পুলিশের রেকারের ভয়ে তটস্থ অটোরিকশাচালকেরা
রাস্তায় বিকল হওয়া গাড়ি ও অবৈধ পার্কিংয়ে রাখা গাড়ি সরানো হচ্ছে রেকারের কাজ। কিন্তু নারায়ণগঞ্জ পুলিশ রেকার ব্যবহারের ‘নিজস্ব পন্থা’ বের করেছে। এর মাধ্যমে স্বল্প আয়ের ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাচালকদের চাপে রাখা হয়। এমনকি রেকারে না তুলেই আদায় করা হয় রেকারের বিল। পুলিশের পাশাপাশি ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতারাও রেকারের ভয় দেখিয়ে চাঁদা তোলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
আঞ্চলিক সড়কে অটোরিকশা চালানোর জন্যও রেকারের ভয় দেখিয়ে জরিমানা আদায় করা হয়। সম্প্রতি প্রথম আলো ১৫ জন অটোচালকের সঙ্গে কথা বলেছে। তাঁদের সবাই প্রায় একই ধরনের অভিযোগ করেছেন।
রেকার বিল দাবি করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত ২২ ফেব্রুয়ারি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাচালক জুম্মন মিয়া ক্ষোভে-হতাশায় ধারালো ছুরি নিজের পেটে ঢুকিয়ে দেন। তাঁর দাবি, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সিদ্ধিরগঞ্জ থেকে অটোরিকশাসহ তাঁকে আটকের পর আড়াই হাজার টাকা জরিমানা করে নারায়ণগঞ্জ ট্রাফিক পুলিশ।
জুম্মন এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তরুণ জুম্মনের স্ত্রী সন্তানসম্ভবা, প্রসবের সময় ঘনিয়ে এসেছে। করোনায় পোশাক কারখানার কাজ হারিয়ে কয়েক মাস ধরে অটোরিকশা চালাচ্ছিলেন জুম্মন। তাঁর আত্মহত্যা চেষ্টার ঘটনার পর রেকার দিয়ে পুলিশের ভয়ভীতি দেখানোর বিষয়টি সামনে আসে।
ওই ঘটনার পর সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে রেকার ব্যবহারের এই চিত্র পাওয়া গেল। যদিও আত্মহত্যাচেষ্টার ঘটনার পর থেকে পুলিশ বেশ সতর্ক।
মহাসড়কের সানারপাড় এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চালান মোহাম্মদ সুজন। তাঁর দাবি, গত ছয় মাসে তাঁকে সাত থেকে আটবার আটকানো হয়েছে। সর্বশেষ ১০ দিন আগেও কাঁচপুর সেতুর কাছে শিমরাইলে একটি অস্থায়ী ডাম্পিং স্টেশনে (রাস্তার পাশে ফাঁকা স্থান) তাঁর অটোরিকশা নিয়ে রাখা হয়। তবে রেকারে তুলে নয়, নিয়ে যাওয়া হয় অটোরিকশাটি চালিয়ে। কিন্তু তাঁকে জরিমানা করা হয়েছে রেকারের বিল হিসেবে। সুজন বলেন, ‘(পুলিশ) রেকারে তোলে না। রেকার আসেও না। কিন্তু রেকারের বিল রাখে।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রিকশা গ্যারেজের একজন মালিক বলেন, তাঁদের রিকশাগুলোকে যাতে রেকার বিল না করা হয়, সে জন্য মৌখিক চুক্তি অনুযায়ী নিজেরাই মাসে কিছু টাকা পুলিশকে দেন তাঁরা।
শিমরাইলের সেই অস্থায়ী ডাম্পিং স্টেশনে আগে প্রতিদিন ৩০–৪০টি অটোরিকশা তুলে আনা হতো বলে জানান সেখানকার ব্যবসায়ীরা। যদিও সে এলাকায় কাজ করা ট্রাফিক পুলিশের উপসহকারী পরিদর্শক (এটিএসআই) রাশেদুল ইসলাম জানান, তাঁরা প্রতিদিন গড়ে ৮–১০টি রিকশাকে জরিমানা করেন। সব ক্ষেত্রেই রেকারের বিল আদায় করে ছেড়ে দেওয়া হয়।
