অপরাধে বিদেশিরা: আসামি ৩৩ দেশের ৭২৬ নাগরিক
গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে নাইজেরিয়া, ক্যামেরুন, মালি, কঙ্গো, তানজানিয়া, ঘানা, গিনি, উগান্ডা, ইথিওপিয়া, অ্যাঙ্গোলার নাগরিকেরা রয়েছেন।
অনলাইনে বন্ধুত্ব গড়ে দামি উপহার পাঠানো, স্বর্ণে বা বিটকয়েনে বিনিয়োগ ও আকর্ষণীয় উপার্জনের আশ্বাসসহ নানা ফাঁদে ফেলে মানুষের কাছ থেকে অর্থ বের করে নেওয়ার ঘটনা কিছুদিন পরপরই আলোচনায় আসে। এ ধরনের ঘটনায় অনেক বিদেশি নাগরিকের সম্পৃক্ততাও পাওয়া যাচ্ছে।
এর বাইরে ব্যাংকের এটিএম বুথে জালিয়াতি, ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি, অনলাইনে ক্যাসিনো, অপ্রচলিত মাদকের কারবার, জাল মুদ্রা তৈরি, অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা, সোনা চোরাচালান ও মানব পাচারের মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডেও অনেক বিদেশি নাগরিক ধরা পড়েছেন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন মামলায় গত ১০ বছরে আসামি হয়েছেন ৩৩ দেশের ৭২৬ নাগরিক। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নাইজেরিয়ার, ৯১ জন। এরপর রয়েছে পাকিস্তান (২৮ জন) ও ক্যামেরুনের (১৭ জন) নাগরিক। এর মধ্যে ১৪ দেশের ১৩৭ নাগরিক বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তারও হয়েছেন। এঁদের বেশির ভাগই এ দেশে এসেছেন ব্যবসায়িক ও ভ্রমণ ভিসায়। কেউ কেউ ‘অন অ্যারাইভাল’ ভিসায় এসে অবৈধভাবে রয়ে গেছেন।
তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বিদেশিদের অনেকে বাংলাদেশে ঢুকেই পাসপোর্ট নষ্ট করে ফেলেন, আবার অনেকে ভিসার মেয়াদ শেষ হলে পাসপোর্ট ফেলে দেন অথবা পাসপোর্ট হারানোর কথা বলে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। এরপর জিডির সুবাদে অবৈধভাবে থাকার সুযোগ নেন। গ্রেপ্তার বা মামলার আসামি হলে বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার সুযোগ নিয়েও তাঁরা এ দেশে থেকে যাওয়ার সুযোগ নেন।
এ ব্যাপারে পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি-অপারেশনস) মো. আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ভিসার মেয়াদ পার হওয়া বিদেশিদের অবৈধ হিসেবে গণ্য করা হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া অভিযান চালিয়ে অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িত বিদেশিদের গ্রেপ্তারও করা হচ্ছে।
পুলিশ সূত্র জানায়, প্রতারণা বা জালিয়াতিতে জড়িত বিদেশিদের সহযোগিতা করছে এ দেশের একশ্রেণির অপরাধী।
অবৈধভাবে আছে ৪২ হাজার বিদেশি
পুলিশের অভিবাসন (ইমিগ্রেশন) শাখাসহ সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে, ৮৬ হাজার ৯৬২ জন বিদেশি নাগরিক এখন বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। এঁদের মধ্যে ৪২ হাজার ৪২৯ জনের ভিসার মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। তাঁরা এখন অবৈধভাবে আছেন। এঁদের বড় অংশ ব্যবসা, ভ্রমণ, শিক্ষার্থী ও খেলোয়াড় ভিসায় এ দেশে প্রবেশ করেছেন। অবৈধভাবে বসবাসকারী বিদেশিদের মধ্যে ৫ হাজার ৫৯৭ জন এসেছেন অন অ্যারাইভাল বা পোর্ট এন্ট্রি ভিসায় (বিমানবন্দরে নামার পর ভিসা নেন)।
