রপ্তানির পোশাক চুরির ১০ চক্র ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কে

প্রতি মাসে ৪২ থেকে ৪৫টি চুরি। আইন সংশোধন করে বিশেষ ধারায় মামলা নেওয়ার সুপারিশ।

মহাসড়কে রপ্তানির পোশাক চুরিতে সক্রিয় ১০টি চক্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। অধিকাংশ চুরির ঘটনায় ঘুরেফিরে এই চক্রগুলোর নামই উঠে আসছে। এসব চক্রের অনেকেই বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছেন। তবে কিছুদিন পর জামিনে ছাড়া পেয়ে আবারও তাঁরা চুরিতে জড়িয়ে পড়ছেন।

রপ্তানির পণ্য চুরির ঘটনায় ছায়াতদন্ত করতে গিয়ে গত এক বছরে ৫টি অভিযানে ২৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। তাঁদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে কর্মকর্তারা জানান, চুরির মালামাল ক্রয়ে অসাধু কয়েকজন পোশাক কারখানার মালিকের জড়িত থাকার তথ্যও পাওয়া গেছে। তবে যাচাই–বাছাইয়ের আগে সে বিষয়ে তথ্য দিতে চায় না র‍্যাব।

র‌্যাব বলছে, রপ্তানির পণ্য চট্টগ্রাম বন্দরে নেওয়ার পথে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গড়ে প্রতি মাসে ৪২ থেকে ৪৫টি চুরির ঘটনা ঘটছে। এই হিসাবে বছরে পাঁচ শতাধিক চুরির ঘটনা ঘটে। তবে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) বলছে, গত বছর রপ্তানির পোশাক চুরির ঘটনা মাত্র ২২টি।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, পণ্য চুরির সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত নাম মো. সাহেদ ওরফে সিলেটি সাঈদ। সর্বশেষ ৩ ফেব্রুয়ারি তিন সহযোগীসহ সাহেদকে র‌্যাব গ্রেপ্তার করে। এর আগে সাহেদ আটবার গ্রেপ্তার হন। তাঁর বিরুদ্ধে ১৭–১৮টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। র‌্যাব সূত্র জানায়, দুলাল হোসেন ওরফে হিমেল, সিরাজুল ইসলাম এবং তাঁর খালাতো ভাই মাসুম ঢাকার আশপাশ এলাকায় রপ্তানির পোশাক চুরিতে তিনটি দলের নেতৃত্ব দেন। তাঁরা তিনজনই সাহেদের সহযোগী হিসেবে কাজ করতেন। এখন নিজেরাই আলাদা চক্র গড়ে তুলেছেন।

এদিকে সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের বন্দর ও ঢাকার ডেমরা থেকে পৃথক দুটি অভিযানে গ্রেপ্তার হয়েছেন মো. রিপন ওরফে ছোট রিপন এবং তাওহীদুল ইসলাম। এর আগেও তারা একাধিকবার গ্রেপ্তার হন। এসব চক্রের বাইরে কুমিল্লার সোহাগ, চট্টগ্রামের বাবু, বড় রিপন ও জুয়েল সমাদ্দারের নেতৃত্বে রপ্তানির পোশাক চুরির ঘটনা ঘটছে।

র‍্যাব-৪-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ আবদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, রপ্তানির পণ্য চুরিতে জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনলেও কিছুদিন পর তাঁরা জামিনে বেরিয়ে চুরিতে জড়ান।

চুরির কৌশল

চুরির কৌশল সম্পর্কে র‌্যাব বলছে, চোরচক্রের সদস্যরা প্রথমে রপ্তানিমুখী পণ্য পরিবহনকারী যানবাহনের চালকের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এরপর তাঁকে টাকার লোভ দেখিয়ে চুরির পরিকল্পনা সাজান। চালকের কাজ হলো, চট্টগ্রামে যাওয়ার পথে পোশাকবাহী কাভার্ড ভ্যানটিকে নির্ধারিত কোনো পরিত্যক্ত স্থানে নিয়ে যাওয়া।

