গাড়িচালক তাজুলের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের একটি মামলার বিচারকাজ চলছে। আরেকটি মামলার তদন্ত চলছে।
১৯৮৯ সালে দুই হাজার টাকা বেতনে চট্টগ্রাম ওয়াসায় চালকের সহকারী (হেলপার) হয়ে চাকরি শুরু করেছিলেন মো. তাজুল ইসলাম। সহকারী থেকে হয়েছেন গাড়িচালক। ধাপে ধাপে বেড়ে তাঁর বেতন হয়েছে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। কিন্তু বেতন যে হারে বেড়েছে, তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি বেড়েছে সম্পত্তি।
চট্টগ্রাম নগরের পশ্চিম শহীদনগর এলাকায় তাঁর রয়েছে কোটি টাকা মূল্যের পাঁচতলা বাড়ি। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে তাজুল ইসলামের এই সম্পদের হিসাব উঠে এসেছে।
তাজুল ইসলাম হচ্ছেন চট্টগ্রাম ওয়াসা শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক। ১২ বছর ধরেই তিনি এই পদে আছেন। পাশাপাশি তিনি বায়েজিদ থানা আওয়ামী লীগের শ্রমবিষয়ক সম্পাদকও। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ওয়াসার কর্মচারীদের তিনি তটস্থ রাখতেন বলেও অভিযোগ আছে।
কারও আত্মীয়স্বজনকে চাকরি দেওয়া হয়নি। অনেক যাচাই–বাছাই করে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাজুলের ছোট ভাই চাকরি পেয়েছেন বলে তিনি শুনেছেন। তবে বাকিদের ব্যাপারে তাঁর সঠিক জানা নেই।এ কে এম ফজলুল্লাহ, শ্রমিকনেতা তাজুলের নিয়োগ–বাণিজ্যের বিষয়ে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক
ওয়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অভিযোগ, নিয়োগ–বাণিজ্য, তদবির, পদোন্নতি ও বদলিতে প্রভাব খাটিয়ে অবৈধভাবে তাজুল ইসলাম অর্থ আয় করেছেন। চাকরিজীবনের শুরু থেকেই তিনি এসবে জড়িয়ে যান। পরে অবৈধভাবে অর্জিত টাকা দিয়ে জায়গা কিনে দুই দশক আগে বাড়ি করেন।
ওয়াসা সূত্র জানায়, গত এক দশকে বিভিন্ন পদে অন্তত ১৪৫ জনকে আউটসোর্সিংয়ের (অস্থায়ী) ভিত্তিতে নিয়োগ দেয় ওয়াসা। তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই নিয়োগ পেয়েছেন তাজুলের ‘ক্ষমতার’ জোরে। নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে অন্তত ১২ জন তাঁর আত্মীয়।
নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, ২০১৭ সালের অক্টোবরে তাজুলের অবৈধ সম্পদ অর্জনের অনুসন্ধান করে সত্যতা পায় দুদক। পরে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেন দুদক সমন্বিত কার্যালয় চট্টগ্রাম-১-এর কর্মকর্তা জাফর আহমেদ। সে মামলায় জেল খেটেছিলেন তাজুল। এই মামলায় দুদকের দেওয়া অভিযোগপত্র গত ৩০ আগস্ট গ্রহণ করেছেন আদালত। মামলাটি এখন বিচারাধীন। মামলার পর ওয়াসা কর্তৃপক্ষও তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করে।
দুর্নীতির মাধ্যমে যে ওয়াসার গাড়িচালক তাজুল ইসলাম কোটি টাকার সম্পত্তি অর্জন করেছেন, তা পরিষ্কার। কারণ, একজন গাড়িচালকের বৈধ আয়ে শহরের ভেতর বাড়ি তৈরি করা প্রায় অসম্ভব।আখতার কবির চৌধুরী, টিআইবি-সনাক চট্টগ্রাম নগরের সভাপতি
পরে চলতি বছরের ২২ মার্চ তাজুল ও তাঁর স্ত্রী খাইরুন্নেছা বেগমের বিরুদ্ধে আরও একটি মামলা করে দুদক। বর্তমানে মামলাটির তদন্ত চলছে। এ ছাড়া গত ২১ জুলাই তাজুলের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা করেন এক গৃহবধূ। ঘটনার প্রাথমিক সত্যতাও খুঁজে পেয়েছে বায়েজিদ বোস্তামী থানা-পুলিশ। বর্তমানে তিনি এ মামলায় কারাগারে আছেন।
দুদকের করা দ্বিতীয় মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, তাজুল স্ত্রী ও নিজের নামে নগরের রৌফাবাদ এলাকায় ২০০২ সালে তিন শতক জায়গা কিনে পাঁচতলা বাড়ি করেন। অথচ তাঁর গৃহিণী স্ত্রীর আয়ের উৎস নেই। নিজের অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থকে বৈধতা দিতে স্ত্রীর নামে জমি কিনে পাঁচতলা বাড়ি করেন তাজুল।
