গৃহকর্মীকে নির্যাতনের প্রমাণ পেয়েও নির্যাতনকারীকে ছেড়ে দিল পুলিশ

৯৯৯-এ ফোন পেয়ে পুলিশ যখন বনানীর বাসায় গিয়ে মেয়েটিকে উদ্ধার করে, তখনো তাঁর মুখে স্কচটেপ ও হাতে সুপার গ্লু লাগানো ছিল
ছবি: সংগৃহীত

মেয়েটি প্রায় দুই মাস আগে ঢাকার বনানীর একটি বাসায় গৃহকর্মীর কাজ নেন। তার পর থেকেই পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। শুরু হয় নির্মম নির্যাতন। মেয়েটির চিৎকারের আওয়াজ যেন বাইরে না যায়, সে জন্য নির্যাতনের সময় তাঁর মুখে লাগানো হতো স্কচটেপ। কখনো কখনো দুই হাতে সুপার গ্লু লাগিয়ে বেধড়ক পেটানো হতো তাঁকে।

গত মঙ্গলবার দুপুরে ৯৯৯-এ ফোন পেয়ে তানিয়া বেগম নামের ওই গৃহকর্মীকে বনানীর ২৩ নম্বর সড়কের একটি বাড়ির সাততলার ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার করে থানা-পুলিশ। গৃহকর্ত্রী সামিনা আলমকে আটক করে নেওয়া হয় বনানী থানায়। নির্যাতনের শিকার মেয়েটিকে যখন পুলিশ উদ্ধার করে, তখনো তাঁর মুখে স্কচটেপ লাগানো ছিল, দুই হাত সুপার গ্লু দিয়ে জোড়া লাগানো ছিল। অথচ এ ঘটনায় কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ।

ভুক্তভোগী গৃহকর্মীর পরিবার মামলা করতে আগ্রহী নয়, এমন অজুহাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে গৃহকর্ত্রী সামিনা আলমকে। নির্যাতনের সব তথ্যপ্রমাণ থাকার পরও পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেনি। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে, মেয়েটিকে যিনি নির্মম নির্যাতন করলেন, তিনি কি আইনের আওতায় আসবেন না? তাঁর কি বিচার হবে না?

নির্যাতনের শিকার গৃহকর্মীর ভাই মো. শফিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা তাঁর বোনকে নির্যাতন করেছেন, তাঁরা প্রভাবশালী। মামলা করে তাঁদের বিরুদ্ধে লড়াই করা কঠিন। তা ছাড়া মামলার খরচ জোগানোর সামর্থ্য তাঁদের নেই। এ কারণেই তাঁরা মামলা করেননি। তবে রাষ্ট্র বা কোনো সংস্থার সহযোগিতা পেলে তিনি আইনগত ব্যবস্থা নিতে চান। এ নির্যাতনের বিচার তিনি চান।

আইনজীবীরা বলছেন, এটি একটি ফৌজদারি অপরাধ। ভুক্তভোগী পরিবার ভয়ে কিংবা অন্য কোনো কারণে মামলা করতে আগ্রহী না হলে রাষ্ট্রের পক্ষে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করতে পারবে। এ ঘটনার ক্ষেত্রেও পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করতে পারত। কিন্তু সেটি না করায় গৃহকর্ত্রী নির্যাতন করেও পার পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) আইনজীবী মশিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ফৌজদারি অপরাধের ঘটনা ঘটলে ভুক্তভোগী মামলা না করলে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করতে পারবে। একই ধরনের অভিমত দিয়েছেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ উপপরিচালক নিনা গোস্বামী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রত্যেক নাগরিকের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এ কারণে কোনো নাগরিক নির্যাতনের শিকার হলে বা ফৌজদারি অপরাধের তথ্য পেলে পুলিশ মামলা নেবে। ভুক্তভোগীর পরিবার যদি কোনো কারণে আইনি পদক্ষেপ নিতে না চায়, তবে পুলিশ বাদী হয়ে সে পদক্ষেপ নিতে পারে।

এ বিষয়ে বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নুরে আযম মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভুক্তভোগীদের মামলা করার জন্য বুঝিয়ে বলা হয়েছে। তাঁরা মামলা করতে চান না। এ ক্ষেত্রে অতি উৎসাহী হয়ে তো আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি না। আইনগত ব্যবস্থা নিতে গেলে ভুক্তভোগী পরিবারের সাপোর্ট (সহায়তা) লাগবে। ভুক্তভোগী নিজে প্রাপ্তবয়স্ক, তাঁর পরিবার আছে, এখন তাঁদের বিচার চাইতে হবে। পুলিশ আইনগত ব্যবস্থা নিলে ভুক্তভোগী যদি বলেন এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি, তখন সবাইকে বিব্রত হতে হবে।’

যেভাবে পাওয়া গেল মেয়েটিকে

পুলিশ জানায়, মঙ্গলবার দুপুরে ৯৯৯-এ কল করে এক ব্যক্তি জানান, বনানীর ২৩ নম্বর সড়কের একটি বাড়ির সাততলার ফ্ল্যাটে একজনকে নির্যাতন করা হচ্ছে। বাইরে থেকে চিৎকার-চেঁচামেচির আওয়াজ আসছে। বেলা সোয়া দুইটার দিকে ওই ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখা যায়, একজনের মুখ স্কচটেপ দিয়ে বাঁধা রয়েছে। মাথার চুল ও ভ্রু ছেঁটে দেওয়া হয়েছে। শরীরজুড়ে নির্যাতনের অসংখ্য ক্ষত। মারধরে পুরো মুখমণ্ডল ফুলে গেছে।

তানিয়া বেগমের ভাই শফিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, দুই বছর আগেও গৃহকর্ত্রী সামিনার বাসায় কাজ করেছিলেন তানিয়া। পরে কাজ ছেড়ে গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার কলমাকান্দায় চলে যান। তবে দুই মাস আগে বাসা থেকে রাগ করে তাঁর বোন ঢাকায় এসে সামিনার বাসায় কাজে যোগ দেন। তানিয়া কোথায় ছিলেন, বিষয়টি পরিবারের কেউ জানতেন না। পুলিশ তানিয়াকে উদ্ধার করার পর তাঁরা জানতে পারেন। গৃহকর্ত্রীর ছোট সন্তান আছে। ওই সন্তান কান্না করলেই তানিয়ার ওপর নির্মম নির্যাতন করা হতো।

শফিকুর রহমান জানান, তানিয়া এখন তাঁদের পরিবারের হেফাজতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। চিকিৎসা শেষে গ্রামের বাড়িতে ফিরে যাবেন। তবে তানিয়া এখন কোথায় আছেন, সেটি তিনি জানাতে চাননি।