চোরচক্রের সদস্যরা তালা না ভেঙে কাভার্ড ভ্যানের নাট–বল্টু খুলে ফেলেন। এরপর চোরেরা একেকটি বাক্স থেকে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পণ্য চুরি করেন। এরপর বাক্সে সমপরিমাণ ঝুট বা অন্য কিছু ভরে রাখা হয়। এতে সিল ও তালা অক্ষতই থাকে। বন্দরে পণ্য নামানোর পর অধিকাংশ সময় চুরির বিষয়টি আর ধরা পড়ে না।

র‌্যাব-৪–এর বিশেষ কোম্পানি কমান্ডার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, চুরির বিষয়টি ধরা পড়ে বিদেশে ক্রেতার কাছে পৌঁছানোর পর। অনেক ক্ষেত্রে তখন চুক্তি বাতিল হওয়ার পাশাপাশি মোটা অঙ্কের জরিমানা দিতে হয়।

র‍্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, যদি দেশে চুরির ঘটনা ধরা পড়ে, তখন সেই পণ্য আর জাহাজীকরণ হয় না। সে ক্ষেত্রে রপ্তানিকারকের বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতি ও আস্থার সংকটের মুখে পড়তে হয়।

রপ্তানির পণ্য চুরিতেও সাধারণ চুরির মামলা

পোশাক রপ্তানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মহাসড়কে রপ্তানির পণ্য চুরি হলে কারখানার মালিক আইনি পদক্ষেপ নিতে চান না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চোরচক্রের সঙ্গে তাঁরা সমঝোতা করার চেষ্টা করেন। তাঁরা আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার চেয়ে মালামাল উদ্ধারকে বেশি গুরুত্ব দেন। তা ছাড়া মামলা হলে কারখানার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তা ছাড়া সাধারণ চুরির ঘটনায় যে ধারায় মামলা হয়, রপ্তানির পোশাক চুরির ঘটনায় একই ধারায় মামলা হয়। এ কারণে চোরচক্রের সদস্যরা আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যায়।

মহাসড়কে রপ্তানির পণ্য চুরি প্রতিরোধে নীতিমালা তৈরি করতে ২০২১ সালের মাঝামাঝি একটি কমিটি গঠন করে পুলিশ সদর দপ্তর। ওই কমিটি একটি খসড়া নীতিমালা প্রণয়ন করে। সেখানে বলা হয়, রপ্তানির পণ্য চুরি রোধে সাধারণ ধারায় মামলা না নিয়ে আইন সংশোধন করে বিশেষ ধারায় মামলা নেওয়া যেতে পারে। 

ওই কমিটির সদস্যসচিব আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন–১–এর অধিনায়ক মোশাররফ হোসেন মিয়াজী প্রথম আলোকে বলেন, নীতিমালার খসড়া তৈরি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে।

পরিবহন নেতা ও রপ্তানিকারকদের ভাষ্য

বাংলাদেশ কাভার্ড ভ্যান ট্রাক প্রাইম মুভার পণ্য পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব জাফর আহমেদ চৌধুরী মনে করেন, আইনি ব্যবস্থা না নিয়ে মালিকদের সমঝোতা করার মানসিকতাই চুরি না থামার বড় কারণ।

তবে এ বক্তব্যের বিরোধিতা করে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, পণ্য পরিবহনের সময় চুরি হলে এর দায়ভার তাঁদেরই। সময়মতো রপ্তানির পণ্য সরবরাহ করতে না পারলে বিদেশি ক্রেতা চুক্তি বাতিল করেন। ওই ক্রেতা নতুন করে পণ্য নিতে আগ্রহী হন না। এ কারণে কারখানার মালিকেরা মালামাল উদ্ধারে গুরুত্ব দেন।

তবে একটি বিষয়ে জাফর আহমেদ চৌধুরী ও মোহাম্মদ হাতেম একমত। তাঁদের ভাষ্য, সাধারণ চুরি ও রপ্তানির পণ্য চুরিতে একই ধারায় মামলা হওয়ায় চোরচক্রের সদস্যরা দ্রুত জামিন পান। এ কারণে রপ্তানির পণ্য চুরি রোধে বিশেষ আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন।