কুমিল্লায় দুর্বৃত্তায়নের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন আওয়ামী গডফাদার বাহার
অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী, খুনের মামলার আসামি ও তালিকাভুক্ত মাদক কারবারি—এই তিন শ্রেণির মানুষকে সব সময় নিজের আশপাশে রাখতেন কুমিল্লা-৬ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিন বাহার। যে কারণে মানুষ তাঁকে ভয় পেত। এর মধ্য দিয়ে কুমিল্লা শহর ও আশপাশের এলাকার রাজনীতি ও অপরাধ—দুটোই নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। তাঁর দাপট এতটাই ছিল যে আওয়ামী লীগের নেতারাও এখন বলছেন, কুমিল্লা শহরে কোনটি ‘ন্যায়’ আর কোনটি ‘অন্যায়’, সেটিও তিনি ঠিক করতেন। তিনি যেন কুমিল্লায় দুর্বৃত্তায়নের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন।
গত ১৫ বছরে আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার নিজের অনুসারী ও ঘনিষ্ঠজনদের দলীয় বিভিন্ন পদে বসিয়েছেন। তাঁদের অনেককে জনপ্রতিনিধি বানিয়েছেন। জ্যেষ্ঠ নেতাদের বঞ্চিত করে নিজের মেয়ে তাহসীন বাহারকে প্রথমে কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক করেন। গত মার্চ মাসে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র পদের উপনির্বাচনে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে তাহসীনকে কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী ঘোষণা করেন তিনি।
গত ১৫ বছর কুমিল্লায় কোনটি ‘ন্যায়’ আর কোনটি ‘অন্যায়’, সেটিও ঠিক করতেন বাহার। দখল, চাঁদাবাজি, ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ, নিজ দলের বিরোধী পক্ষকে দমনসহ নানা অপকর্ম করেছেন বাহারের ঘনিষ্ঠরা। গত ১৫ বছরে কুমিল্লা শহরে অন্তত পাঁচজন দলীয় নেতা-কর্মী খুনে বাহারের সহযোগীরা সরাসরি জড়িত।
তবে মেয়র হলেও তাহসীন বেশি দিন দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। গণ-অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাবা বাহারের সঙ্গে তিনিও পালিয়ে যান। কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বাহার প্রথম সংসদ সদস্য হন ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। এর পর থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত আরও তিনবার কুমিল্লা-৬ (আদর্শ সদর, সিটি করপোরেশন ও কুমিল্লা সেনানিবাস) আসনের সংসদ সদস্য হন তিনি।
মহানগর আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর বিভিন্ন পর্যায়ের ১১ জন নেতার সঙ্গে সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে কুমিল্লায় গিয়ে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা বলছেন, বাহারের বিরোধিতা করায় গত ১৫ বছরে হামলার (কাউকে কোপানো হয়েছে, কাউকে গুলি করা হয়েছে) শিকার হয়েছেন কমপক্ষে ২০ নেতা-কর্মী। তাঁদের মধ্যে ৭ জনের কারও হাতের, কারও পায়ের কর্মক্ষমতা হারিয়ে গেছে। গত ১৫ বছর কুমিল্লায় কোনটি ‘ন্যায়’ আর কোনটি ‘অন্যায়’, সেটিও ঠিক করতেন বাহার। দখল, চাঁদাবাজি, ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ, নিজ দলের বিরোধী পক্ষকে দমনসহ নানা অপকর্ম করেছেন বাহারের ঘনিষ্ঠরা। গত ১৫ বছরে কুমিল্লা শহরে অন্তত পাঁচজন দলীয় নেতা-কর্মী খুনে বাহারের সহযোগীরা সরাসরি জড়িত।
কুমিল্লা ক্লাবের নিয়ন্ত্রণও বাহারের কাছে ছিল। তাঁর সম্মতি ছাড়া কেউ কুমিল্লা ক্লাবের সদস্য হতে পারতেন না। আর ঐতিহ্যবাহী টাউন হল ভেঙে বাহার বহুতল বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণের চেষ্টা করছিলেন।
কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা নূর উর রহমান মাহমুদ (তানিম) একসময় বাহারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কুমিল্লায় ঠিকাদারি, দখলবাজি থেকে শুরু করে নানা ধরনের অপকর্ম করেছেন বাহার। তাঁর বিরোধিতা করায় দলের অনেক নেতা-কর্মীকে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। কেউ কেউ পঙ্গু হয়ে গেছেন। কয়েকজন খুনও হয়েছেন। এসব ঘটনার পেছনের লোকটি সাবেক সংসদ সদস্য বাহার।
গণ-অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পরপরই বিক্ষুব্ধ জনতা কুমিল্লা শহরের মুন্সেফবাড়ি এলাকায় বাহারের বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেন। বাড়ির গ্যারেজে থাকা তিনটি গাড়িও তখন পুড়িয়ে দেওয়া হয়। আগুন দেওয়া হয় কুমিল্লা শহরের রামঘাট এলাকায় আওয়ামী লীগের নতুন কার্যালয়েও (১০ তলা ভবন)। বিরোধপূর্ণ জমি দখলে নিয়ে দলীয় কার্যালয় নির্মাণ করেছিলেন বাহার। ওই দিন বিক্ষুব্ধ জনতা কুমিল্লা ক্লাব এবং টাউন হলেও আগুন দিয়েছেন। কুমিল্লা ক্লাবের নিয়ন্ত্রণও বাহারের কাছে ছিল। তাঁর সম্মতি ছাড়া কেউ কুমিল্লা ক্লাবের সদস্য হতে পারতেন না। আর ঐতিহ্যবাহী টাউন হল ভেঙে বাহার বহুতল বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণের চেষ্টা করছিলেন। এ নিয়েও স্থানীয় লোকজন ক্ষুব্ধ ছিলেন। ফলে আওয়ামী লীগের পতনের পর বিক্ষুব্ধ লোকজন এসব স্থাপনায় হামলা ও অগ্নিসংযোগ করেছেন।
কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক আনিসুর রহমান (মিঠু) প্রথম আলোকে বলেন, ক্ষমতায় থেকে কুমিল্লায় চূড়ান্ত পর্যায়ের দুর্বৃত্তায়ন করেছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য বাহার। এ কারণেই তাঁকে কুমিল্লা থেকে পালিয়ে যেতে হয়েছে। নিজের কৃতকর্মের জন্যই একজন রাজনীতিবিদের এমন পরিণতি হয়েছে।
বাহারের উত্থান ও খুনের রাজনীতি
স্বাধীনতা–পরবর্তী সময়ে কুমিল্লা শহরকেন্দ্রিক আওয়ামী লীগের রাজনীতি ও অপরাধজগতের অন্যতম নিয়ন্ত্রক ছিলেন আফজল খান। তখন তাঁর অনুসারী ছিলেন বাহার। তখন তিনি কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি ছিলেন। টাকার ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে আশির দশকের শুরুর দিকে আফজল খানের সঙ্গে বাহারের বিরোধ হয়। ওই সময় কুমিল্লার ছাত্রলীগের রাজনীতিতে বাহারের প্রভাব ছিল।
আশির দশকে কুমিল্লা শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন আফজল খান, বাহার ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। ১৯৮৪ সালে কুমিল্লা পৌরসভা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে আফজল খানের বিরুদ্ধে নির্বাচন করে বাহার জয়ী হন। আফজল খানের বিরোধীরা এককাট্টা হয়ে ওই নির্বাচনে বাহারকে জয়ী করেছিলেন।
১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাহার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে কুমিল্লা সদর আসন থেকে নির্বাচন করে পরাজিত হন। ১৯৯৬ সালের জুনে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি দলীয় মনোনয়ন পাননি। তবে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে পরে কুমিল্লা শহরে বাহারের প্রভাব বাড়তে থাকে। ১৯৯৮ সালে বাহারের অনুসারী ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে ছুরিকাঘাতে নিহত হন জাহিদুর রহমান ভূঁইয়া ওরফে বাবু। এই খুনে জড়িত ব্যক্তিদের সবাই বাহারের অনুসারী। এ ঘটনার তিন বছর পর ২০০১ সালের জুলাই মাসে কুমিল্লা শহরের টমছমব্রিজ এলাকায় খুন হন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল হক ওরফে দুলাল। এই খুনের ঘটনায় করা মামলায় বাহারকে আসামি করা হয়। অন্য আসামিদের মধ্যে ছিলেন বাহারের ঘনিষ্ঠ কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আরফানুল হক রিফাত, কুমিল্লা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি জহিরুল ইসলাম ওরফে রিন্টু এবং কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আহমেদ নেওয়াজ পাভেল। যদিও পরবর্তী সময়ে সাক্ষীর অভাবে এই মামলায় সব আসামি খালাস পান।
