কিশোর খুনে ২ থানায় ২ মামলা, বাবার মামলা হলো না

মাহমুদুল হাসান

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ৫ আগস্ট ঢাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় কিশোর মাহমুদুল হাসান। মাসখানেক পর ১২ সেপ্টেম্বর তার বাবা রিকশাচালক মিজানুর রহমান ঢাকার আদালতে যান ছেলে হত্যার ঘটনায় মামলা করতে। আদালত তাঁর জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করেন। পরে যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ আদালতকে জানালো, এ ঘটনায় আগেই একজন মামলা করেছেন। ফলে বাবার আবেদন খারিজ হয়ে যায়।

এরপর প্রথম আলোর অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, মাহমুদুল (১৫) হত্যায় একটি নয়, দুটি মামলা হয়েছে। এর একটি ডেমরা থানায়, তাতে আসামি করা হয় ৯৩ জনকে। এতে বলা হয়, মাহমুদুলকে ডেমরা এলাকায় গুলি করে হত্যা করা হয়। অপর মামলাটি যাত্রাবাড়ী থানায়, তাতে আসামি করা হয় ৩৭ জনকে। এই মামলায় বলা হয়, মাহমুদুলকে হত্যা করা হয়েছে যাত্রাবাড়ী। দুই মামলায় দুই থানার পুলিশ ইতিমধ্যে দুজনকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করেছে।

কিশোর মাহমুদুল হাসানের মৃত্যুর ঘটনায় পৃথক দুটি মামলার তথ্য আদালতের নজরে আনা উচিত। এটা অস্বাভাবিক ও ন্যায়বিচারের পরিপন্থী।
ফৌজদারি মামলাবিষয়ক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী

এই দুই মামলার বাদীদের চেনেন না মাহমুদুলের বাবা মিজানুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ছেলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। ছেলেকে গুলি করে হত্যা করা হলো। কিন্তু আমার মামলা করতে পারলাম না।’

ডেমরা ও যাত্রাবাড়ী থানার দুই মামলা এবং ঢাকার চিফ মেট্টোপলিটন আদালতে বাবার করা মামলার আবেদন—তিনটি এজাহারে ঘটনাস্থল নিয়ে তিন রকম তথ্য দেওয়া হয়েছে।

একই ঘটনায় দুই থানায় দুটি মামলা চলতে পারে না বলে জানিয়েছেন ফৌজদারি মামলাবিষয়ক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কিশোর মাহমুদুল হাসানের মৃত্যুর ঘটনায় পৃথক দুটি মামলার তথ্য আদালতের নজরে আনা উচিত। এটা অস্বাভাবিক ও ন্যায়বিচারের পরিপন্থী।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে যাত্রাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফারুক আহম্মেদ প্রথম আলোকে বলেন, মাহমুদুলের মৃত্যুর ঘটনায় ডেমরা থানায় মামলা হওয়ার তথ্য তাঁর জানা নেই। এ বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। একই কথা বলেন ডেমরা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবদুর রাজ্জাক মীর।

মাহমুদুল (১৫) হত্যায় একটি নয়, দুটি মামলা হয়েছে। এর একটি ডেমরা থানায়, তাতে আসামি করা হয় ৯৩ জনকে। এতে বলা হয়, মাহমুদুলকে ডেমরা এলাকায় গুলি করে হত্যা করা হয়। অপর মামলাটি যাত্রাবাড়ী থানায়, তাতে আসামি করা হয় ৩৭ জনকে। এই মামলায় বলা হয়, মাহমুদুলকে হত্যা করা হয়েছে যাত্রাবাড়ী।

দুই মামলায় আসামি যাঁরা

স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কিশোরগঞ্জের বাসিন্দা মিজানুর রহমান ও হাসি বেগম দম্পতির সন্তান মাহমুদুল হাসান। কয়েক বছর আগে মিজানুর ও হাসি বেগমের ছাড়াছাড়ি হয়। এরপর নারায়ণগঞ্জের সানারপাড় এলাকায় নানির কাছে বড় হয় মাহমুদুল।

মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ছেলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। তিনি নিজেও যাত্রাবাড়ীতে আন্দোলনে অংশ নেন। মাহমুদুল ৫ আগস্ট সকালে সানারপাড়ের বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। সন্ধ্যায় খবর পান, যাত্রাবাড়ীতে তাঁর ছেলের মাথায় গুলি লেগেছে। মরদেহ রয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে।

এ ঘটনায় প্রথম মামলাটি করেন ডেমরা এলাকার বাসিন্দা জুলহাস শেখ। তিনি ৫ সেপ্টেম্বর ঢাকার সিএমএম আদালতে করা আবেদনে আসামি হিসেবে ৯৪ জনের নাম উল্লেখ করেন। এর মধ্যে রয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের পাঁচজন কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনসহ পুলিশের পাঁচ কর্মকর্তা। এর বাইরে ডেমরার আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ৮৪ জনকে আসামি করা হয়।

এই মামলায় শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির ১৫ জন কেন্দ্রীয় নেতা, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুনসহ পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়।

এজাহারে দাবি করা হয়, নিহত মাহমুদুল বাদীর ভাগনে হয়। সে ৫ আগস্ট বেলা দেড়টার দিকে ডেমরার বাঁশপট্টি এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রাত তিনটার দিকে তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকেরা। আদালতের নির্দেশে ডেমরা থানায় মামলাটি নথিবদ্ধ করা হয় ১০ সেপ্টেম্বর। এই মামলায় ৬৫ নম্বর আসামি জাহাঙ্গীর আলমকে (৪৬) গ্রেপ্তার করে এক দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করেছে পুলিশ।

বাদী জুলহাস শেখ প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, মাহমুদুলের মা হাসি বেগম তাঁর পূর্বপরিচিত। তাঁর জানামতে, মাহমুদুল ডেমরা এলাকায় খুন হয়েছিল। এ জন্য তিনি বাদী হয়ে মামলা করেন।

একই ঘটনায় ১০ সেপ্টেম্বর সিএমএম আদালতে ৩৭ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলার আবেদন করেন রবিউল আওয়াল নামের এক ব্যক্তি। আদালত মামলাটি এজাহার হিসেবে রেকর্ড করার জন্য যাত্রাবাড়ী থানার ওসিকে নির্দেশ দেন। ১৮ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ী থানায় মামলাটি রেকর্ড করা হয়।

এই মামলায় শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির ১৫ জন কেন্দ্রীয় নেতা, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুনসহ পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়। পাশাপাশি ঢাকার দুই বড় ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষকে আসামি করা হয়। পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত এ মামলায় সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুনের পাঁচ দিনের রিমান্ডও মঞ্জুর করেন।

মিজানুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘যা–ই হোক আমি আমার ছেলে হত্যার সুষ্ঠু বিচার চাই।’

এজাহারে বলা হয়, মাহমুদুল ৫ আগস্ট বেলা ১১টার সময় যাত্রাবাড়ীর শনির আখড়ায় গুলিবিদ্ধ হয়। পরে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করেন।

এ মামলার বাদী রবিউল আওয়াল প্রথম আলোকে বলেন, মাহমুদুল তাঁর কোনো আত্মীয় নন। তাঁর জানামতে, মাহমুদুলের মা–বাবা কেউই মামলা করেননি। তাই তিনি বাদী হয়ে মামলা করেছেন।

অবশ্য পরে মামলা থেকে দুই ব্যবসায়ীর নাম প্রত্যাহার চেয়ে আদালতে আবেদন করেছেন বাদী রবিউল আওয়াল। তাঁর দাবি, আইনজীবী ভুলে ওই দুই ব্যবসায়ীর নাম মামলায় উল্লেখ করা হয়েছিল।

তবে একই ঘটনায় দুই থানায় দুই মামলা হওয়ার বিষয়টি জানার পর ছেলে হত্যার বিচার নিয়ে সংশয়ে ভুগছেন মিজানুর রহমান। তিনি রবিউলের মামলায় পক্ষভুক্ত হতে আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতে আবেদন করেছেন। মিজানুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘যা–ই হোক আমি আমার ছেলে হত্যার সুষ্ঠু বিচার চাই।’