্পর্কে প্রচারে পদক্ষেপ নিয়েছে। ডিজিটাল লিটারেসি সেন্টার ও মুক্তপাঠ অনলাইন শিক্ষার মাধ্যমে সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে সচেতনতা বাড়ানো হচ্ছে, কোর্স করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। দুর্বার প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে এলাকাভিত্তিক সাইবার সিকিউরিটি অ্যাম্বেসডর হিসেবে শিশু–কিশোরদের নিযুক্ত করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) হিসাব অনুসারে, এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১১ কোটি ২৭ লাখ ১৫ হাজার। এর মধ্যে মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০ কোটি ৩১ লাখ ৯৩ হাজার। বাকিটা ব্রডব্যান্ড সংযোগ।
ঘটনা শুরু হয় ‘হাই, হ্যালো’ দিয়ে
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘটনাগুলো শুরু হয় ‘হাই, হ্যালো’ দিয়ে। এরপর ধীরে ধীরে ফোন নম্বর, ছবি চাওয়া হয় এবং সামনাসামনি দেখা করতে বলে। একটা সময় তারা দেখা করার জন্য রীতিমতো চাপাচাপি শুরু করে। মেসেঞ্জারে অনেক পুরুষ আপত্তিকর ছবি পাঠাতে শুরু করে এবং সেই সঙ্গে নোংরা মন্তব্য ও কৌতুক পাঠাতে থাকে। জবাব না পাওয়া পর্যন্ত ওই ব্যক্তিরা সেসব পাঠাতেই থাকে।
গবেষক দলে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক তানিয়া হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সাইবার বুলিং ও হয়রানি বন্ধ করতে সরকারের এখন ব্যাপকভাবে প্রচার বাড়ানো দরকার। বিটিভিসহ বিভিন্ন বেসরকারি চ্যানেল ও রেডিওর প্রধান খবর প্রচারের সময়কে টার্গেট করে প্রচারের উদ্যোগ নিতে পারে সরকার। খবর শুরুর আগের সময়ে সাইবার সচেতনতাবিষয়ক বিজ্ঞাপন প্রচার করা যেতে পারে। এ ছাড়া এ–সম্পর্কিত যেসব আইন রয়েছে, সেগুলোতে ভুক্তভোগীর আইনি সুরক্ষা ও অপরাধীদের জন্য কী ধরনের সাজা রয়েছে, তা প্রচার করতে হবে।
শহরে ১৩ বছর বয়সের আগেই হাতে ফোন
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে শহরের ৮৮ শতাংশ ল্যাপটপ বা মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করে এবং গ্রামে এ হার ৪৮ শতাংশ। গ্রামের বেশির ভাগ মেয়ের নিজের স্মার্টফোন নেই। অভিভাবকের ফোন ব্যবহার করে অল্প সময়ের জন্য ইন্টারনেট ব্যবহার করার সুযোগ পায়। এত অল্প সময়ে ফেসবুক ছাড়া অন্য কোনো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে প্রবেশের সুযোগ পায় না। অন্যদিকে শহরের মেয়েরা ১৩ বছর বয়সের আগেই নিজের স্মার্টফোন পাচ্ছে এবং বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে প্রবেশের সুযোগ পাচ্ছে।
জরিপ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান বিআইআইডির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শহীদ উদ্দিন আকবর তাঁর অভিজ্ঞতাকে ভয়াবহ বলে উল্লেখ করেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে দেখা গেছে, তারা কেউই সাইবার হয়রানি নিয়ে অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলতে চায় না। ভয় পায়। তাদের মধ্যে ডিজিটাল জগৎ নিয়ে অসচেতনতা অনেক। এর প্রভাব কতটা গভীর, সে সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। খুব সহজেই তারা ফাঁদে পড়ে যায়। তিনি ঢাকার বাইরের একটি স্কুলের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, সচেতনতামূলক কার্যক্রম শেষে এক কিশোরী এসে জানায়, সে সবার সামনে বলতে পারেনি। তার বড় বোন সাইবার হয়রানির শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছিল।
মেয়েদের ক্ষেত্রে প্রেমঘটিত প্রতারণার ফাঁদে পড়ার ঘটনা বেশি ঘটে বলে জানিয়েছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের শিশু–কিশোর ও পারিবারিক মনোরোগবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, করোনাকালে অনেক অভিভাবক তাঁর সন্তানদের নিয়ে চিকিৎসা করাতে এসেছিলেন, যারা প্রতারণার শিকার হয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল। তিনি ছেলেমেয়েদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, কোনো ধরনের প্রলোভনে পড়া যাবে না। নিজেকে সংবরণ করতে হবে। কোনো ঝামেলার ঝুঁকি তৈরি হলে বা পড়ে গেলে পরিবারের কাছে সহায়তা চাইতে হবে। প্রয়োজনে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে, মানসিক রোগের চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। নিজের ভেতর গ্লানিবোধ রাখা যাবে না।