৫ কাউন্সিলরসহ ৬৪ ‘বড় ভাইয়ের’ প্রশ্রয়ে চট্টগ্রামে কিশোর গ্যাং
পুলিশের হিসাবে চট্টগ্রাম নগরজুড়ে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য ১৪০০। এরা নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের।
চট্টগ্রাম নগরে এখন সক্রিয় রয়েছে অন্তত ২০০ কিশোর গ্যাং। একেক দলে রয়েছে ৫ থেকে ১৫ জন। নগরজুড়ে এদের সদস্যসংখ্যা অন্তত ১ হাজার ৪০০। নগর পুলিশের ১৬টি থানা থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে।
পুলিশ বলছে, কিশোর গ্যাং পৃষ্ঠপোষকতা বা প্রশ্রয় দিচ্ছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৫ জন ওয়ার্ড কাউন্সিলরসহ ৬৪ ‘বড় ভাই’। নগরের গুরুত্বপূর্ণ ৪৫টি এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেন তাঁরা।
এলাকায় নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে খুনোখুনি থেকে শুরু করে জায়গা দখল, অপহরণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মারামারি, অস্ত্রবাজি, উত্ত্যক্তসহ নানা অপরাধে জড়িয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এদের বেশির ভাগই নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের। নামে কিশোর গ্যাং হলেও দলে ২০ থেকে ৩২ বছর বয়সীরাও রয়েছেন।
র্যাব–পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, উঠতি তরুণদের দলে ভেড়াতে ‘বড় ভাইয়েরা’ প্রশ্রয় দেন। মূলত এলাকায় চাঁদা আদায়ের জন্য আধিপত্য বজায় রাখতে তাঁরা কিশোর গ্যাং গড়ে তোলেন। চাঁদার একটি অংশ ব্যয় হয় গ্যাংয়ের সদস্যদের পেছনেও।
২০১৮ সালে নগরের জামাল খান এলাকায় স্কুলছাত্র আদনান ইসফারকে গুলি করে খুনের ঘটনার পর নগরে কিশোর গ্যাং আলোচনায় আসে। এর পরের বছর নগর পুলিশ কিশোর গ্যাংয়ের তালিকা করে। এর পর থেকে গত ছয় বছরে ৫৪৮টি অপরাধের ঘটনায় কিশোর গ্যাং জড়িত বলে জানায় পুলিশ। এর মধ্যে খুনের ঘটনা ঘটেছে ৩৪টি।
র্যাব–পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, উঠতি তরুণদের দলে ভেড়াতে ‘বড় ভাইয়েরা’ প্রশ্রয় দেন। মূলত এলাকায় চাঁদা আদায়ের জন্য আধিপত্য বজায় রাখতে তাঁরা কিশোর গ্যাং গড়ে তোলেন। চাঁদার একটি অংশ ব্যয় হয় গ্যাংয়ের সদস্যদের পেছনেও।
২০১৯ সালে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের করা তালিকায় কিশোর গ্যাংয়ের প্রশ্রয়দাতা ছিলেন ৪৮ জন, যাঁরা এলাকায় ‘বড় ভাই’ হিসেবে পরিচিত। সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশ নতুন করে তালিকা না করলেও বিভিন্ন ঘটনা ও মামলার তদন্ত করতে গিয়ে নতুন কমপক্ষে ১৬ জন ‘বড় ভাইয়ের’ খোঁজ পেয়েছে। গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এলাকাভিত্তিক কিশোর গ্যাংয়ের প্রধানসহ ১৮৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব-পুলিশ।
নগর পুলিশ কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় বলেন, পুলিশের একার পক্ষে এটি রোধ করা সম্ভব নয়। সমাজের সচেতন ব্যক্তিদের এগিয়ে আসতে হবে। তবে কোনো অপরাধীকে ছাড় নয়।
কিশোর অপরাধের মামলাও বেড়েছে চট্টগ্রাম আদালতে। বর্তমানে ২ হাজার ২৩২টি মামলা বিচারাধীন। এসব মামলার বেশির ভাগ কিশোর গ্যাং–সংক্রান্ত বলে সরকারি কৌঁসুলিরা জানিয়েছেন। অথচ তিন বছর আগে ২০২১ সালে কিশোর অপরাধের মামলা ছিল ১ হাজার ৮৮টি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ইন্দ্রজিৎ কুণ্ডু বলেন, সন্তান কার সঙ্গে মিশছে, পরিবারকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। পাশাপাশি পথশিশু–কিশোর যারা আছে, তাদের পুনর্বাসন করতে হবে।
কিশোর অপরাধের মামলাও বেড়েছে চট্টগ্রাম আদালতে। বর্তমানে ২ হাজার ২৩২টি মামলা বিচারাধীন। এসব মামলার বেশির ভাগ কিশোর গ্যাং–সংক্রান্ত বলে সরকারি কৌঁসুলিরা জানিয়েছেন। অথচ তিন বছর আগে ২০২১ সালে কিশোর অপরাধের মামলা ছিল ১ হাজার ৮৮টি।
এক কাউন্সিলরের প্রশ্রয়ে ১৪ কিশোর গ্যাং