একসময় বাহারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন, এমন একজন নেতা নাম না প্রকাশ করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, দুলাল হত্যার আসামি হওয়ার পর ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতিতে আরও বেশি সক্রিয় হন বাহার। তাঁর কাছে অস্ত্রধারী ক্যাডারদের গুরুত্ব বাড়তে থাকে।
২০০৮ সালে সংসদ সদস্য হওয়ার পর আরও অন্তত ৫টি খুনে বাহারের সহযোগীরা সরাসরি জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। ২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর খুন হন কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন। তিনি দুলাল হত্যা মামলার সাক্ষী ছিলেন। পুলিশের তদন্তে উঠে আসে, দেলোয়ার হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মো. আবদুস সাত্তার। তিনি (সাত্তার) কুমিল্লা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি এবং বাহারের ঘনিষ্ঠ। ২০২০ সালের ১১ নভেম্বর শহরের চৌয়ারা এলাকায় যুবলীগের কর্মী জিল্লুর রহমান চৌধুরীকে হত্যা করে বাহারের ক্যাডাররা। পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে, এই খুনের পরিকল্পনাকারী ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মো. আবুল হাসান। বাহারের ঘনিষ্ঠ এই নেতা ওই ওয়ার্ড আওয়ামী লীগেরও সভাপতি।
জিল্লুরের ভাই ইমরান হোসেন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ভাই হত্যার বিচার চাওয়ায় তাঁকে বিএনপির কর্মী সাজিয়ে গাড়ি পোড়ানোর এবং নাশকতার মামলায় আসামি করেছেন বাহারের লোকজন।
দলীয় প্রতিপক্ষকে হামলাসহ নানাভাবে কোণঠাসা করে রাখা, দখল, প্রভাব খাটানো ও অপরাধীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার বিষয়ে সাবেক সংসদ সদস্য বাহারের বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করেছে প্রথম আলো। কিন্তু তাঁর মুঠোফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। পরে বাহারের মেয়ে ও কুমিল্লার সাবেক মেয়র তাহসীনের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সাড়া পাওয়া যায়নি।
বাহারের মেয়ে-স্ত্রী ও স্বজনদের আধিপত্য
কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সর্বশেষ কমিটি গঠিত হয় ২০২২ সালে। কমিটির সভাপতি বাহার, সাধারণ সম্পাদকের পদ পান তাঁর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত আরফানুল হক রিফাত (এখন প্রয়াত)। বাহারের মেয়ে তাহসীনকে করা হয় সাংগঠনিক সম্পাদক। তিনি কুমিল্লা মহানগর মহিলা আওয়ামী লীগেরও যুগ্ম সম্পাদক। বাহারের স্ত্রী মেহেরুন্নেছা বাহার কুমিল্লা মহানগর মহিলা আওয়ামী লীগের সদস্য এবং জেলা ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি। অথচ তিনি কখনোই রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না। বাহারের ভাতিজা সায়ের সায়েরিন মহানগর আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানবসম্পদ বিষয়ক সম্পাদক।
কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের আগের কমিটিতে একসময় গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন এমন একজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, ২০২২ সালে মূলত ‘বাহার লীগের কমিটি’ হয়েছে।
আওয়ামী লীগের পাশাপাশি সহযোগী ও অঙ্গসংগঠনগুলোর বিভিন্ন কমিটিতেও বাহারের স্বজনেরা গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়েছেন। বাহারের জামাতা সাইফুল ইসলাম ওরফে রনি মহানগর যুবলীগের সদস্য ও জেলা ক্রীড়া সংস্থার ক্রিকেট কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান। মহানগর ছাত্রলীগের আহ্বায়ক করা হয়েছে বাহারের এক ভাতিজা আব্দুল আজিজ সিহানুককে। তাঁর (সিহানুক) স্ত্রী নুসরাত জাহান মহানগর যুব মহিলা লীগের সহসম্পাদক। বাহারের আরেক ভাতিজা হাবিবুল আলামিন সাদি মহানগর যুবলীগের ১ নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক। পাশাপাশি তিনি ১২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এবং কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের সাবেক প্যানেল মেয়র। বাহারের এক চাচাতো ভাইয়ের ছেলে আকাশ ওয়াহিদ মহানগর যুবলীগের সদস্য। দূরসম্পর্কের ভাগনে জুনায়েদ সিকদার মহানগর কৃষক লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক।
দলীয় প্রতিপক্ষকে হামলাসহ নানাভাবে কোণঠাসা করে রাখা, দখল, প্রভাব খাটানো ও অপরাধীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার বিষয়ে সাবেক সংসদ সদস্য বাহারের বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করেছে প্রথম আলো। কিন্তু তাঁর মুঠোফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। পরে বাহারের মেয়ে ও কুমিল্লার সাবেক মেয়র তাহসীনের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সাড়া পাওয়া যায়নি।
মাদকের নিয়ন্ত্রণে বাহারের ঘনিষ্ঠরা
২০২২ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন বাহারের ঘনিষ্ঠ আরফানুল হক ওরফে রিফাত। অথচ ২০১৮ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কার্যালয়ের এক প্রতিবেদনে কুমিল্লা অঞ্চলের মাদক কারবারিদের শীর্ষে ছিলেন তিনি। মাদক কারবারিদের ওই তালিকার ২ নম্বরে রয়েছে আবদুল্লাহ আল মাহমুদ ওরফে সহিদ। তিনি কুমিল্লা মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক। কুমিল্লায় বাহারের ঘনিষ্ঠদের একজন তিনি। রিফাত ও সহিদ ২০০১ সালে খুন হওয়া ছাত্রলীগ নেতা দুলাল হত্যা মামলার আসামি ছিলেন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সূত্র প্রথম আলোকে জানিয়েছে, গত ১৫ বছর কুমিল্লায় মাদকের নিয়ন্ত্রণ ছিল বাহারের ঘনিষ্ঠদের কাছে। অবৈধ মাদক–বাণিজ্যের লাভের ভাগ পেতেন বাহার।
পাড়ায় পাড়ায় সন্ত্রাসী বাহিনী
২০১৭ সালে বাহারকে সভাপতি ও রিফাতকে সাধারণ সম্পাদক করে কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটি ঘোষণা করা হলেও তখন সম্মেলন হয়নি। ২০২২ সালের ৫ নভেম্বর টাউন হল মাঠে কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয়। ওই সম্মেলনের আগে কুমিল্লা আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের বিরোধ চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যায়। সেদিন বাহারের অস্ত্রধারী ক্যাডাররা বিরোধী পক্ষকে সম্মেলনস্থল টাউন হল মাঠে ঢুকতে দেয়নি।
সম্মেলন চলাকালে বাহারের সমর্থকদের সঙ্গে বিরোধী পক্ষ হিসেবে পরিচিত আফজল খানের মেয়ে আঞ্জুম সুলতানার সমর্থকদের সংঘর্ষ হয়। ওই দিন বাহারের পক্ষে থাকা ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা-কর্মীরা একের পর এক ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটান ও গুলি চালান। ওই দিনের ঘটনার একটি ভিডিও ফুটেজ ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছিল। ওই ভিডিওতে দেখা যায়, মেহেদী হাসান নামের যুবলীগের এক কর্মী শটগান থেকে গুলি ছুড়ছেন। মেহেদী কুমিল্লা মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক সহিদের সন্ত্রাসী বাহিনীর অন্যতম সদস্য। সহিদ ও মেহেদী যুবলীগের কর্মী জিল্লুর রহমান হত্যা মামলার আসামি।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সূত্রের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কুমিল্লা শহর ও আশপাশের এলাকায় বাহারের অনুসারীদের অন্তত ১৫টি বাহিনী রয়েছে। এসব বাহিনীর বিরুদ্ধে দরপত্র নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, খুন ও নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে কুমিল্লা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি জহিরুল ইসলাম ওরফে রিন্টু, মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক আবদুল্লাহ আল মাহমুদ ওরফে চিকা সহিদ, আদর্শ সদর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম ওরফে টুটুল, ভাইস চেয়ারম্যান আহমেদ নেওয়াজ ওরফে পাভেল, কুমিল্লা শহরের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহ আলম খান, ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর আবদুস ছাত্তার, ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর আবুল হাসান ও ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর আলমগীর হোসেনের বাহিনী হচ্ছে সবচেয়ে ভয়ংকর।
বাহারের অনুসারী বিভিন্ন বাহিনীর নির্যাতনের শিকার চারজনের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। এর মধ্যে একজন ছাড়া অন্যরা নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। নাম প্রকাশ করতে চান না এমন একজন জানান, তাঁকে এমনভাবে কোপানো হয় যে হাত ও পায়ের রগ কেটে গেছে। তিনি এখন ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটেন। তিনি বলেন, বাহারের অনুসারী রিন্টুর বাহিনীর সন্ত্রাসীরা তাঁকে নির্মমভাবে আহত করেছে।
পুলিশ সূত্র জানায়, ২০২০ সালের ১০ জুলাই শহরের কোটবাড়ী সড়কের চাঙ্গিনী মোড় এলাকায় সাবেক কাউন্সিলর আলমগীরের নেতৃত্বে কুপিয়ে হত্যা করা হয় ব্যবসায়ী ও আওয়ামী লীগের কর্মী আক্তার হোসেনকে। ওই খুনের পর আলমগীরকে রক্ষা করতে বাহার জোর চেষ্টা চালান বলে অভিযোগ রয়েছে।
বাহারের অনুসারী বিভিন্ন বাহিনীর নির্যাতনের শিকার চারজনের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। এর মধ্যে একজন ছাড়া অন্যরা নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। নাম প্রকাশ করতে চান না এমন একজন জানান, তাঁকে এমনভাবে কোপানো হয় যে হাত ও পায়ের রগ কেটে গেছে। তিনি এখন ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটেন। তিনি বলেন, বাহারের অনুসারী রিন্টুর বাহিনীর সন্ত্রাসীরা তাঁকে নির্মমভাবে আহত করেছে।
নির্যাতনের শিকার আরেকজন কুমিল্লা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সাবেক ভিপি খলিলুর রহমান ওরফে রিপন। তিনি ছাত্রলীগের সাবেক নেতা। রিপন বলেন, ২০১০ সালে তাঁকে কুপিয়েছে বাহারের অনুসারী রিন্টু বাহিনী। দীর্ঘ সময় চিকিৎসা নেওয়ার পরও এখনো স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারছেন না তিনি।
ঠিকাদারি কাজে ১০ শতাংশ কমিশন