দুদক ও ওয়াসা সূত্র জানায়, ১৯৮৯-৯০ থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত সর্বমোট ৫৭ লাখ ১৭ হাজার ৫৮২ টাকা আয় করেন তাজুল। এর মধ্যে পারিবারিক প্রয়োজনে তিনি ব্যয় করেছেন ৩৪ লাখ ২৩ হাজার টাকা। বাকি টাকা তিনি সঞ্চয় করেন। তাঁর জমির বর্তমান মূল্য আনুমানিক ৩০ লাখ টাকা (তিন শতক)। জায়গাসহ বাড়ির বর্তমান মূল্য কোটি টাকার কাছাকাছি।
দুদক চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক শহীদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, অনুসন্ধানে অবৈধ সম্পদ অর্জনের সত্যতা পাওয়ায় তাজুল ও তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তদন্ত অব্যাহত আছে।
স্বল্প বেতনের একজন গাড়িচালক হয়ে তিনি কীভাবে বাড়ির মালিক হলেন, তা নিয়ে ওয়াসার কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যেই আলোচনা আছে। কারণ, তাজুল ইসলাম সর্বশেষ ১৬তম গ্রেডে সব মিলিয়ে বেতন পেতেন ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা।
শ্রমিকনেতা তাজুলের নিয়োগ–বাণিজ্যের বিষয়ে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম ফজলুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, কারও আত্মীয়স্বজনকে চাকরি দেওয়া হয়নি। অনেক যাচাই–বাছাই করে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাজুলের ছোট ভাই চাকরি পেয়েছেন বলে তিনি শুনেছেন। তবে বাকিদের ব্যাপারে তাঁর সঠিক জানা নেই।
শহরের ভেতরই পাঁচতলা বাড়ি
চট্টগ্রাম শহরের ব্যস্ততম এলাকা রৌফাবাদের পাশেই পশ্চিম শহীদনগর এলাকা। গত বৃহস্পতিবার এলাকার তৈয়্যবিয়া হাউজিং সোসাইটির সরু গলি ধরে কিছু দূর গিয়েই চোখে পড়ে তাজুলের পাঁচতলা বাড়িটি।
বাড়িটির তৃতীয় তলায় এত দিন ধরে থাকত তাজুল ও তাঁর পরিবার। বর্তমানে তাঁরা বহদ্দারহাটে ভাড়া বাসায় থাকছেন। তবে তৃতীয় তলায় থাকেন বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক শাহাব উদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে জানান, সাত-আট মাস আগে বাড়ির মালিক তাজুল ইসলাম বহদ্দারহাট এলাকায় চলে গেছেন। পাঁচতলা বাড়িতে ১৭টি ফ্ল্যাট রয়েছে। ১২টি ফ্ল্যাট ভাড়া দেওয়া। প্রতিটি ফ্ল্যাটের ভাড়া ৯ হাজার টাকা। চারতলা পর্যন্ত গ্যাসের সংযোগ আছে। প্রায় দুই দশক আগে বাড়িটি বানান তাজুল।
তাজুলের ১২ নিকটাত্মীয় ওয়াসায়
তাজুলের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ নিয়োগ–বাণিজ্য। ওয়াসায় তাঁর অন্তত ১২ জন নিকটাত্মীয় কর্মরত আছেন। এর মধ্যে উপসহকারী প্রকৌশলী পদে ভাই শহিদুল ইসলাম, মিটার ইন্সপেক্টর পদে ভাই নজরুল ইসলাম, কম্পিউটার অপারেটর পদে বোন কুসুম আক্তার, সহকারী পাম্প অপারেটর পদে শ্যালক শওকত হোসেন, হেলপার পদে শ্যালক শাহাদাৎ হোসেন, দারোয়ান পদে ভাতিজা মোহাম্মদ সবুজ, সহকারী পাম্প অপারেটর পদে ভাতিজা মোহাম্মদ সোহাগ (অস্থায়ী), একই পদে ভাগনে মোহাম্মদ পাফিল (অস্থায়ী), ভাগনে তাজুল ইসলাম (অস্থায়ী), একই পদে ভাতিজা মোহাম্মদ রাজিব, মিটার পরিদর্শক পদে ভাতিজা আলী সোহেল। এ ছাড়া সহকারী পাম্প অপারেটর পদে অস্থায়ী ভিত্তিতে কাজ করছেন তাজুল ইসলামের ছেলে আরাফাত ইসলাম।
তাজুল ইসলামের স্ত্রী খাইরুন্নেছা বেগম প্রথম আলোকে মুঠোফোনে বলেন, তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। তিনি শুধু আত্মীয়স্বজনকে চাকরি দেননি, আরও শত শত ব্যক্তিকে চাকরি দিয়েছেন। কিন্তু কারও কাছ থেকে একটা টাকাও নেননি। মানুষকে সহায়তা করেছেন। কিন্তু তাঁকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে।
জানতে চাইলে টিআইবি-সনাক চট্টগ্রাম নগরের সভাপতি আখতার কবির চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, দুর্নীতির মাধ্যমে যে ওয়াসার গাড়িচালক তাজুল ইসলাম কোটি টাকার সম্পত্তি অর্জন করেছেন, তা পরিষ্কার। কারণ, একজন গাড়িচালকের বৈধ আয়ে শহরের ভেতর বাড়ি তৈরি করা প্রায় অসম্ভব। আর একজন কর্মচারীর এতজন আত্মীয় একটা সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকার বিষয়টি ভাবাই যায় না। নিয়োগপ্রক্রিয়ায় যাঁরা ছিলেন, তাঁদের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়।