ঘরের প্রতিশ্রুতি দিয়ে কোটি টাকার ঘুষ গ্রহণ
সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার মাধাইনগর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও সদস্যরা আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় ঘর নির্মাণ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ১ হাজার ১০০ জনের কাছ থেকে প্রায় দেড় কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছেন। অথচ ওই ইউনিয়নে এ ধরনের প্রকল্পের কোনো বরাদ্দই নেই।
ঘর পাওয়ার আশায় দরিদ্র লোকজন ১২ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত সুদে ঋণ করে জনপ্রতিনিধিদের কাছে ওই টাকা দিয়েছেন। টাকা দেওয়ার পর এক বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। কিন্তু এখনো ঘর তৈরির কোনো খবর নেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাধাইনগর ইউপির চেয়ারম্যান মো. আবু হাসান মির্জা সংবাদ প্রকাশ না করার জন্য অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘আমি আপনাদের সঙ্গে বসব। লেখালেখি করলে প্রকল্পটি হবে না।’
ঘর পাওয়ার আশায় ঘুষ দেওয়া ব্যক্তি ও স্থানীয় অন্য লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইউনিয়নের প্রতিটি ওয়ার্ড থেকে ১০০ জনের তালিকা করে তাঁদের কাছ থেকে ‘যার জমি আছে ঘর নাই, তার নিজ জমিতে গৃহনির্মাণ’ প্রকল্পের (আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প) ঘর দেওয়ার কথা বলে টাকা নেওয়া হয়েছে। এভাবে নয়টি ওয়ার্ড ও তিনটি সংরক্ষিত ওয়ার্ডের ১ হাজার ১০০ জনের কাছ থেকে প্রায় দেড় কোটি টাকা নেওয়া হয়েছে। ইউপি চেয়ারম্যান আবু হাসান মির্জা ও ১২ জন ইউপি সদস্য মিলে এক বছর আগে এলাকায় প্রচার চালান, সরকার ‘জমি আছে ঘর নাই’ প্রকল্পের আওতায় দরিদ্র মানুষদের বিনা টাকায় ঘর করে দেবে। তাঁরা তাড়াশ উপজেলার মাগুরা বিনোদ ইউনিয়ন ও পার্শ্ববর্তী রায়গঞ্জ উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নে এর আগে বাস্তবায়ন করা এই প্রকল্পের উদাহরণ তুলে ধরেন। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। তাঁরা প্রতিটি ওয়ার্ড থেকে ১০০ জন করে তালিকা তৈরি করেন। এরপর তাঁদের কাছ থেকে এই অর্থ আদায় করা হয়। হতদরিদ্র এসব মানুষ ঘর পাওয়ার আশায় দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঋণ নেন। এরপর দীর্ঘ এক বছরের বেশি সময় চলে গেলেও তাঁরা ঘর পাননি। চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যরা প্রকল্প পাস হচ্ছে বলে আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছেন। চেয়ারম্যানকেও প্রায়ই ঢাকায় যেতে দেখা যাচ্ছে ‘প্রকল্পের তদবির’ করতে।
সরাপপুর গ্রামের কৃষিশ্রমিক দেলবার হোসেন বলেন, তাঁর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য হায়দার আলীকে ঘরের জন্য এক বছর আগে ১৫ হাজার টাকা দিয়েছেন। কিন্তু আজও সেই ঘর পাননি। একই কথা জানালেন তারা মণ্ডল, আবদুল হামিদ মণ্ডলসহ ১৭ জন ভুক্তভোগী।
পাশের মাধাইনগর গ্রামের ভূমিহীন কৃষিশ্রমিক সঞ্চনা সিং, বিমল সিং, নব কুমার বসাক, গোপেন্দ্রনাথ বসাক, বিপুল বসাক, পলাশ ওঁরাওসহ প্রায় ৪০ জন ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর লোকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরা কেউ ১৫ হাজার, কেউ ২০ হাজার টাকা করে দিয়েছেন। দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে ইউপি সদস্য আবদুল মান্নান ও মহিলা সদস্য বুলবুলি খাতুনকে ওই টাকা দিয়েছেন তাঁরা।
ইউপি সদস্য আবদুল মান্নান, হায়দার আলী ও বুলবুলি খাতুন টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘শুধু আমরা নই, সব সদস্যই টাকা তুলেছেন এবং তাঁরা সমুদয় টাকা চেয়ারম্যান মো. আবু হাসান মির্জাকে দিয়েছেন প্রকল্পের জন্য।’
তাড়াশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো. ওবায়দুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, মাধাইনগর ইউনিয়নে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এ ধরনের প্রকল্পের কোনো অস্তিত্ব নেই। সেখানে সাধারণ মানুষের সঙ্গে এ ধরনের প্রতারণার বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।