নারায়ণগঞ্জ পুলিশ বলছে, অটোরিকশাকে জরিমানা করার বিকল্প কোনো আইন না থাকায় জরিমানা করার ‘নিজস্ব পন্থা’ বেছে নিয়েছেন তাঁরা।
রেকার ব্যবহার না করেও রেকারের বিল ধরা কতটা যৌক্তিক—জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘এটা আইনের অপপ্রয়োগ না। তাদের চাপে রাখার জন্য মূলত এটা করা হয়।’
একই প্রশ্নের উত্তরে নারায়ণগঞ্জের সহকারী পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) সালেহ উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা চাপ প্রয়োগ করার জন্য করা হয়। এদের আটক করে ব্যবস্থা নেওয়ার আর কোনো আইনি পথ নাই। ডাম্পিং করব সে পথও নাই।’
নারায়ণগঞ্জ পুলিশ ব্যবহার করে মোট ৮টি রেকার। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কয়েকটি স্থানের পাশাপাশি সেগুলো রাখা হয়েছে বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক সড়কেও। স্থানগুলো হচ্ছে পঞ্চবটি, সাইনবোর্ড, তারাবো, ভুলতা, শিমরাইল, রূপগঞ্জের কাঞ্চন, চাষাঢ়া ও শিবু মার্কেট।
এসব রেকারের দুটি পুলিশের, বাকি ছয়টি ব্যক্তিমালিকানাধীন। রেকারভেদে মালিককে মাসে ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়। এ টাকার মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত থাকে চালক ও চালকের সহকারীর বেতন, তেল খরচ, রক্ষণাবেক্ষণ খরচসহ সবকিছু। বাকিটা জমা হয় পুলিশের কল্যাণ তহবিলে।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড মোড় থেকে নারায়ণগঞ্জ শহরের জেলা পরিষদ পর্যন্ত রাস্তায় চলাচলকারী প্রতিটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার উইন্ডশিল্ডে একটি করে স্টিকার দেখা গেল। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা প্রতি মাসে ৮০০ টাকার বিনিময়ে এ স্টিকার দেন। ১০ জন অটোরিকশা চালকের সঙ্গে প্রথম আলোর এই প্রতিনিধিদ্বয়ের কথা হয়। তাঁরা অভিযোগ করেন, এ চাঁদা আদায় করেন ফতুল্লার কুতুবপুর ১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. আলমগীর হোসেন। এমনকি চাঁদা না দিলে অটোরিকশা পুলিশের রেকারে তুলে দেওয়া হয়।
সাইনবোর্ড মোড়েই আলমগীর হোসেনের একটি কার্যালয় আছে। অফিসের সামনে তাঁর ছবিসংবলিত একটি ব্যানারও রয়েছে। চাঁদাবাজির অভিযোগে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) গত বছরের শুরুর দিকে কার্যালয়টি বন্ধ করে দেয়। তবে আওয়ামী লীগ নেতার কার্যালয় বন্ধ থাকলেও থেমে নেই কাজ।
অভিযান পরিচালনকারী র্যাব–১১–এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জসিম উদ্দিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, প্রকাশ্যেই চাঁদাবাজি করতেন আলমগীর। সে জন্য তাঁর বিরুদ্ধে মামলাও করে র্যাব।
