কঙ্কাল উদ্ধার ও হত্যার পর লাশ ১০ টুকরা, নেপথ্যে চমকে ওঠার মতো গল্প
দুটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থল ঢাকার ডেমরা। একজনকে হত্যার পর তাঁর মরদেহ বস্তাবন্দী করে ফেলা হয় বাসার সামনের পয়োনিষ্কাশনের নালায়। অপরজনের মরদেহ ১০ টুকরো করার পর ডিএনডি খালে ফেলে দেওয়া হয়। হত্যাকাণ্ড দুটি ঘটানো হয়েছে যথাক্রমে গত বছরের ৮ অক্টোবর ও চলতি বছরের ৪ মে।
পুলিশ বলছে, সাত মাসের ব্যবধানে ‘নিখুঁত’ পরিকল্পনায় এ দুই হত্যার পর আলামত নষ্টসহ লাশ গুমের যে বর্ণনা খুনীরা দিয়েছেন, তা যেন সিনেমার গল্পকেও হার মানায়। আবার হত্যাকাণ্ড দুটির রহস্য উদ্ঘাটিত হয়েছে অনেকটা নাটকীয়ভাবে, নিখোঁজের ঘটনায় করা একটি জিডির (সাধারণ ডায়েরি) তদন্তের সূত্রে।
হত্যাকাণ্ড দুটির রহস্য উদ্ঘাটনের দাবি করে পুলিশ বলছে, এতে জড়িত স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দেওয়া আবু বকর সিদ্দিক ও সুমি বেগম নামের দুজন। দুটি হত্যাকাণ্ডের পেছনে রয়েছে ‘অনৈতিক’ সম্পর্ক।
গত বছরের ৩০ নভেম্বর ডেমরার টেংরা কেনেলপাড়ের একটি টিনশেড বাড়ির সামনের পয়োনিষ্কাশনের নালা থেকে বস্তাবন্দী একটি কঙ্কাল উদ্ধার করে পুলিশ। তখন ওই ব্যক্তির পরিচয় নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ। আলামত নষ্ট হয়ে যাওয়ায় খুনীদেরও শনাক্ত করা যায়নি।
দুই দফা তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন করেও রহস্যের কিনারা করা যায়নি। এ কারণে তদন্ত থমকে যায়। তবে হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটিত না হওয়া পর্যন্ত কেউ যেন ওই টিনশেডের বাড়িটি ছেড়ে না যান, এমন নির্দেশ দেয় পুলিশ।
পুলিশের ভাষ্য, ৫ জুন নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও থানা-পুলিশ আলী হোসেন নামের এক নিখোঁজ ব্যক্তির খোঁজ পেতে ডেমরা থানা-পুলিশের সহায়তা চায়। তাঁর বাড়ি সোনারগাঁওয়ে। এক মাস আগে থেকে নিখোঁজ আলী হোসেন সর্বশেষ মুঠোফোনে যাঁর সঙ্গে কথা বলেছিলেন, তাঁর অবস্থান ডেমরার টেংরা কেনেলপাড় এলাকায়। তাঁর নাম আবু বকর সিদ্দিক।
ওই দিনই সোনারগাঁও থানা-পুলিশ ও ডেমরা থানা-পুলিশের সম্মিলিত একটি দল আবু বকরের বাসায় যান। সেখানে গিয়ে ডেমরা থানা-পুলিশের সদস্যরা অবাক হয়ে যান। কেননা, যে বাসার সামনে থেকে ছয় মাস আগে কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়েছিল, ওই বাসার ভাড়াটে ছিলেন আবু বকর সিদ্দিক ও তাঁর স্ত্রী সুমি বেগম। পুলিশকে না জানিয়ে তাঁরা নতুন বাসায় উঠেছেন।
পুলিশের ডেমরা অঞ্চলের সহকারী কমিশনার মধুসূদন দাস প্রথম আলোকে বলেন, আবু বকর সিদ্দিক ও সুমি বেগমের আচরণ ছিল সন্দেহজনক। তখনই তাঁদের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। একপর্যায়ে তাঁরা জানান, সুমির প্রথম স্বামী ছিলেন জাহাঙ্গীর হোসেন। তাঁর মাধ্যমে আবু বকরের সঙ্গে সুমির পরিচয়।
জাহাঙ্গীর কোথায় জানতে চাইলে তাঁরা কোনো উত্তর দিচ্ছিলেন না। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে সুমি জানান, পয়োনিষ্কাশনের নালা থেকে উদ্ধার করা কঙ্কালটি জাহাঙ্গীরের। আর নতুন বাসায় ওঠার চার দিন পর (চলতি বছরের ৪ মে) আলী হোসেনকে ডেকে এনে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। পরে লাশ ১০ টুকরা করে বস্তায় ভরে ডিএনডি খালে ফেলে দেওয়া হয়।
