কিডনি ব্যবসায়ীরা পার পাচ্ছেন দায়সারা তদন্তে

  • আড়াই বছরে ঢাকা মহানগরে তিন মামলা।

  • দুই মামলায় ভারতে অবস্থানরত তিন আসামিকে অব্যাহতির সুপারিশ।

  • বর্তমানে কারাগারে ৪ আসামি, জামিনে আছেন ১০ জন।

দরিদ্র ও স্বল্পশিক্ষিত লোকজনকে বড় অঙ্কের টাকার প্রলোভন দেখিয়ে ও ভালো বেতনে চাকরির ফাঁদে ফেলে তাঁদের কিডনি নিয়ে নিচ্ছেন সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের সদস্যরা। এসব ঘটনায় মামলা হলেও পুলিশের দায়সারা তদন্তে চক্রের হোতারা বিচারের আওতায় আসছেন না।

বিগত আড়াই বছরে ঢাকা মহানগরে কিডনি কেনাবেচা চক্রের সদস্যদের বিরুদ্ধে হওয়া তিনটি মামলা পর্যালোচনা করা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, দুটি মামলার তদন্ত শেষে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে পুলিশ। একটি মামলার তদন্ত এখনো চলছে। এগুলোর প্রতিটি ঘটনায় ভুক্তভোগীকে হয় ভারতে নিয়ে তাঁর কিডনি অপসারণ করা হয়েছে বা অপরাধী চক্রে জড়িত কেউ না কেউ ভারতে অবস্থান করছেন।

ভারত ও বাংলাদেশজুড়ে ছড়িয়ে আছেন অবৈধ কিডনি কেনাবেচায় যুক্ত চক্রের সদস্যরা। পুলিশের তদন্তে ছাড় পেয়ে যাচ্ছেন ভারতে অবস্থানরত অপরাধীরা।

ভালো বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে সম্প্রতি ভারতে নিয়ে জোর করে কিডনি দিতে বাধ্য করা হয় রবিন খান নামের এক যুবককে। নেত্রকোনায় দর্জির দোকানির কাজ করে আসা রবিন দেশে ফিরে ১১ মে ধানমন্ডি থানায় ১১ জনের নাম উল্লেখ করে একটি মামলা করেছেন। পরে ধানমন্ডি থানা-পুলিশ চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে। ভুক্তভোগী রবিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘পূর্বপরিচিত রাজুসহ কয়েকজন এই চক্রের সঙ্গে জড়িত। ভারতে নিয়ে তাঁরা আমার একটি কিডনি বিক্রি করতে বাধ্য করেছেন। আমাকে তিন লাখ টাকা দিয়ে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এখন আমি অসুস্থ।’

রবিনের মামলাটির এখনো তদন্ত চলছে। আর যে দুই মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর সব আসামিকে শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। পূর্ণাঙ্গ নাম–ঠিকানা না পাওয়ায় কোনো কোনো আসামিকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এসব আসামির প্রত্যেকে ভারতে অবস্থান করছেন বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে।

আরও পড়ুন

তদন্তে দুর্বলতা

স্বল্প আয়ের মানুষদের প্ররোচিত করে কিডনি বিক্রি করানোর অভিযোগে দুই বছর আগে রাজধানীর ভাটারা থেকে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। পরে র‍্যাব এ ঘটনায় ১৯৯৯ সালের মানবদেহ অঙ্গ–প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইনে মামলা করে। সেই মামলা এক বছরের বেশি সময় তদন্ত করে পাঁচজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় ভাটারা থানা–পুলিশ।

মামলার এজাহারে বলা হয়, আসামি শহিদুল ইসলামসহ অন্যরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কম শিক্ষিত লোকজনকে অর্থের লোভ দেখিয়ে কিডনি কেনেন। পরে প্রচুর অর্থের বিনিময়ে সেই কিডনি বিত্তবান কিডনি রোগীদের কাছে বিক্রি করেন। তাঁরা ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দিয়েও লোকজনকে কিডনি বিক্রিতে উদ্বুদ্ধ করেন। এই চক্রের অন্যতম সদস্য রাসেল ভারতে অবস্থান করছেন। অভিযোগপত্রের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায় যে এক বছরের বেশি সময় ধরে তদন্ত করলেও পুলিশ রাসেলের পূর্ণাঙ্গ নাম–ঠিকানা খুঁজে বের করতে পারেনি।

তাঁকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করা হয়েছে। এ ছাড়া এই চক্র কবে থেকে এবং কতজনের কাছ থেকে কিডনি নিয়েছে, সেসব তথ্য তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি। কিডনি কাদের কাছে বিক্রি করা হয়েছে, সে ব্যাপারেও সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। মামলাটি বর্তমানে অভিযোগ গঠনের শুনানি পর্যায়ে রয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা ভাটারা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) খলিলুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ছিলেন মামলাটির তৃতীয় তদন্ত কর্মকর্তা। মামলার নথিপত্রের ভিত্তিতে আদালতে প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন।

তদন্তে দুর্বলতার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মো. ফারুক হোসেন বলেন, মামলার তদন্তে যদি দুর্বলতা থাকে, সেটি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে এনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কিডনি বেচাকেনার ঘটনায় গত বছর র‍্যাবের করা আরেকটি মামলার তদন্তের হালও একই রকম। এই মামলার সাত আসামির মধ্যে নাফি আহমেদ ও তাইফ হোসেন সম্পর্কে এজাহারে বলা হয়, এই দুজন ভারতে অবস্থান করে কিডনি কেনাবেচার চক্রের সঙ্গে জড়িত। ৯ মাস তদন্ত করে ভাটারা থানার এসআই পুলক কুমার দাস মজুমদার গত ১৮ এপ্রিল আদালতে যে অভিযোগপত্র জমা দেন, তাতেও এই দুজনকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে যে তাঁরা কিডনি কেনাবেচার চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকলেও তাঁদের পূর্ণাঙ্গ নাম–ঠিকানা জানা সম্ভব হয়নি।

পুলিশের এ ধরনের তদন্ত নিয়ে হতাশা জানিয়ে ফৌজদারি অপরাধবিষয়ক বিশেষজ্ঞ আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী প্রথম আলোকে বলেন, কিডনি কেনাবেচার অপরাধটি আন্তরাষ্ট্রীয় অপরাধ। কিডনি সংগ্রহ থেকে কিডনি সংযোজনের সঙ্গে বিরাট চক্র জড়িত থাকে। দায়সারা গোছের তদন্ত দিয়ে অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হলে চক্রের প্রত্যেক সদস্যকে চিহিত করে তাঁদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ, তথ্য-প্রমাণ আদালতের কাছে উপস্থাপন করতে হবে।