গাজীপুরেও ভয় দেখিয়ে জমি কেনেন বেনজীর

বেনজীর আহমেদ

সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে গাজীপুরের কালীগঞ্জেও বিপুল পরিমাণ জমি কেনা হয়েছে। এসব জমির বেশির ভাগই তিনি কিনেছিলেন হিন্দু ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের লোকজনের কাছ থেকে।

বেনজীর পরিবারের সদস্যদের নামে গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরে প্রায় ৬০০ বিঘা জমি রয়েছে, যার প্রায় বেশির ভাগই হিন্দু সম্প্রদায়ের। এসব জমিসহ মোট ৬২১ বিঘা ইতিমধ্যে জব্দ করার আদেশ দিয়েছেন আদালত। এই ৬২১ বিঘা জমি ছাড়াও বেনজীরের স্ত্রী জীশান মীর্জার নামে উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরে একটি সাততলা বাড়ি ও বেনজীরের নামে ভাটারায় একটি চারতলা বাড়ির খোঁজ পেয়েছে দুদক। দুদক সূত্র বলছে, ভাটারার বাড়িটি সম্প্রতি বিক্রি করে দিয়েছেন তিনি।

গাজীপুর জেলা প্রশাসনের একটি সূত্র বলছে, কালীগঞ্জ উপজেলায় বেনজীর ও তাঁর পরিবারের প্রায় ১৮১ বিঘা জমি রয়েছে।
গোপালগঞ্জ সদর উপজেলায় সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের মালিকানাধীন সাভানা ইকোরিসোর্ট অ্যান্ড ন্যাচারাল পার্ক
ছবি: সাভানা রিসোর্টের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

গাজীপুরের কালীগঞ্জের স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, এই উপজেলার নাগরী ইউনিয়নের বেতুয়াটেক গ্রামে বেনজীর ও তাঁর স্ত্রী–সন্তানদের নামে–বেনামে অনেক জমি রয়েছে। ভয় দেখিয়ে পানির দামে এসব জমি কিনে নেন বেনজীর।

গাজীপুর জেলা প্রশাসনের একটি সূত্র বলছে, কালীগঞ্জ উপজেলায় বেনজীর ও তাঁর পরিবারের প্রায় ১৮১ বিঘা জমি রয়েছে। তবে দুদক সূত্র বলছে, তারা এখানে এ পর্যন্ত প্রায় ৫০ বিঘা জমির সন্ধান পেয়েছে। আরও জমির খোঁজে অনুসন্ধান অব্যাহত রয়েছে।

আরও পড়ুন

গাজীপুরে বেনজীর পরিবার জমি কেনা শুরু করে ২০১৭ সাল থেকে। তখন র‍্যাবের মহাপরিচালক ছিলেন তিনি। এসব জমির দলিল বিশ্লেষণ করে দুদকের কর্মকর্তারা বলছেন, গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরের মতো গাজীপুরেও তিনি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জমি কেনেন।

পরে সেই জমি মেয়েকে লিখে দেন মনসুর। একটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে প্রায় দেড় কোটি টাকা ঋণ নিয়ে সেখানে সাততলা বাড়ি বানিয়েছেন বেনজীর। তবে দুদক কর্মকর্তারা বলছেন, বাড়ি তৈরিতে ব্যাংকঋণের বাইরে আরও টাকা লেগেছে। সেই টাকার উৎসও খোঁজা হবে।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপের দক্ষিণপাড়াতে বেনজীরের জমি
ছবি: প্রথম আলো

বেনজীর আহমেদ বেশির ভাগ জমি কেনেন আইজিপি (২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর) ও র‍্যাবের মহাপরিচালক থাকার সময়ে। তিনি র‍্যাবের মহাপরিচালক ছিলেন ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত।

দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, উত্তরার সাততলা বাড়ির জমিটি রাজউক থেকে বরাদ্দ পেয়েছিলেন জীশান মীর্জার বাবা মনসুর আল-হক। পরে সেই জমি মেয়েকে লিখে দেন মনসুর। একটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে প্রায় দেড় কোটি টাকা ঋণ নিয়ে সেখানে সাততলা বাড়ি বানিয়েছেন বেনজীর। তবে দুদক কর্মকর্তারা বলছেন, বাড়ি তৈরিতে ব্যাংকঋণের বাইরে আরও টাকা লেগেছে। সেই টাকার উৎসও খোঁজা হবে।

বেনজীর তাঁদের এলাকায় প্রচুর জমি কিনছেন। অনেককে ভয় দেখিয়ে নামমাত্র দাম দিয়ে জমি লিখে নিয়েছেন। এ নিয়ে কথা বলার মতো সাহস কারও ছিল না।
খ্রিষ্টান কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লিমিটেডের সভাপতি ফিলিপ গমেজ

‘বেনজীর প্রজেক্ট’

কালীগঞ্জে বেনজীর ও তাঁর পরিবারের প্রায় ৪০টি দলিলে খুঁজে পাওয়া ৫০ বিঘা জমি জব্দ করার উদ্যোগ নিয়েছিল দুদক। কিন্তু পরে দুদক কর্মকর্তারা খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, বেশির ভাগ জমি তিনি ২০২২ সালের দিকে বিক্রি করে দিয়েছেন। এসব জমি কিনেছেন ১০ ব্যক্তি।