গত ১ এপ্রিল কুমিল্লা শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের কার্যালয়ে আওয়ামী লীগ নেতা এবং ঠিকাদার মাসুদুল ইসলাম ওরফে বাবুকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করেন কুমিল্লা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি জহিরুল ইসলাম ওরফে রিন্টু এবং সাধারণ সম্পাদক সাদেকুর রহমান ওরফে পিয়াসের সহযোগীরা।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর কুমিল্লা শহরের মাসুদুলের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, তিনি বিছানায় শুয়ে আছেন। তাঁর বাঁ পা ও দুই হাতে অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে ঠিকাদারির কাজ নিয়ে বাহারের অনুসারীদের সঙ্গে তাঁর বিরোধ হয়। এই বিরোধের জেরেই তাঁর ওপর নেমে আসে নির্মম নির্যাতন।
মাসুদুল বলেন, গত ১৫ বছরে কুমিল্লায় বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের একক নিয়ন্ত্রণ ছিল বাহার ও তাঁর ঘনিষ্ঠদের কাছে। এসব উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ পেতে হলে বাহারকে মোট বরাদ্দের ১০ শতাংশ কমিশন দিতে হতো। যদি কেউ তাঁকে কমিশন না দিয়ে কাজ পেতেন, তাহলে তাঁকে কাজ করতে দেওয়া হতো না।
আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, বাহারের সহযোগীদের মধ্যে ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর আবুল হাসেম এবং মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ কুমিল্লা ইপিজেডের চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করতেন। এর মধ্যে ইপিজেড এলাকার ৯০টির বেশি কারখানার ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ হাসেমের কাছে ছিল।
কুমিল্লার বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জেলার সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর দরপত্রের বেশির ভাগ কাজ পেত বাহারের নিজের প্রতিষ্ঠান মেসার্স কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ইকুইপমেন্ট সাপ্লাইয়ার, বাহারের জামাতা সাইফুল ইসলাম ওরফে রনির মেসার্স সাইফুল ইসলাম রনি ট্রেডার্স, কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নাজমুল হাসান ওরফে পাখির হাসান টেকনো বিল্ডার্স লিমিটেড, জেলা আওয়ামী লীগের শিল্প–বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক এনামুল হকের মেসার্স হক এন্টারপ্রাইজ, কুমিল্লা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি জহিরুল ইসলাম ওরফে রিন্টুর মেসার্স ইসলাম এন্টারপ্রাইজ, কুমিল্লা মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য হাসান ইমামের মেসার্স হামিম অ্যান্ড ব্রাদার্স, বাহারের সহযোগী মোহাম্মদ আলমের রানা বিল্ডার্স, কামাল হোসেনের মেসার্স মাস্টার এন্টারপ্রাইজ এবং আবু বকর সিদ্দিকের মেসার্স আরএবি আরসি লিমিটেড।
জাতীয় ইজিপি (ইলেকট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট) পোর্টালের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাহারের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ১ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা, হাসান টেকনো বিল্ডার্স লিমিটেড ১ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা, রানা বিল্ডার্স লিমিটেড ৫৪০ কোটি টাকা এবং হক এন্টারপ্রাইজ ১৬৯ কোটি টাকার কাজ পেয়েছে।
বিরোধপূর্ণ জমি দখল ও বহুতল ভবন নির্মাণ
গত বছরের ১২ এপ্রিল কুমিল্লা শহরের মনোহরপুর এলাকায় দুই বিঘা জমির ওপর সোনালী স্কয়ার নামের ১১ তলা বিপণিবিতানের উদ্বোধন করেন বাহার। তিনি সোনালী স্কয়ারের চেয়ারম্যান।