হত্যাকাণ্ড দুটির দায় স্বীকার করে আবু বকর সিদ্দিক ও সুমি বেগম ১৬ জুন আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন বলে জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।
ইয়াবা বড়ি খাওয়ানোর পর জাহাঙ্গীরকে হত্যা
সুমির দেওয়া তথ্যের বরাতে পুলিশ জানায়, তিন বছর আগে নারায়ণগঞ্জের বন্দরের মদনপুর এলাকার জাহাঙ্গীরের সঙ্গে সুমির পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়। বিয়ের পর তাঁরা একই এলাকায় বসবাস করছিলেন। জাহাঙ্গীর মাদকসেবী ছিলেন। তিনি শারীরিকভাবে দুর্বল থাকায় তেমন কোনো কাজ করতেন না। জাহাঙ্গীর একসময় রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন আবু বকরের সঙ্গে।
সেই সূত্রে জাহাঙ্গীরের বাসায় আবু বকরের যাতায়াত ছিল। ভোলার বাসিন্দা আবু বকর নারায়ণগঞ্জে থাকতেন। সুমি দাবি করেছেন, জাহাঙ্গীর অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে তাঁকে শারীরিক সম্পর্কে বাধ্য করতেন। ওই ব্যক্তিদের মধ্যে আবু বকর ছিলেন একজন। একপর্যায়ে আবু বকরের সঙ্গে তাঁর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। গত বছরের জুনে চট্টগ্রামের একটি মাজারে গিয়ে বিয়ে করেন তাঁরা। জাহাঙ্গীরকে কিছু না জানিয়ে ডেমরা এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করেন তাঁরা।
পুলিশ জানায়, ঘটনার ৪-৫ দিন পর থেকেই গন্ধ আসতে শুরু করে। ময়লা পরিষ্কার করার লোক এসে গন্ধের কারণে চলে যান। সবার ধারণা ছিল, পয়োনিষ্কাশনের নালায় পড়ে হয়তো কোনো কুকুর পড়ে মারা গেছে। কয়েক দিন পর বাড়ির মালিক আরও স্ল্যাব সংযুক্ত করে নালাটি ডেকে দেন। কিন্তু তাতেও দুর্গন্ধ যাচ্ছিল না।
ডেমরা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ওমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, স্ত্রীকে খোঁজাখুঁজির একপর্যায়ে জাহাঙ্গীর জানতে পারেন, আবু বকরকে বিয়ে করে সুমি ডেমরায় আছেন। সেখানে গিয়ে তিনি সুমিকে ফিরিয়ে নিতে চান। কিন্তু সুমি এতে রাজি ছিলেন না। এ নিয়ে আবু বকরের সঙ্গে জাহাঙ্গীরের ঝগড়া হয়। পরে জাহাঙ্গীরকে হত্যার পরিকল্পনা করেন আবু বকর। ঘটনার কয়েক দিন আগে সুমিকে তাঁর গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার দাউদকান্দিতে পাঠিয়ে দেন আবু বকর।
এসআই ওমর ফারুক বলেন, ঘটনার দিন (গত বছরের ৮ অক্টোবর) আবু বকর মুঠোফোনে জাহাঙ্গীরকে জানান, মাছ চাষের জন্য একটি জলাশয় ভাড়া নিয়েছেন তিনি। মাছের পোনা কিনতে জাহাঙ্গীরকে নিয়ে ময়মনসিংহে যাবেন। জাহাঙ্গীরকে ইয়াবা খাওয়ানোর প্রলোভনও দেখান। বিকেলে বাসায় আসার পর জাহাঙ্গীরকে কয়েক ধাপে আটটি ইয়াবা বড়ি খাওয়ান আবু বকর। পরে জাহাঙ্গীর মেঝেতেই ঘুমিয়ে পড়েন। ঘুমন্ত জাহাঙ্গীরের বুকের ওপর বসে প্রথমে কয়েকটি কিল-ঘুষি দিতে শুরু করেন আবু বকর। এ সময় জাহাঙ্গীর জেগে উঠে চিৎকার দেওয়ার চেষ্টা করলে তাঁর গলা চেপে ধরেন আবু বকর। কিছুক্ষণের মধ্যে জাহাঙ্গীর নিস্তেজ হয়ে পড়েন।
পুলিশের এই কর্মকর্তা আরও জানান, রাত ১১টা পর্যন্ত মেঝেতেই পড়েছিল জাহাঙ্গীরের মরদেহ। পরে মরদেহটিকে বস্তায় ভরে রাত একটার দিকে বাসার সামনের পয়োনিষ্কাশন নালায় ফেলে দেন আবু বকর। যেখানে লাশ ফেলা হয়, সেখানে একটি স্ল্যাব দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়।