■ দেশে বর্তমানে বিদেশি নাগরিকের সংখ্যা ৮৬,৯৬২
■ এর মধ্যে ভিসার মেয়াদ উত্তীর্ণ ৪২,৪২৯ জনের।
■ নানা অপরাধে গ্রেপ্তার ১৪ দেশের ১৩৭ জন।
■ এখন কারাগারে ৫১ জন, বাকিরা জামিনে মুক্ত।
অবৈধভাবে বসবাসকারীদের একটা বড় অংশ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে তথ্য আছে। আবার একটা অংশ প্রতারণাসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়াচ্ছেন। এর মধ্যে নাইজেরিয়া, ক্যামেরুন, মালি, কঙ্গো, তানজানিয়া, ঘানা, গিনি, উগান্ডা, ইথিওপিয়া, অ্যাঙ্গোলা, পেরু, আলজেরিয়া, চীন ও ইউক্রেন—এই ১৪ দেশের ১৩৭ জন গ্রেপ্তারও হয়েছেন। এঁদের মধ্যে ৫১ জন এখনো কারাগারে। বাকিরা জামিনে মুক্ত আছেন।
পুলিশ সূত্র জানায়, প্রতারণা বা জালিয়াতিতে জড়িত বিদেশিদের সহযোগিতা করছে এ দেশের একশ্রেণির অপরাধী।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন মামলায় গত ১০ বছরে আসামি হয়েছেন ৩৩ দেশের ৭২৬ নাগরিক। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নাইজেরিয়ার, ৯১ জন।
প্রতারণার নানা ধরন
মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানের এক নারীর সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইনস্টাগ্রামে এক বিদেশির পরিচয় হয়। এরপর তাঁদের মধ্যে আলাপচারিতা হতে থাকে। গত ১৭ মে ওই নারীকে বলা হয়, তাঁর ঠিকানায় মূল্যবান উপহার পাঠানো হয়েছে। ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সেটি তাঁকে গ্রহণ করতে হবে। পরদিন বিমানবন্দরের শুল্ক কর্মকর্তা (কাস্টমস অফিসার) পরিচয় দিয়ে এক নারী তাঁকে ফোন করে বলেন তাঁর নামে একটি অতি মূল্যবান পার্সেল বিমানবন্দরে এসেছে। সেটি গ্রহণ করতে শুল্ক হিসেবে ৬০ হাজার টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধ করতে হবে। সে অনুযায়ী তাঁর দেওয়া ব্যাংক হিসাবে ৩৫ হাজার টাকা পাঠান সিরাজদিখানের ওই নারী।
এরপর তাঁকে আবারও নিরাপত্তার (সিকিউরিটি) জন্য আরও ৩০ হাজার টাকা পরিশোধ করতে বলেন শুল্ক কর্মকর্তা পরিচয়দানকারী নারী। সে টাকাও পাঠানো হয়। এরপর শুল্ক কর্মকর্তা পরিচয় দেওয়া নারী জানান, পার্সেল সিরাজদিখানে প্রাপকের বাসায় পৌঁছে যাবে। পরে তিনি পার্সেল পেতে আবার যোগাযোগ করলে নানা কথা বলে তাঁকে আরও ৮ হাজার ৩২০ টাকা অনলাইন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পাঠাতে বলা হয়। এতে ভুক্তভোগী নারীর সন্দেহ হয় এবং বিষয়টি তিনি র্যাব-১০-কে জানান। এরপর র্যাব প্রতারণায় জড়িত নাইজেরিয়ার দুই নাগরিক চার্লস ইফেন্নাদি উদিজো ও ফ্রাঙ্ক কোকো ওবিয়ারকস এবং তাঁদের দুই বাংলাদেশি সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে।
‘অনলাইনে দিনে ২০ মিনিট কাজ করে মাসে ১৮ হাজার টাকা আয় করুন’—এমন বিজ্ঞাপনের ফাঁদে কেউ পা দিলে কৌশলে তাঁর কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিতেন তাঁরা।
র্যাব-১০-এর পরিচালক অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, চার্লস উদিজো ও ফ্রাঙ্ক কোকো জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন, ২০১৯ সালে তাঁরা ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে এসেছিলেন। ঢাকা বিমানবন্দরে নামার পর তাঁরা পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেলেন। চার্লস উদিজো ঢাকায় তাঁর বিরুদ্ধে মাদকের আরেকটি মামলা থাকার কথাও স্বীকার করেন।