নুর মোস্তফা ওরফে টিনু কোনো পদে না থাকলেও নিজেকে পরিচয় দেন নগর যুবলীগের নেতা হিসেবে। তিন বছর আগে অস্ত্র–গুলিসহ র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে থাকাকালে সিটি করপোরেশনের ১৬ নম্বর চকবাজার ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। তাঁর একার প্রশ্রয়ে রয়েছে ১৪টি কিশোর গ্যাং। মেহেদী হাসান নামের এক যুবককে ওয়ার্ড কার্যালয়ে নিয়ে হুমকি ও মারধরের অভিযোগে নুর মোস্তফা ও তাঁর কিশোর গ্যাং গ্রুপের পাঁচজনের বিরুদ্ধে ৩ মার্চ পাঁচলাইশ থানায় মামলা হয়। ওই মামলায় আত্মসমর্পণ করলে গত মঙ্গলবার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে তাঁকে কারাগারে পাঠান আদালত। এটি ছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে হত্যাসহ চারটি মামলা রয়েছে। কিশোর গ্যাং, চাঁদাবাজির বিষয়ে জানতে চাইলে কারাগারে যাওয়ার আগে ওয়ার্ড কাউন্সিলর নুর মোস্তফা কিশোর গ্যাং প্রশ্রয়ের কথা অস্বীকার করেন।
তবে নুর মোস্তফার প্রশ্রয়ে থাকা ১৪টি কিশোর গ্যাং ছাড়া চকবাজার এলাকায় আরও ৮টি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
৩ মার্চ করা মামলার বাদী মেহেদী হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘নুর মোস্তফার বিরুদ্ধে ভয়ে কেউ মুখ খোলেন না। সাহস করে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করে হুমকিতে আতঙ্কে আছি।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চকবাজারের কাপাসগোলায় নিমার্ণাধীন একটি ভবনমালিক বলেন, সেখানে নিমার্ণাধীন বিভিন্ন ভবনে ইট, বালুসহ নিমার্ণসামগ্রী বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি দামে নিতে হয় নুর মোস্তফার অনুসারীদের কাছ থেকে। না নিলে মালামাল ঢুকতে দেয় না তারা।
সন্তান কার সঙ্গে মিশছে, পরিবারকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। পাশাপাশি পথশিশু–কিশোর যারা আছে, তাদের পুনর্বাসন করতে হবে।চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ইন্দ্রজিৎ কুণ্ডু
অস্ত্রবাজিতে ওয়াসিম ও প্রশ্রয়ে থাকা কিশোর গ্যাং
জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রের আশপাশে অস্ত্রবাজিতে নাম জড়িয়েছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ১৩ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও নগর যুবলীগের সহসভাপতি ওয়াসিম উদ্দিন চৌধুরীর। নগরের জিইসি, পাহাড়তলী, খুলশী এলাকায় ওয়াসিমের প্রশ্রয়ে থাকা চারটি কিশোর গ্যাং রয়েছে—ব্ল্যাক শামীম, সোলেমান বাদশা, সাহেদ ও কাইয়ুম গ্রুপ।
পুলিশ সূত্র জানায়, সর্বশেষ গত ৭ জানুয়ারি নির্বাচনে নগরের একটি ভোটকেন্দ্রের বাইরে অস্ত্র উঁচিয়ে তাঁর এক অনুসারী মো. শামীমের (২৮) করা গুলিতে দুজন আহত হন। এই ঘটনার মামলায় ওয়াসিমকেও আসামি করা হয়েছে। পরে র্যাব শামীমকে গ্রেপ্তার করে।
এর আগে ২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দিন ১৩ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের আমবাগান ইউসেফ টেকনিক্যাল স্কুলের সামনে গুলিতে আলাউদ্দিন নামের এক দিনমজুর নিহত হন। এতে তাঁকে আসামি করা হয়। পরে অনুসারীরা আসামি থাকলেও বাদী তাঁর নাম প্রত্যাহারের আবেদন করেন। বিষয়টি পুলিশ তদন্ত করছে। ওয়াসিম উদ্দিন চৌধুরী প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, হয়রানি করতে আসামি করা হয়েছে।
পুলিশ জানায়, চার মামলার আসামি এসরারুর হকের প্রশ্রয়ে রয়েছে চারটি—ধামা জুয়েল, লম্বা দিদার, সোহল ও রিফাত গ্রুপ। জহুরুল হকের প্রশ্রয়ে আছে চারটি—বিল্লাল, সালাউদ্দিন, শাকিল ও আনিস গ্রুপ। জহুরুলের বিরুদ্ধেও রয়েছে পাহাড় কাটা ও হামলার চারটি মামলা। আর আবুল হাসনাত প্রশ্রয় দেন চারটি গ্রুপ—ডিশ সালাউদ্দিন, জাহিদ, নাহিদ ও তানজিদ গ্রুপ।
তালিকায় আরও তিন কাউন্সিলর
