ইউরোপে যেতে জমি বিক্রি, ঋণ করে টাকা দিয়ে এখন রাস্তায় ঘুরছেন তাঁরা

ইউরোপে পাঠানোর কথা বলে যুবকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে লাখ লাখ টাকাপ্রতীকী ছবি

স্বপ্নের ইউরোপে যেতে কেউ ছেড়ে দিয়েছেন চাকরি। কেউ বিক্রি করেছেন বাবার জমি। আবার কেউ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে টাকা দিয়েছিলেন একটি প্রতিষ্ঠানকে। কিন্তু বছর ঘুরলেও ইউরোপে যেতে পারেননি কেউই। ফাঁদে পড়ে ওই প্রতিষ্ঠানকে বিপুল অঙ্কের টাকা দিয়ে এখন ফেরতও পাচ্ছেন না তাঁরা।

প্রবাসী সেবা লিমিটেড নামের ওই প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে টাকা খুইয়েছেন অন্তত ১৬ যুবক। এঁদের মধ্যে পাঁচজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওয়ার্ক পারমিট (কাজের অনুমতিপত্র) দিয়ে ইউরোপের দেশ পর্তুগালে পাঠানোর কথা বলে তাঁদের সঙ্গে চুক্তি করা হয়। ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে তাঁদের কাছ থেকে কয়েক লাখ করে টাকা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু পর্তুগালে পাঠানো দূরের কথা, প্রতিষ্ঠানটি তাঁদের ভিসার আবেদনই জমা দেয়নি।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ১১ লাখ ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে পর্তুগালে কাজের অনুমতিপত্র ও ভিসা করে দেওয়ার নিশ্চয়তা দিয়েছিল ওই প্রতিষ্ঠান। শুরুতে ভিসার আবেদন ও মেডিকেল পরীক্ষার কথা বলে ৩ লাখ ১০ হাজার টাকা নেয়। পরে তাঁদের ভিসার আবেদন জমা দিতে নিয়ে যাওয়া হয় ভারতের দিল্লিতে। যুবকদের বলা হয়, দিল্লিতে ওই প্রতিষ্ঠানের একজন প্রতিনিধি আছেন। কাজের অনুমতিপত্রের মূল কপি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে তাঁদের ভিসার আবেদন জমা দিতে সাহায্য করবেন সেই ব্যক্তি। কিন্তু সেখানে গিয়ে প্রায় দুই সপ্তাহ থেকেও এ রকম কারও দেখা না পেয়ে ফিরে আসতে হয়েছে।

প্রতারণার অভিযোগ প্রবাসী সেবা লিমিটেড নামের এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে
ছবি: সংগৃহীত

প্রতারিত এই যুবকদের একজন মোহাম্মদ সানাউল পর্তুগালে যেতে গত বছরের ডিসেম্বরে প্রবাসী সেবার ব্যবস্থাপনা পরিচালক কানিজ ফাতেমার কাছে তিন লাখ টাকা দিয়েছিলেন। তিনি জানান, প্রতিষ্ঠানের কথামতো গত ৩ আগস্ট নয়াদিল্লিতে যান তিনি। কোনো কাজ না হওয়ায় ১৬ আগস্ট ফিরে আসেন তিনি।

দিল্লির অভিজ্ঞতা জানিয়ে সানাউল প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেখানে (দিল্লি) গিয়ে দুই সপ্তাহের মতো হোটেলে বসেছিলাম। তাঁদের কোনো প্রতিনিধি কাগজপত্র নিয়ে আসেনি। একজন হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করেন। তিনি প্রতিদিনিই বলতেন, আর এক দিন থাকতে হবে। ওই প্রতিষ্ঠানে টাকা দিয়ে অনেকেই সেখানে কয়েক সপ্তাহ এমনকি মাসখানেক বসে আছেন।’

মোহাম্মদ সানাউল বলেন, ‘এক সপ্তাহ বসে থেকে তাঁদের কোনো প্রতিনিধি না পেয়ে দেশে ফিরে আসি। পরে তাঁদের গুলশানের অফিসে গিয়ে দেখা করলে উল্টো আমাদের দোষারোপ করে ওই প্রতিষ্ঠান। এখন টাকা ফেরত না দিয়ে ঘোরাচ্ছে।’