ঢাকার পূর্বাচল এলাকার পাশেই কালীগঞ্জ উপজেলার নাগরী ইউনিয়ন। ঢাকার খুব কাছে হওয়ায় এ এলাকায় জমির দাম দিন দিন বাড়ছে। তবে বেনজীর কিনেছিলেন খুব কম দামে।

আরও পড়ুন

দুদক কালীগঞ্জ সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে খোঁজ করে বেনজীর ও তাঁর স্ত্রী–কন্যার নামে কেনা ২০১ শতাংশ জমির ছয়টি দলিল পেয়েছে। এসব দলিল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০৮ শতাংশ জমির মধ্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের জমি ছিল ১৩১ শতাংশ এবং খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের জমি ছিল ৭৭ শতাংশ।

একটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে প্রায় দেড় কোটি টাকা ঋণ নিয়ে সেখানে সাততলা বাড়ি বানিয়েছেন বেনজীর। তবে দুদক কর্মকর্তারা বলছেন, বাড়ি তৈরিতে ব্যাংকঋণের বাইরে আরও টাকা লেগেছে। সেই টাকার উৎসও খোঁজা হবে।

স্থানীয় লোকজন প্রথম আলোকে বলেছেন, বেনজীর আহমেদ র‍্যাবের মহাপরিচালক থাকার সময় ভয় দেখিয়ে কালীগঞ্জের হিন্দু ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের জমি কিনে নেন।

কালীগঞ্জের সাব–রেজিস্ট্রার জাহিদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমরা বেনজীর ও তাঁর পরিবারের নামে ছয়টি জমির দলিল পেয়েছি। দুদক এসব সম্পদের তথ্য চেয়েছিল।’

আরও পড়ুন

বেনজীর পরিবার এসব জমি যাঁদের কাছ থেকে কেনে, তাঁরা হলেন সুধীর দাসের ছেলে সুদেব দাস; নরেশ মল্লিকের ছেলে কাশীনাথ মল্লিক, পরেশ মল্লিক ও আশুতোষ মল্লিক; সিলভেস্টার রোজারিওর ছেলে প্রদীপ রোজারিও, তাঁর মেয়ে তারামনি; লোপেজ টছকানুর ছেলে হেনরি টছকানু, রিচার্ড টছকানু, রায়মন রোনাল্ড টছকানু ও দুই মেয়ে মিসেস রেবেকা কুইয়া ও রিনা টছকানু; হরেন্দ্র চন্দ্র গোপের ছেলে আশুতোষ ঘোষ ও সুশীল ঘোষ।

এখন পর্যন্ত আমরা বেনজীর ও তাঁর পরিবারের নামে ছয়টি জমির দলিল পেয়েছি। দুদক এসব সম্পদের তথ্য চেয়েছিল।
কালীগঞ্জের সাব–রেজিস্ট্রার জাহিদুর রহমান

বেনজীর যাঁদের কাছ থেকে জমি কিনেছেন, তাঁদের একজন সুশীল মন্ডল। তাঁর বাড়ি পুইন্নারটেক গ্রামে। ঢাকার তাঁতীবাজারে স্বর্ণ ব্যবসা রয়েছে তাঁর। ওই এলাকায় তিনিই প্রথম বেনজীর আহমেদের কাছে জমি বিক্রি করেন। গতকাল তিনি প্রথম আলোকে বলেন, করোনাকালের আগের কথা। স্থানীয় জমির দালাল আবদুল মোমেনের মাধ্যমে তিনি ৯ বিঘা জমি বেনজীর পরিবারের কাছে বিক্রি করেন। বিঘাপ্রতি তিনি পেয়েছেন ১৫ লাখ টাকা করে।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, তাঁদের এলাকায় বেনজীর পরিবারের দেড় শ বিঘার বেশি জমি রয়েছে। পরিবারের সদস্য ছাড়াও বেনজীরের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা ও তাঁদের আত্মীয়স্বজনের নামেও সেখানে জমি রয়েছে। এলাকার মানুষ এলাকাটির নাম দিয়েছেন ‘বেনজীরের প্রজেক্ট’।

বেনজীরের জমি কেনা প্রসঙ্গে নাগরী খ্রিষ্টান কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লিমিটেডের সভাপতি ফিলিপ গমেজ প্রথম আলোকে বলেন, বেনজীর তাঁদের এলাকায় প্রচুর জমি কিনছেন। অনেককে ভয় দেখিয়ে নামমাত্র দাম দিয়ে জমি লিখে নিয়েছেন। এ নিয়ে কথা বলার মতো সাহস কারও ছিল না।

পরিবারের দেড় শ বিঘার বেশি জমি রয়েছে। পরিবারের সদস্য ছাড়াও বেনজীরের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা ও তাঁদের আত্মীয়স্বজনের নামেও সেখানে জমি রয়েছে। এলাকার মানুষ এ