নুর মোস্তাফা, ওয়াসিম উদ্দিন ছাড়াও পুলিশের তালিকায় ৪ নম্বর চান্দগাঁও ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এসরারুর হক, ১৪ নম্বর লালখান বাজার ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি আবুল হাসনাত ওরফে বেলাল, ৯ নম্বর উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের কাউন্সিলর (সাময়িক বরখাস্ত) জহুরুল আলম ওরফে জসিমের বিরুদ্ধেও রয়েছে কিশোর অপরাধী চক্রের পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ।
পুলিশ জানায়, চার মামলার আসামি এসরারুর হকের প্রশ্রয়ে রয়েছে চারটি—ধামা জুয়েল, লম্বা দিদার, সোহল ও রিফাত গ্রুপ। জহুরুল হকের প্রশ্রয়ে আছে চারটি—বিল্লাল, সালাউদ্দিন, শাকিল ও আনিস গ্রুপ। জহুরুলের বিরুদ্ধেও রয়েছে পাহাড় কাটা ও হামলার চারটি মামলা। আর আবুল হাসনাত প্রশ্রয় দেন চারটি গ্রুপ—ডিশ সালাউদ্দিন, জাহিদ, নাহিদ ও তানজিদ গ্রুপ। তাঁরা প্রত্যেকের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। তিনজনই দাবি করেন, তাঁদের কোনো কিশোর গ্যাং নেই।
এলাকায় প্রভাব বাড়ানোর জন্য যাঁরা কিশোরদের হাতে অস্ত্র, মাদক তুলে দিচ্ছেন, এখনই তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে; তাঁরা যে রাজনৈতিক দলেরই হোন না কেন। নইলে সবাইকে তার খেসারত দিতে হবে।সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী
কোতোয়ালি ও বায়েজিদে দৌরাত্ম্য বেশি
চট্টগ্রাম নগরের মধ্যে কোতোয়ালি ও বায়েজিদ বোস্তামী থানায় এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য বেশি বলে জানিয়েছেন পুলিশ ও স্থানীয় লোকজন। এর মধ্যে কোতোয়ালিতে ২৩টি ও বায়েজিদে আছে ১৯টি গ্রুপ।
কোতোয়ালি থানা এলাকার মধ্যে আলোচিত গ্রুপগুলোর অন্যতম চকবাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক আবদুর রউফের প্রশ্রয়ে থাকা রউফ গ্রুপ, স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা এনামুল হকের এনাম গ্রুপ, যুবলীগ নামধারী এখলাস উদ্দিনের আরমান গ্রুপ, যুবলীগ নামধারী আবদুল্লাহ আল সাইদের সাইদ গ্রুপ, যুবলীগ নামধারী মহিউদ্দিনের প্রশ্রয়ে থাকা তুষার গ্রুপ।
বায়েজিদ বোস্তামী থানার নাসিরাবাদ শিল্প এলাকা, পলিটেকনিক ও শেরশাহ এলাকায় রয়েছে নগর যুবলীগ সদস্য আবু মোহাম্মদ মহিউদ্দিনের প্রশ্রয়ে থাকা মহিউদ্দিন গ্রুপ। ওই এলাকায় রয়েছে আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে পরিচিত দিদারুল আলম, মো. শফি ও আবদুল কুদ্দুসের প্রশ্রয়ে থাকা আলাদা আলাদা গ্রুপ। আবার বায়েজিদ হিলভিউ এলাকায় জাহিদ হোসেনের জাহিদ গ্রুপ ও সাইফুল আলমের প্রশ্রয়ে রয়েছে সাইফুল গ্রুপ।
বায়েজিদ বোস্তামী থানার হিলভিউ আবাসিক কল্যাণ সমিতির সভাপতি শফিকুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রকাশ্যে অস্ত্রবাজি, কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য এখানকার নিত্যদিনের ঘটনা। ভয়ে কেউ মুখ খোলেন না। মামলাও করতে চান না।
এর বাইরে কেন্দ্রীয় যুবলীগের উপ–অর্থবিষয়ক সম্পাদক হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর, যুবলীগ নেতা নামধারী রিটু দাশ এবং কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসম্পাদক সাইফুল আলম ওরফে লিমন, লালখান বাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক দিদারুল আলম ওরফে মাসুমের প্রশ্রয়ে সিআরবি, কদমতলী, খুলশী, আমবাগান ও টাইগারপাস এলাকায় অন্তত ১০টি গ্রুপ সক্রিয়। তাঁরাও সবাই কিশোর গ্যাং প্রশ্রয়ের কথা অস্বীকার করেন। এ ছাড়া আরও ৪৩ ‘বড় ভাই’ রয়েছেন, যাঁরা কিশোর গ্যাং প্রশ্রয় দিচ্ছেন। চকবাজার, কোতোয়ালি ও বায়েজিদের বাইরে বাকি ১৩ থানায় রয়েছে ১৭৮টি গ্রুপ।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী বলেন, এলাকায় প্রভাব বাড়ানোর জন্য যাঁরা কিশোরদের হাতে অস্ত্র, মাদক তুলে দিচ্ছেন, এখনই তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে; তাঁরা যে রাজনৈতিক দলেরই হোন না কেন। নইলে সবাইকে তার খেসারত দিতে হবে।