সানাউলের মতো চাঁদপুরের তোফায়েল আহমেদ নামের এক যুবকও পর্তুগালে যেতে কয়েক লাখ টাকা দিয়েছিলেন কানিজ ফাতেমাকে। তোফায়েল প্রথম আলোকে বলেন, ৬ বছর মালয়েশিয়ায় কাজ করে দেশে ফিরেছেন। আশা ছিল নতুন করে ইউরোপের কোনো দেশে গিয়ে একটু বেশি রোজগার করবেন। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে তাঁর জীবনে। সব মিলিয়ে তাঁর প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। টাকা ফেরত না দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি তাঁকে ঘোরাচ্ছে।

টাকা খুইয়েছেন অন্তত ১৬ যুবক
ছবি: সংগৃহীত

ইউরোপে যাওয়ার স্বপ্নে প্রবাসী সেবায় টাকা জমা দিয়েছিলেন ঢাকার এক যুবক। এক মাসের মধ্যে যেতে হবে, তাই চাকরিও ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু ইউরোপে আর যাওয়া হয়নি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই যুবক প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাবার জমি বিক্রি করে টাকা দিয়েও ফেরত পাইনি। বিদেশে যাব বলে চাকরিও ছেড়ে দিয়েছিলাম। এখন পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছি।’

টাকা ফেরত না পেয়ে কয়েকজন ভুক্তভোগী গুলশান থানায় অভিযোগ করেন। এক মাস ধরে তদন্ত করেও পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ করেছেন তাঁরা।

অভিযোগ তদন্ত করছেন গুলশান থানার উপপরিদর্শক (এসআই) রাকিবুল আলম। জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘অভিযোগ নিয়ে দুই পক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। ভুক্তভোগীরা যাতে টাকা ফেরত পান, সেই চেষ্টা করছি।’

তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রবাসী সেবা নামের প্রতিষ্ঠান কোনো রিক্রুটিং এজেন্সি নয়, বিপিও (বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং) প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিবন্ধন নিয়ে গুলশানে কার্যালয় খুলে ইউরোপে পাঠানোর নামে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে। শুধু তা-ই নয়, আন্তর্জাতিক ভিসা সেন্টার ভিএফএস গ্লোবালের অ্যাপয়েন্টমেন্টের জাল কাগজ বানিয়েও মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে প্রতিষ্ঠানটি।

আরও পড়ুন

যা বলল প্রবাসী সেবা লিমিটেড

অভিযোগের বিষয়ে দুই দিন প্রবাসী সেবা লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কানিজ ফাতেমার সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি। আজ প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি প্রথম আলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরেন।

পর্তুগালে পাঠানোর চুক্তি করে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন কানিজ ফাতেমা। তিনি বলেন, চুক্তি অনুযায়ী ভুক্তভোগীদের টাকা ফেরত দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভুক্তভোগীরা অতিরিক্ত অর্থ দাবি করায় সেটা সম্ভব হয়নি।

পর্তুগালে কেন পাঠাতে পারেননি, সে প্রশ্নের জবাবে কানিজ ফাতেমা বলেন, তাঁর প্রতিষ্ঠান যে সময় পাঠাতে চেয়েছিল, তখন তাঁরা যেতে চাননি। পরে যখন তাঁরা যেতে চেয়েছেন, তখন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে চেষ্টা করেও পাঠাতে পারেননি।

ভিসার আবেদন জমা দিতে কয়েকজনকে দিল্লিতে পাঠানো হয়েছিল। সেখানে প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধির তাঁদের সঙ্গে নিয়ে ভিসার আবেদন জমা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দিল্লিতে যাওয়ার পর প্রতিষ্ঠানের কোনো প্রতিনিধি তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। এ বিষয়ে কানিজ ফাতেমা বলেন, প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে যখন দিল্লিতে যেতে বলা হয়েছিল, তখন তাঁরা যেতে পারেননি।

এ বিষয়ে ভুক্তভোগী মোহাম্মদ সানাউল বলেন, চুক্তি অনুযায়ী টাকা ফেরত দেওয়ার কথা ওই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সেটা ঠিক নয়। চুক্তি অনুযায়ী ভিসার আবেদন জমা দেওয়ার পর তিনি যেতে না পারলে ২০ শতাংশ টাকা খরচ বাবদ কেটে রেখে বাকি টাকা ফেরত দেবে। এখন থানা–পুলিশের মাধ্যমে এক লাখ টাকা ফেরত দিতে চাইছে।

একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন আরেক ভুক্তভোগী মো. তোফায়েল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, চুক্তি করে টাকা নিয়ে জাল কাগজপত্র তৈরি করে তাঁকে দিয়েছে ওই প্রতিষ্ঠান। এখন টাকা ফেরত চাইলে উল্টো টাকা দাবি করছে। মামলার হুমকি দিচ্ছে।