বারবার চক্র, বারবার বন্ধ মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার
মালয়েশিয়ায় আগামীকাল থেকে আর কর্মী যাবে না। ২০০৯, ২০১৬ ও ২০১৮ সালেও বন্ধ হয়েছিল দেশটির শ্রমবাজার। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে প্রথম আলো। আজ প্রকাশিত হলো শেষ পর্ব।
১৫ বছরে তিন দফায় মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের শ্রমবাজার বন্ধ হয়েছে। প্রতিবারই শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে চক্র বা সিন্ডিকেট গঠনের বিষয়টি সামনে এসেছে। এরপর চক্রের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি ও ঘুষের অভিযোগ ওঠে।
২০০৯ সালে প্রথম দফায় বন্ধ হয় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। এরপর ২০১৬ সালের শেষে খোলা হয় বাজারটি। তখন বাংলাদেশের ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সি চক্র গড়েছিল। দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে আবার বন্ধ হয়ে যায় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার।
আমাদের এখানে সিন্ডিকেট থাকতে পারে, যা বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া উভয় সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।হাজনাহ মো. হাশিম, ঢাকায় নিযুক্ত মালয়েশিয়ার হাইকমিশনার
২০২২ সালে আবার মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলে। তখন আবারও চক্র গঠন করা হয়। গত মার্চে মালয়েশিয়া জানায়, দেশটি আপাতত আর শ্রমিক নেবে না। যাঁরা অনুমোদন পেয়েছেন, ভিসা পেয়েছেন, তাঁদের ৩১ মের (আজ শুক্রবার) মধ্যে মালয়েশিয়ায় ঢুকতে হবে।
মালয়েশিয়া বাংলাদেশের বড় শ্রমবাজার। গত দেড় বছর সৌদি আরবের পর সবচেয়ে বেশি কর্মী গেছে মালয়েশিয়ায়, সাড়ে চার লাখের বেশি। শ্রমবাজারটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের প্রবাসী আয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা আছে।
মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজার নিয়ন্ত্রণে নাম এসেছে মালয়েশিয়ার নাগরিক আমিন নূর এবং বাংলাদেশের রুহুল আমিন ওরফে স্বপনের।
চক্রের ‘হোতা’ আমিন
সর্বশেষ মালয়েশিয়া ২০২২ সালে শ্রমবাজার খোলার আগে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক সই করে। তখন প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় সব এজেন্সির জন্য কর্মী পাঠানোর সুযোগ উন্মুক্ত রাখার ওপর জোর দেয়নি; বরং তারা এজেন্সি নির্ধারণের দায়িত্ব দেয় মালয়েশিয়াকে।
বাংলাদেশের এজেন্সি চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো মানদণ্ড ছিল না। সুযোগটি নিয়েছে মালয়েশিয়ার কর্মী নিয়োগের ফরেন ওয়ার্কার্স সেন্ট্রাল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের (এফডব্লিউসিএমএস) সফটওয়্যার মাইগ্রামের মালিক প্রতিষ্ঠান বেস্টিনেট। এটির মালিকানায় রয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমিনুল ইসলাম বিন আবদুল নূর। তিনি মালয়েশিয়ার নাগরিক, আমিন নূর নামে পরিচিত।
অভিযোগ রয়েছে, মালয়েশিয়া থেকে আমিন নূর কর্মী পাঠানোর পুরো বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করেন। বাংলাদেশে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন রিক্রুটিং এজেন্সি মালিকদের সংগঠন বায়রার সাবেক মহাসচিব রুহুল আমিন ওরফে স্বপন। তাঁরা দুজন মিলে চক্রে কারা থাকবে, তা নির্ধারণ করেছেন।
শুরুতে মালয়েশিয়ার কর্মী পাঠানোর চক্রে ছিল ২৫টি এজেন্সি। এরপর ধাপে ধাপে মোট ১০০ বেসরকারি এজেন্সি অনুমোদন পায়, এর সঙ্গে যুক্ত হয় সরকারি এজেন্সি বোয়েসেল। যদিও অন্য কোনো দেশে কর্মী নেওয়ার ক্ষেত্রে এভাবে এজেন্সি ঠিক করে দেয় না মালয়েশিয়া।
চক্র লাভবান যেভাবে
মালয়েশিয়া থেকে কোনো কর্মীর চাহিদাপত্র চূড়ান্ত হলে তা এফডব্লিউসিএমএস সফটওয়্যারের মাধ্যমে অনুমোদিত এজেন্সির মধ্যে বণ্টন করা হয়। এটি সমানভাবে বণ্টন করা হয়নি। বিভিন্ন এজেন্সি বিভিন্ন রকম চাহিদাপত্র পেয়েছে। যে এজেন্সির নামে চাহিদাপত্র আসে, তাদের মাধ্যমে কর্মী পাঠাতে হয়।