গত ২৫ ফেব্রুয়ারি দুপুরে আলমগীরের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয় প্রথম আলোর। চাঁদাবাজির অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি জানান, মূলত সেবার মানসিকতা থেকে শ্রমিক কল্যাণ তহবিলের জন্য ‘অল্প কিছু চাঁদা’ সংগ্রহ করতেন, যানজট নিয়ন্ত্রণের জন্য। পরে ‘ভুল বুঝতে পেরে’ ছেড়ে দিয়েছেন। এর বেশি কিছু বলতে রাজি হননি তিনি। তবে অটোরিকশাচালকদের অভিযোগ, রেকারে তোলার ভয় দেখিয়ে স্টিকার দেওয়ার নামে এখনো চাঁদা তুলছেন আওয়ামী লীগ নেতা আলমগীর হোসেন।
সাইনবোর্ড মোড় থেকে নারায়ণগঞ্জ শহরের জেলা পরিষদ পর্যন্ত সড়কে প্রায় চার বছর ধরে অটোরিকশা চালান নুরুদ্দিন মিয়া (ছদ্মনাম)। জরিমানা হিসেবে রেকারের বিল দিয়েছেন তিনবার। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘কমিটি (আলমগীরের লোকজন) থেকে ফোন করে ৫ তারিখ পর্যন্ত সময় দেয়। (চাঁদা) না দিলে ট্রাফিককে ফোন করে রেকারে তুলে দেন।’
এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম বলেন, ‘এমন ঘটনা জানা নেই। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। এমন কিছু ঘটলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এ ছাড়া অতিরিক্ত জরিমানা করার অভিযোগও রয়েছে পুলিশের বিরুদ্ধে। জরিমানার সর্বোচ্চ ফি সাধারণত ১ হাজার ৫০০ টাকা। তবে জরিমানা কত হবে, তা নির্ভর করে গাড়ির আকার ও দূরত্বের (যান বিকল হওয়া স্থান থেকে ডাম্পিং জোন পর্যন্ত) ওপর, বললেন নারায়ণগঞ্জের ট্রাফিক পরিদর্শক (প্রশাসন) কামরুল ইসলাম বেগ।
তবে চালকদের কেউ কেউ ২ হাজার, ২ হাজার ২০০ টাকাও রেকারের বিল দিয়েছেন। সাইনবোর্ড মোড়–নারায়ণগঞ্জ জেলা পরিষদ সড়কে মোহাম্মদ ফরিদ অটোরিকশা চালাচ্ছেন ৬ বছর ধরে। জরিমানা হিসেবে রেকার বিল দিয়েছেন পাঁচবার। প্রথমবার দিয়েছেন ২ হাজার টাকা। এরপর ১ হাজার টাকা করে।
এ বিষয়ে সহকারী পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এমনটা হয় না তা নয়, হতেও পারে।’ তবে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ পাননি বলে জানান তিনি।
অটোরিকশাচালকদের অভিযোগ, রেকারের বিল করে পুলিশ কোনো রসিদ দেয় না। মহাসড়কের সানারপাড় এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চালান মোহাম্মদ সুজন। তিনি জানান, প্রথমবার ২ হাজার ২০০ টাকা জরিমানা নিয়ে তাঁকে রসিদ দেওয়া হয়। এরপর তাঁর কাছ থেকে চার–পাঁচবার দেড় হাজার টাকা করে রেকার বিল রাখা হয়েছে। কিন্তু কোনো রসিদ দেওয়া হয়নি।
এ বিষয়ে পুলিশ সুপার জায়েদুল জানান, এমন অভিযোগ তাঁরা পাননি। পেলে ব্যবস্থা নেবেন।
জরিমানার পুরো টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা না দেওয়ারও অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ প্রসঙ্গে জায়েদুল আলম বলেন, ‘এমনটা হওয়ার সুযোগই নেই। রসিদ হলে তাঁকে কোষাগারে টাকা জমা দিতেই হবে।’
নারায়ণগঞ্জ পুলিশ বলছে, প্রতি মাসে জরিমানা হিসেবে গড়ে প্রায় ১০ থেকে ১১ লাখ টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়া হয়। এর একটি বড় অংশ আসে অটোরিকশার রেকার বিলের জরিমানা থেকে।