সরকারি হিসাবেই প্রতিবছর ছোট-বড় মিলিয়ে শতাধিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে রাসায়নিকের গুদামে ঠাসা পুরান ঢাকায়। এর মধ্যে নিমতলী ও চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহত হন নারী-শিশুসহ ১৯৪ জন। ওই দুটি ঘটনার পর সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, পুরান ঢাকায় আর অতি দাহ্য রাসায়নিকের গুদাম ও কারখানা থাকবে না। কিন্তু এখনো নানা কায়দায় পুরান ঢাকায় দাহ্য রাসায়নিকের ব্যবসা চলছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণা বলছে, নিয়ম লঙ্ঘন করে পুরান ঢাকায় রাসায়নিকের ব্যবসা চালিয়ে নিতে ৩০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ আড়াই লাখ টাকা ঘুষ লেনদেন হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে অনলাইনে সংবাদ সম্মেলন করে গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে তারা। এতে পুরান ঢাকার অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিতে সুশাসনের চ্যালেঞ্জের বিষয়টি উঠে এসেছে। একই সঙ্গে অতি দাহ্য রাসায়নিকের গুদাম এখনো না সরায় নিমতলী বা চুড়িহাট্টার মতো ঘটনা পুরান ঢাকায় ভবিষ্যতেও ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছে টিআইবি।
গবেষণায় বলা হয়েছে, রাসায়নিকের গুদাম ও কারখানা স্থাপনে লাইসেন্স প্রদান বা নবায়ন বন্ধ থাকলেও অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে এবং রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে লাইসেন্স বের করার প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের অসাধু কর্মকর্তাদের পরামর্শে ব্যবসায়ীরা তাঁদের প্রতিষ্ঠানের নাম থেকে রাসায়নিক শব্দটি বাদ দিয়ে এন্টারপ্রাইজ হিসেবে ট্রেড লাইসেন্স বের করে নিচ্ছে। লাইসেন্স বের করা কঠিন হয়ে পড়লে রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাব ব্যবহার করা হচ্ছে। আবার রাসায়নিক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত না হয়েও কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতা নিজেদের নামে লাইসেন্স করে তা ব্যবসায়ীদের প্রদান করে থাকে।
টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাসায়নিকের ব্যবসায় অনাপত্তিপত্র, লাইসেন্স, ছাড়পত্র নেওয়া বা নবায়নের ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তরকে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা, বিস্ফোরক পরিদপ্তরকে দেড় থেকে আড়াই লাখ টাকা, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরকে ৩ থেকে ১২ হাজার টাকা এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে ১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকা নিয়মবহির্ভূতভাবে দিতে হয়। এ ছাড়া অ্যাসিডের লাইসেন্স বের করা কঠিন বলে অ্যাসিড আমদানিতে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো হয়, রাসায়নিক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত না হয়েও কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতা নিজেদের নামে লাইসেন্স করে ব্যবসায়ীদের কাছে বিনিময়ে বিক্রি করে দেওয়ার ঘটনাও আছে বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে।
পুরান ঢাকায় রাসায়নিকের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে টিআইবি ঘুষ লেনদেনের যে কথা বলেছে, এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউমারি মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা এনায়েত হোসেন, পুরান ঢাকায় অতি দাহ্য বা দাহ্য পদার্থের (শর্ত সাপেক্ষে আমদানিযোগ্য) কোনো কারখানা বা গুদাম নেই, তাই লাইসেন্স নবায়নের প্রশ্নও আসে না। টিআইবির দাবির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে তিনি বলেন, ব্যবসার জন্য তাঁদের ঘুষ দিতে হয় না।
এনায়েত হোসেন আরও বলেন, ‘আমরা পুরান ঢাকা থেকে ব্যবসা সরিয়ে নিতে চাই। সরকার কথা অনুযায়ী জমির ব্যবস্থা করে দিলে আমরা চলে যাব, প্রয়োজনে সরকারকে আগাম টাকা দিতেও রাজি।’
যাদের কাগজপত্রে ঘাটতি আছে বা লাইসেন্সে সমস্যা আছে, মূলত তারাই নিয়মবহির্ভূতভাবে অতিরিক্ত টাকা দেন।টিআইবির ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার মোস্তফা কামাল
এ বিষয়ে গবেষণায় যুক্ত থাকা টিআইবির ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার মোস্তফা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, যাদের কাগজপত্রে ঘাটতি আছে বা লাইসেন্সে সমস্যা আছে, মূলত তারাই নিয়মবহির্ভূতভাবে অতিরিক্ত টাকা দেন।
টিআইবির গবেষণার বিষয়ে বিস্ফোরক পরিদপ্তরের প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক মঞ্জুরুল হাফিজের মুঠোফোনে গত রাতে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাড়া দেননি। পরে খুদে বার্তা পাঠানো হলেও জবাব দেননি তিনি। তবে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ কে এম রফিক আহাম্মদ বলেন, টিআইবির প্রতিবেদন এখনো তিনি পাননি। কোন সময়ের তথ্যের ভিত্তিতে তারা এই অভিযোগ করছে তা–ও তাঁর জানা নেই। এখন ছাড়পত্র ও নবায়ন দুটোই বন্ধ।
দাহ্য পদার্থ গুদামে নেওয়ার সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গাড়িপ্রতি ৩০০ টাকা করে নেন বলে গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মো. ওয়ালিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের অভিযোগ পাননি তাঁরা। টিআইবি আনুষ্ঠানিকভাবে জানালে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পুরান ঢাকায় রাসায়নিকের প্রায় ১৫ হাজার গুদাম আছে। এমন গুদামের কারণেই ২০১০ সালের ৩ জুন রাতে নিমতলীতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে ১২৪ জন এবং গত বছর ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে ৭০ জন নিহত হন। নিমতলীতে অগ্নিকাণ্ডের পর সরকারের গঠন করা উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি আবাসিক এলাকা থেকে গুদাম ও কারখানা সরিয়ে নেওয়াসহ ১৭টি সুপারিশ করেছিল, যার বেশির ভাগই বাস্তবায়িত হয়নি।
ভবিষ্যতে দুর্ঘটনা এড়াতে ১০টি সুপারিশ করেছে টিআইবি। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রাসায়নিক নিরাপত্তা বিষয়ে নির্দেশিকা তৈরি ও নীতিমালা প্রণয়ন, ঝুঁকিপূর্ণ ও অবৈধ কারখানা চিহ্নিত করে তা বন্ধ করা অথবা অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপ হিসেবে স্বল্পমেয়াদি সময় দিয়ে স্থানান্তরের ব্যবস্থা, পুরান ঢাকার অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোতে অগ্নিনির্বাপণ ও জরুরি বহির্গমন ব্যবস্থা তৈরি করা, রাসায়নিকের গুদাম ও কারখানা প্রতিষ্ঠার লাইসেন্স প্রক্রিয়া বাধ্যতামূলক ও স্বচ্ছ করা।
গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নিমতলী ও চুড়িহাট্টার ঘটনাকে বিক্ষিপ্ত ঘটনা হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। এটি সুশাসনের ঘাটতির একটি প্রকট দৃষ্টান্ত। এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধে দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ ও প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতা রয়েছে। পরিষ্কারভাবেই তারা তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানেই বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে ও হচ্ছে।