তবে তালিকায় না থাকা রিক্রুটিং এজেন্সিও মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠিয়েছে। এমন তিনটি এজেন্সির মালিকেরা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর ব্যবসা দীর্ঘদিনের। তাই সেখানকার কোম্পানি থেকে চাহিদাপত্র আসে। তারা এটি সংগ্রহ করলেও এফডব্লিউসিএমএসে তাঁদের নাম নেই। সেই চাহিদাপত্র তালিকায় থাকা কোনো এজেন্সির কাছে চলে যায়। এরপর তারা (চক্রের বাইরে থাকা এজেন্সি) সেই এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করে। প্রতি কর্মীর জন্য ১ লাখ ৫২ হাজার থেকে ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা দিতে হয় তালিকায় থাকা এজেন্সিকে। এভাবে চাহিদাপত্র সংগ্রহ না করে বা কোনো কর্মী না পাঠিয়ে তালিকায় থাকার সুযোগে আয় করেছে চক্রে থাকা এজেন্সিগুলো।
বায়রার একাধিক সদস্যের অভিযোগ, কর্মীর খরচের একটি অংশ গেছে রুহুল আমিন ওরফে স্বপনের কাছে, যার একটি অংশ হুন্ডির মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় পাচার হয়েছে। বাকিটা পেয়েছে ওই এজেন্সি, যার নামে কর্মী পাঠানো হচ্ছে। তবে সব ক্ষেত্রে নগদ টাকা লেনদেন হয়েছে কোনো রসিদ ছাড়া।
অভিযোগের বিষয়ে বায়রার সাবেক মহাসচিব রুহুল আমিন গতকাল রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ভাবমূর্তি ম্লান করার জন্য এসব মিথ্যা অভিযোগ করা হয়েছে। সরকার নির্ধারিত ফি ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকার বাইরে কোনো বাড়তি টাকা নেওয়া হয়নি। মালয়েশিয়াতেও কোনো টাকা পাঠানো হয়নি। বেস্টিনেটের সঙ্গে তাঁর কোনো অংশীদারত্ব নেই বলেও দাবি করেন তিনি।
মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে সরকার নির্ধারিত সর্বোচ্চ খরচ ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা। তবে এক গবেষণা বলছে, কর্মীর খরচ হয়েছে গড়ে ৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকা।
চক্রে থাকা এজেন্সিগুলো বলছে, শ্রমিকদের বাড়তি খরচের দায় চক্রের বাইরে থাকা এজেন্সির। অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমে তারা চড়া দামে মালয়েশিয়া থেকে কর্মীর চাহিদাপত্র কিনে ভিসা বাণিজ্য করেছে।
রিক্রুটিং এজেন্সি ফাইভ এম ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ফেনী-৩ আসনের সংসদ সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) মাসুদউদ্দিন চৌধুরী গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ব্যবসায়ীরা অবৈধ ভিসা বাণিজ্য করতে মালয়েশিয়ায় ঝাঁপিয়ে না পড়লে শ্রমিকদের খরচ নিয়ন্ত্রণ করা যেত। তিনি নিজে ১০০ কাজও কেনেননি। সবই এসেছে সফওয়্যারের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিভাবে। যাদের কাজ এসেছে, তারা ফাইভএমের মাধ্যমে কর্মী পাঠিয়েছে। তাঁর এজেন্সি শুধু ভিসা প্রক্রিয়াকরণের কাজটি করেছে। তাঁর প্রতিষ্ঠান বাড়তি কোনো টাকা নেয়নি। সরকার নির্ধারিত ফি নিয়েছে।
দায় এড়াতে লিখিত প্রতিশ্রুতি
কর্মী না পাঠালেও সরকারি নথিতে কর্মী যাচ্ছে চক্রে থাকা এজেন্সির নামে। তাই সব দায় তাদেরই নেওয়ার কথা। কিন্তু দায় এড়াতে তারা কর্মী পাঠানো রিক্রুটিং এজেন্সির কাছ থেকে লিখিত প্রতিশ্রুতি নিচ্ছে। প্রথম আলো এমন একাধিক লিখিত প্রতিশ্রুতির কাগজ সংগ্রহ করেছে। এতে দেখা যায়, কর্মী চাকরি না পেলে বা যেকোনো দায়দায়িত্ব নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে লিখিত আবেদন করেছে ‘সাব-এজেন্ট’ বা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করা রিক্রুটিং এজেন্সি। যদিও সরকারি কোনো নথিতে তাদের নাম নেই কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে।
একক এজেন্সি হিসেবে ৭ হাজার ৭৪৫ কর্মী পাঠিয়েছে সরকার ইন্টারন্যাশনাল। এর স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ আলী সরকার প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা মালয়েশিয়া থেকে চাহিদা পেয়েছেন, তাঁদের অনেকেই তাঁর এজেন্সির মাধ্যমে পাঠিয়েছেন। তবে কর্মীর দায়িত্বের বিষয়ে এজেন্সির কাছ থেকে লিখিত প্রতিশ্রুতি নেওয়া হয়েছে। এতে কোনো বাড়তি টাকা নেওয়া হয়নি। সরকার নির্ধারিত টাকা নেওয়া হয়েছে।