র্যাবের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, নাইজেরিয়ার নাগরিকেরা সহজে বাংলাদেশ থেকে যেতে চান না। তাঁরা চান তাঁদের নামে মামলা হোক, তাহলে তাঁরা দীর্ঘদিন এখানে থেকে যেতে পারবেন। তাঁদের দেশে ফেরত পাঠাতে হলে বাংলাদেশ সরকারের খরচে পাঠাতে হবে। এটাও সরকারের জন্য বাধা।
যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কোম্পানি অ্যামাজনের আদলে ওয়েবসাইট খুলে চটকদার বিজ্ঞাপন প্রচার করতেন চীনের দুই নাগরিক ঝ্যাং পিং ও ঝ্যাং ইরউয়া। ‘অনলাইনে দিনে ২০ মিনিট কাজ করে মাসে ১৮ হাজার টাকা আয় করুন’—এমন বিজ্ঞাপনের ফাঁদে কেউ পা দিলে কৌশলে তাঁর কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিতেন তাঁরা। গত ২ আগস্ট চট্টগ্রামের সাতকানিয়া থেকে এই দুজনসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একটি দল। প্রতারণার শিকার সাবেক এক সরকারি কর্মকর্তার করা মামলার তদন্তে গিয়ে এই চক্রের খোঁজ পায় ডিবি। চক্রটি তিন মাসে অন্তত দুই হাজার মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছে বলে জানান ডিবির উপকমিশনার ইকবাল হোসাইন (বর্তমানে ওয়ারী বিভাগে কর্মরত)।
পাসপোর্ট অধিদপ্তর ও ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের কাছে অবৈধ বিদেশিদের তালিকা রয়েছে।র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মেসেঞ্জারের মাধ্যমে প্রতারণার অভিযোগে গত বছরের ২৭ আগস্ট রাজধানীর কাওলা থেকে নাইজেরিয়া ও ঘানার চার নাগরিককে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। তাঁদের কাছে কোনো পাসপোর্ট পাওয়া যায়নি।
এর চার মাস আগে গত বছরের ২০ এপ্রিল অনলাইন প্রতারণার অভিযোগে পল্লবী ও ভাটারা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় এক বাংলাদেশি সহযোগীসহ ১২ জন নাইজেরিয়ার নাগরিককে। এঁরা খেলোয়াড় ও ব্যবসায়িক ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন। ভিসার মেয়াদ পার হলেও তাঁরা অবৈধভাবে থেকে যান।
ঢাকায় ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতির অভিযোগে পান্থপথের একটি হোটেল থেকে ২০২১ সালে ইউক্রেনের ছয় নাগরিককে গ্রেপ্তার করে ডিবি। জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর গোপনে নিজ দেশে চলে যান তাঁরা।
অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িত বিদেশিদের আইনের আওতায় আনার বিষয়ে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন প্রথম আলোকে বলেন, পাসপোর্ট অধিদপ্তর ও ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের কাছে অবৈধ বিদেশিদের তালিকা রয়েছে।
তালিকাটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দিয়ে তাঁদের আইনের আওতায় আনার নির্দেশনা দিলে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া যায়। এ ছাড়া সরকার অবৈধ বিদেশিদের সময় বেঁধে দিয়ে এর মধ্যে ভিসার মেয়াদ নবায়ন না করলে তাঁদের দেশ ছাড়ার নির্দেশ দিতে পারে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যাঁরা ভিসা নবায়ন করবেন না, তালিকা ধরে তাঁদের আইনের আওতায় আনা যাবে।