ধানমন্ডিতে চার কিশোর গ্যাং, একটির নেতৃত্বে ধনাঢ্য বাবার দুই সন্তান
ডিএমপির তালিকায় কিশোর গ্যাংয়ের নাম থাকলেও থানা-পুলিশের অস্বীকার। একটির নেতৃত্বে ওয়ার্ড কাউন্সিলরের ছেলে। স্থানীয় বাসিন্দারা অতিষ্ঠ।
ঢাকার ধানমন্ডি এলাকায় সক্রিয় চারটি কিশোর গ্যাং। এর একটি ‘তৌসিফ গ্রুপ’। এই কিশোর গ্যাং দলের নেতৃত্বে রয়েছেন সরকারি দলের একজন কাউন্সিলরের ছেলে। এ এলাকায় ‘ব্রাদারহুড’ নামে আরেকটি কিশোর গ্যাং চালান অরভিল খন্দকার ও আলভি খন্দকার নামের দুই ভাই। তাঁরা ধনাঢ্য বাবার সন্তান। পুলিশের তালিকায় এই দুটি গ্রুপ ছাড়াও ‘ল্যাব সাকিব’ ও ‘সিটিএন’ নামে আরও দুটি কিশোর গ্যাং রয়েছে ধানমন্ডি এলাকায়।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, ধানমন্ডি এলাকায় যাঁরা কিশোর গ্যাং চালান, তাঁদের কেউ কেউ স্থানীয় প্রভাবশালীদের সন্তান। যে কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন না। মাদক সেবন, বিক্রি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে দলবদ্ধ হয়ে আড্ডা ও শিক্ষার্থীদের উত্ত্যক্ত করা, চুরি-ছিনতাইসহ নানা অপরাধে জড়িত এ এলাকার কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। অনেক সময় দিনের বেলায়ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে বলে স্থানীয় লোকজন জানান।
কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে বাড্ডা, পুরান ঢাকার চকবাজার, লালবাগ, বংশাল, ওয়ারী ও কামরাঙ্গীরচর এলাকায়ও নিয়মিত অভিযান নেই। এসব এলাকার স্থানীয় সূত্র থেকে জানা গেছে, পাড়া-মহল্লায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর রফিকুল ইসলামের (বাবলা) ছেলে একটি কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্বে আছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। পুলিশের তালিকায়ও তাঁর ছেলের নাম রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর এলাকায় কোনো কিশোর গ্যাং নেই। তাঁর ছেলে বিদেশে পড়াশোনা করেন। তিনি এ প্রতিবেদককে তাঁর অফিসে গিয়ে পুলিশের তালিকা দেখিয়ে আসতে বলেন।
অবশ্য ধানমন্ডি এলাকায় নিয়মিত ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে বলে স্বীকার করেছে পুলিশ। ধানমন্ডি থানা-পুলিশের কর্মকর্তারা বলেন, মোহাম্মদপুর, বছিলা ও হাজারীবাগ এলাকা থেকে ছিনতাইকারীরা এই এলাকায় এসে ছিনতাই করেন। তাঁরা পেশাদার ছিনতাইকারী। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য নন। তবে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তালিকা অনুযায়ী, তাঁরা কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য।
ধানমন্ডি এলাকায় কিশোর গ্যাং সদস্যদের বিরুদ্ধে সম্প্রতি কোনো অভিযান হয়নি বলে জানিয়েছেন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) পারভেজ ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর থানা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা না থাকায় কোনো অভিযান নেই।
কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পদক্ষেপ এককেন্দ্রিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে। পৃষ্ঠপোষকদের আইনের আওতায় না এনে কেবল সদস্যদের গ্রেপ্তার করে এ সমস্যার সমাধান হবে না।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক
এ ছাড়া কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে বাড্ডা, পুরান ঢাকার চকবাজার, লালবাগ, বংশাল, ওয়ারী ও কামরাঙ্গীরচর এলাকায়ও নিয়মিত অভিযান নেই। এসব এলাকার স্থানীয় সূত্র থেকে জানা গেছে, পাড়া-মহল্লায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে।
অবশ্য দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে তাঁদের নিয়মিত অভিযান চলছে। এর মধ্যে কামরাঙ্গীরচর থানার ওসি সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ২০ মার্চেও কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে তাঁরা অভিযান চালিয়েছিলেন, কিন্তু কাউকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।
গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ‘কিশোর গ্যাং প্রশ্রয় দেন ঢাকার ২১ কাউন্সিলর’ শিরোনামে প্রথম আলোয় সংবাদ প্রকাশিত হয়। এ নিয়ে পরে জাতীয় সংসদেও আলোচনা করেন তিনজন সংসদ সদস্য।
এ ছাড়া গত মাসে পুলিশ সপ্তাহের অনুষ্ঠানে কিশোর গ্যাংয়ের অপরাধ নিয়ে আলোচনা হয়। পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন মাঠপর্যায়ের পুলিশকে কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা নিয়ন্ত্রণের নির্দেশনা দেন।
আগে অনিয়মিত অভিযান হলেও সংসদে কিশোর গ্যাং নিয়ে আলোচনা ও আইজিপির নির্দেশনার পর ঢাকার মোহাম্মদপুর, মিরপুর, উত্তরাসহ বেশ কিছু এলাকায় নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে পুলিশ ও র্যাব।
গত রবি ও সোমবার রাজধানীর মিরপুর ও পল্লবী থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে দুটি কিশোর গ্যাংয়ের ১৪ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র্যাব-৪। গত ফেব্রুয়ারিতে মোহাম্মদপুরের বছিলা ও হাজারীবাগ এলাকায় অভিযান চালিয়ে র্যাব-২ কিশোর গ্যাংয়ের ৩৬ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। পাশাপাশি গত মাসে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) এক অভিযানে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে কিশোর গ্যাংয়ের অর্ধশতাধিক সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। গত মাসে বিমানবন্দর, বনানী, মহাখালী এবং টঙ্গী ও গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের ৩৭ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র্যাব-১।
র্যাব সূত্র জানায়, ঢাকায় গত জানুয়ারিতে কিশোর গ্যাংয়ের ১৬ সদস্যকে এবং ফেব্রুয়ারিতে ১৮৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। র্যাব গত বছর সারা দেশে অভিযান চালিয়ে ৩৪৯ জনকে গ্রেপ্তার করে। ২০১৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের ১ হাজার ৩৩১ সদস্য।
ঢাকা মহানগর পুলিশের তালিকা ও প্রথম আলোর অনুসন্ধানে ঢাকায় অন্তত ৮০টি কিশোর গ্যাং সম্পর্কে জানা গেছে। তারা ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, মাদক সেবন, জমি দখল, নারীদের উত্ত্যক্ত করা, মারামারি ও খুনের মতো অপরাধে জড়িত। নাম কিশোর গ্যাং হলেও এসব অপরাধী চক্রের অধিকাংশ সদস্যের বয়স ১৮ থেকে ৪০ বছর।
গ্যাংয়ের তৎপরতা অব্যাহত
গত মাসে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় ‘সিনিয়র-জুনিয়র’ দ্বন্দ্বের জেরে জামাল হোসেন (১৮) নামের তরুণকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়েছে। নিহত জামাল জুনিয়র গ্রুপের। তিনি একটি ওয়েল্ডিং কারখানায় কাজ করতেন। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে সিনিয়র গ্রুপের পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার মোহাম্মদপুর থানার রায়েরবাজার এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা একটি বাসায় ঢুকে এক নারীকে কুপিয়ে জখম করেছেন বলে পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়। আহত নারীর বাবা নিজাম ফকির প্রথম আলোকে জানান, মঙ্গলবার পুলিশ রায়েরবাজারের বাবরি মসজিদ গলিতে অভিযান চালিয়ে কিশোর গ্যাংয়ের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে। ওই গ্যাংয়ের ধারণা, তাঁর মেয়ে পুলিশকে তাঁদের ব্যাপারে তথ্য দিয়েছিলেন।
ডিএমপির হিসাবে, গত বছর কিশোর গ্যাংয়ের মধ্যে মারামারিতে অন্তত ২৫ জন খুন হয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পদক্ষেপ এককেন্দ্রিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে। পৃষ্ঠপোষকদের আইনের আওতায় না এনে কেবল সদস্যদের গ্রেপ্তার করে এ সমস্যার সমাধান হবে না।