অবশ্য চক্রে না থাকা রিক্রুটিং এজেন্সি বলছে, বিনা টাকায় কোনো এজেন্সি তাদের মাধ্যমে কর্মী পাঠাতে দেয় না। শুধু ওদের নাম ব্যবহার করতেই বহু টাকা দিতে হয়।
বায়রার যুগ্ম মহাসচিব ফখরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, রিক্রুটিং এজেন্সির তালিকা করার ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট নিয়মনীতি ছিল না। তাই কর্মী পাঠানোর কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই মূল হোতাদের যোগসাজশে তালিকায় নাম লিখিয়েছেন কেউ কেউ। এরপর ঘরে বসে বসে টাকা আয় করেছেন। কর্মীপ্রতি ১ লাখ ৫২ হাজার টাকা নিচ্ছে চক্রে থাকা এজেন্সি।
শ্রমিকের সঙ্গে প্রতারণা
সুদে ঋণ নিয়ে দালালের মাধ্যমে ৫ লাখ ২০ হাজার টাকা খরচ করে গত নভেম্বরে মালয়েশিয়া যান নরসিংদীর নায়েম উদ্দিন। টাইলস কারখানায় কাজ দেওয়ার কথা ছিল, দিয়েছে এক কোম্পানির নির্মাণশ্রমিকের কাজ। ১৫ দিন পর তাঁর কাজ বন্ধ করে দেয় কোম্পানি। এরপর আরও আড়াই মাস এক অফিসে নিয়ে রাখা হয়। হঠাৎ করে তাঁকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে না পারায় এখন দুঃসহ জীবন যাপন করতে হচ্ছে।
মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানো নিয়ে বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় আলাদা করে কোনো তদন্ত করছে না বলে জানা গেছে। তবে এসব অভিযোগ নিয়ে দুই দেশের যৌথ কারিগরি কমিটির সভায় আলোচনা করতে চায় মন্ত্রণালয়। ইতিমধ্যে সভা আহ্বানের অনুরোধ করে মালয়েশিয়ায় চিঠি পাঠানো হয়েছে। সভার তারিখ এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
বিনা খরচে পাঠানোর সুযোগ ব্যাহত
মালয়েশিয়ায় ১০ হাজারের বেশি কর্মী পাঠানোর চাহিদা পেয়েছিল সরকারি রিক্রুটিং এজেন্সি বোয়েসেল। তবে গত ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত মাত্র ১ হাজার ৪৬৭টি ছাড়পত্র নিয়েছে তারা।
বোয়েসেলের দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, বেসরকারি এজেন্সি কর্মী পাঠিয়েছে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকায়। বোয়েসেলের মাধ্যমে কর্মী গেছেন বিনা পয়সায়, নিয়োগকর্তার খরচে। তাই নানাভাবে বাধা এসেছে। চাহিদাপত্র চলে গেছে অন্য এজেন্সির নামে, সেটি আবার ফিরিয়ে আনতে সময় লেগেছে। বিভিন্ন বাধা সামলে বেশি কর্মী পাঠানো যায়নি।
শাস্তি হয় না
২০২২ সালে যখন মালয়েশিয়া চক্র গঠন করা হয়, তার আগে সাধারণ রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকেরা আন্দোলন করেছিলেন। চক্র গঠন ঠেকাতে দেশে ও মালয়েশিয়ায় একাধিক অভিযোগ করেছিলেন বায়রার সদস্য মোস্তফা মাহমুদ। তিনি দীর্ঘদিন ধরে মালয়েশিয়ার সঙ্গে ব্যবসা করেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ২০১৭ সালে দেশে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও মালয়েশিয়ার দুর্নীতিবিরোধী কমিশনে (এমএসিসি) কয়েকটি এজেন্সি মিলে দুটি আলাদা অভিযোগ করে। অভিযুক্তরা বেসরকারি খাতের বলে দুদক এটি নিয়ে আর এগোয়নি। প্রভাব খাটিয়ে মালয়েশিয়ার তদন্ত থামিয়ে দিয়েছেন চক্রের হোতা আমিন নূর।
মালয়েশিয়ায়ও এভাবে চক্র গঠন নিয়ে সমালোচনা আছে। গত বুধবার ঢাকায় নিযুক্ত মালয়েশিয়ার হাইকমিশনার হাজনাহ মো. হাশিম এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমাদের এখানে সিন্ডিকেট থাকতে পারে, যা বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া উভয় সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।’
অভিবাসন খাতের বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান রামরুর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার তাসনিম সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, চক্রের বাইরে মালয়েশিয়া কর্মী নিতে রাজি না হলে তাদের পাঠানোর কোনো দরকার ছিল না।