২০০৯ সালে সংসদ সদস্য হওয়ার পরই বাহারের চোখ পড়ে বিরোধপূর্ণ এই জমির ওপর। ওই সময় এই জমিতে ১০টি পুরোনো দোকান ছিল। বাহারের প্রতিবেশী এবং পারিবারিকভাবে ঘনিষ্ঠ সুমন্ত চক্রবর্তী নামে এক ব্যবসায়ীর দোকানও ছিল সেখানে। সুমন্ত চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, জমির আদি মালিক ছিলেন জ্যোতি ভূষণ ও খিতীভূষণ নামে দুই ভাই। দুজনের কাছ থেকে ৫০ বছর আগে তাঁর বাবা দোকান নিয়েছিলেন। জমির মালিক দুই ভাইয়ের কারও স্ত্রী-সন্তান ছিল না। তাঁদের মৃত্যুর পর এই জমি বেদখল হয়। ভুয়া নথিপত্র তৈরি করে বাহার এই জমি দখল করে তাঁদের উচ্ছেদ করে পরে সেখানে বহুতল বিপণিবিতান নির্মাণ করেন।
সুমন্ত চক্রবর্তীর ভাষ্য, তাঁকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি। উল্টো তাঁর পরিবারকে নানাভাবে হয়রানি করা হয়েছে। ২০১৫ সালে তাঁর ছেলেকে দুটি ডাকাতির মামলার আসামি করা হয়। বাহারের ভয়ে ছেলেকে তিনি ২০১৭ সালে মালয়েশিয়া পাঠিয়ে দেন।
সোনালী স্কয়ারে প্রায় ৩০০ দোকান নির্মাণ করা হয়েছে। পাশাপাশি সেখানে ৭০টি ফ্ল্যাটও নির্মাণ করা হয়েছে। ৮০ থেকে ৯০ লাখ টাকায় এসব ফ্ল্যাট বিক্রি করেছেন বাহার। আর প্রতিটি দোকান থেকে ৬০–৭০ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়েছেন। দোকান ও ফ্ল্যাট বিক্রি করে বাহারের আয় প্রায় ২৭০ কোটি টাকা। তবে জমির মালিকানার দ্বন্দ্বের কারণে দোকান ও ফ্ল্যাট নিবন্ধন করে দিতে পারেননি তিনি। বহুতল ভবনে ফ্ল্যাট কিনেছেন এমন একজন প্রথম আলোকে বলেন, তিনি প্রায় ৯০ লাখ টাকায় ফ্ল্যাট কিনেও মালিকানা বুঝে পাননি।
বাহাউদ্দিন বাহার দুর্বৃত্তায়নের প্রতীক। গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের শাসনামলে দেশে দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে। কুমিল্লায় দুর্বৃত্তায়নের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। এমনকি কুমিল্লায় নাগরিক সমাজকেও বিকশিত হতে দেননি তিনি। কুমিল্লার সর্বক্ষেত্রে তাঁর আধিপত্য ছিল। যা ইচ্ছা হয়েছে, তা–ই করেছেন বাহার।কুমিল্লার বাসিন্দা ও ইতিহাসবিদ আহসানুল কবীর
এ ছাড়া শহরের রামঘাটে জালিয়াতি করে জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের ১০ শতাংশ জমি দখলে নিয়ে ১০ তলা ভবন নির্মাণ করে আওয়ামী লীগের কার্যালয় বানান বাহার। কুমিল্লার বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের নামে থাকা এই জমিতে বাহার জোর করে বহুতল ভবন করেছেন। যখন জমি দখল করা হয়, তখন বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সব সরকারি দপ্তরকে জানানো হয়েছিল। কিন্তু বাহারকে বাধা দেওয়ার মতো কেউ ছিল না।
শহরের বিভিন্ন স্থানে এমন আরও অন্তত ১০টি বিরোধপূর্ণ জমি ও পুকুর দখলের তথ্য পাওয়া গেছে। এসব জমি বাহার এবং তাঁর ঘনিষ্ঠরা দখল করেছেন। এর মধ্যে শহরের কান্দিরপাড়ে লিবার্টি সিনেমা হলের ৭০ শতাংশ জমি দখল করে বহুতল ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন বাহার। জমিটি মূলত অর্পিত সম্পত্তি। এই জমির ভুয়া নথিপত্র তৈরি করে সেটি দখল করা হয় বলে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানিয়েছেন।
কুমিল্লার বাসিন্দা ও ইতিহাসবিদ আহসানুল কবীর প্রথম আলোকে বলেন, বাহাউদ্দিন বাহার দুর্বৃত্তায়নের প্রতীক। গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের শাসনামলে দেশে দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে। কুমিল্লায় দুর্বৃত্তায়নের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। এমনকি কুমিল্লায় নাগরিক সমাজকেও বিকশিত হতে দেননি তিনি। কুমিল্লার সর্বক্ষেত্রে তাঁর আধিপত্য ছিল। যা ইচ্ছা হয়েছে, তা–ই করেছেন বাহার।