পুলিশ জানায়, ঘটনার চার-পাঁচ দিন পর থেকেই গন্ধ আসতে শুরু করে। ময়লা পরিষ্কার করার লোক এসে গন্ধের কারণে চলে যান। সবার ধারণা ছিল, পয়োনিষ্কাশনের নালায় পড়ে হয়তো কোনো কুকুর পড়ে মারা গেছে। কয়েক দিন পর বাড়ির মালিক আরও স্ল্যাব সংযুক্ত করে নালাটি ডেকে দেন। কিন্তু তাতেও দুর্গন্ধ যাচ্ছিল না। পরে একজন ভাড়াটের অভিযোগের ভিত্তিতে গত বছরের ৩০ নভেম্বর সেখান থেকে একটি কঙ্কাল উদ্ধার করে পুলিশ। ওই কঙ্কাল দেখে ধারণা করা হয়েছিল, নিহত ব্যক্তির বয়স ২০ বছরের কম হবে। ওজন ছিল ৪৩-৪৪ কেজি।
১০ টুকরা করা হয় আলী হোসেনের লাশ
পুলিশের ভাষ্যমতে, আলী হোসেনও সুমির স্বামী জাহাঙ্গীরের পরিচিত ছিলেন। তবে আবু বকরকে বিয়ে করার পর আলী হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন সুমি। তবে সুমির খোঁজ পেয়ে জাহাঙ্গীর বিষয়টি আলী হোসেনকে জানিয়ে দেন। এর পর থেকে সুমির সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করেন আলী হোসেন। তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক রাখার জন্য চাপ দিতে থাকেন। এমনকি বাসায় এসেও সুমিকে হুমকি দেন। এরপর আলী হোসেনকে হত্যার পরিকল্পনা করেন আবু বকর ও সুমি।
যে বাসায় জাহাঙ্গীরকে হত্যা করা হয়েছিল, ওই বাসায় আরও একটি হত্যাকাণ্ড ঘটানোকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ মনে করেন আবু বকর ও সুমি, এমন মন্তব্য করে ডেমরা থানার এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, এ কারণে বাসা পরিবর্তন করেন তাঁরা। বাসা পরিবর্তনের পর গত ৪ মে আলী হোসেনকে মুঠোফোনে ডেকে আনা হয়। রাত ১১টার দিকে আলী হোসেন বাসায় আসেন। এ সময় আবু বকরের সঙ্গে আলী হোসেনের কথা–কাটাকাটি হয়।
আলী হোসেনকে খুন করা হয় রাত সাড়ে ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে। ভোররাত সাড়ে চারটার দিকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আলী হোসেনের লাশ ১০ টুকরা করেন আবু বকর ও সুমি। লাশের টুকরাগুলো বস্তায় ভরে সারা দিন রেখে দেন। পরদিন রাত ১০টার দিকে একটি অটোরিকশায় করে লাশটির টুকরাগুলো ডেমরার ডিএনডি খালে ফেলে দেন।
একপর্যায়ে আলী হোসেনকে ঘুষি মেরে মেঝেতে ফেলে দেন আবু বকর। আলী হোসেন চিৎকার দেওয়ার চেষ্টা করলে তাঁর মুখ চেপে ধরেন আবু বকর। আর আলীর পা চেপে ধরেন সুমি। আবু বকর একটি বালিশ দিয়ে আলী হোসেনের মুখ চেপে ধরে শ্বাসরোধে হত্যা করেন।
পুলিশের ডেমরা অঞ্চলের সহকারী কমিশনার মধুসূদন দাস প্রথম আলোকে বলেন, আলী হোসেনকে খুন করা হয় রাত সাড়ে ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে। ভোররাত সাড়ে চারটার দিকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আলী হোসেনের লাশ ১০ টুকরা করেন আবু বকর ও সুমি।
লাশের টুকরাগুলো বস্তায় ভরে সারা দিন রেখে দেন। পরদিন রাত ১০টার দিকে একটি অটোরিকশায় করে টুকরা করা লাশটি ডেমরার ডিএনডি খালে ফেলে দেন। আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতেও তাঁরা এমন তথ্য দিয়েছেন। তবে ডুবুরি দিয়ে খুঁজেও আলী হোসেনের লাশ পাওয়া যায়নি।