জাহিদুল হত্যা
‘বেশি ফালাফালি করিস না, মেরে ফেলব’
গত বছরের ২৪ মার্চ রাতে মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলামকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম ওরফে টিপু হত্যার পরিকল্পনাকারী সুমন শিকদারের জবানবন্দিতে আসা আওয়ামী লীগ ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের চার নেতার নাম মামলা থেকে বাদ দিতে চাপ দেওয়া হচ্ছে। এমনকি নিহতের স্ত্রী ফারহানা ইসলামকে প্রাণনাশের হুমকিও দেওয়া হচ্ছে। অনবরত হুমকির মুখে সন্তানদের নিয়ে ফারহানা ইসলাম এখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
জাহিদুল হত্যার পর এক মাস পুলিশ নিরাপত্তা দিয়েছিল। এরপর পুলিশ বাসার সামনে থেকে সরে যায়। তখন থেকে শুরু হয় একের পর হত্যার হুমকি। এরপর শাহজাহানপুর থানায় তিনটি ও মতিঝিল থানায় একটি জিডি করি। কিন্তু পুলিশের নিরাপত্তা আর পাইনি।
ফারহানা ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, জাহিদুল খুনের পর হুমকির মুখে তিনি নিজের ও সন্তানদের নিরাপত্তার জন্য শাহজাহানপুর থানায় তিনটি ও মতিঝিল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন। এ ছাড়া তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) প্রধানের কাছে জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে আবেদন করেছেন। কিন্তু কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না। হুমকি পেয়েই যাচ্ছেন।
ফারহানা ইসলাম ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১, ১১ ও ১২ নম্বর সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর।
গত বছরের ২৪ মার্চ রাতে রাজধানীর শাহজাহানপুরে মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলামকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সে সময় ঘটনাস্থলে রিকশায় বসে থাকা কলেজছাত্রী সামিয়া আফনান ওরফে প্রীতিও (২২) গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। ওই ঘটনায় জাহিদুল ইসলামের স্ত্রী ফারহানা ইসলাম অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে শাহাজাহানপুর থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলাটি তদন্ত করছে ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগ।
জাহিদুল হত্যায় মোট ২৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ ও র্যাব। তাঁদের মধ্যে রাকিবুর রহমান, ইয়াসির আরাফাত, ইশতিয়াক আহম্মেদ, মশিউর রহমান ও আরিফুর রহমান (এক্সেল সোহেল) কারাগার থেকে জামিনে বেরিয়ে গেছেন। হত্যার পরিকল্পনাকারী সুমন শিকদার, ‘শুটার’ মাসুম মোহাম্মদ আকাশ ও নাসির উদ্দিন ওরফে মানিক আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। সুমনের দেওয়া জবানবন্দিতে হত্যায় ১৬ জনের নাম এসেছে। তারা আওয়ামী লীগ ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের রাজনীতিতে যুক্ত। হত্যাকাণ্ডের পর দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া সুমন শিকদারকে গত বছরের ৯ জুন ওমান থেকে ফিরিয়ে আনে পুলিশ। এরপর রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
আদালতে ১৬৪ ধারায় সুমন শিকদারের দেওয়া জবানবন্দিতে জাহিদুল হত্যায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ১০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মারুফ আহমেদ ওরফে মনসুর, মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম আশরাফ তালুকদার, শান্তিনগরের হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজের ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সোহেল শাহরিয়ার ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ১০ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি মারুফ রেজাসহ মোট ১৬ জনের নাম আসে।
শাহজাহানপুর থানায় করা একটি জিডিতে ফারহানা ইসলাম উল্লেখ করেন, গত বছরের ২০ আগস্ট বেলা ১টা ২৩ মিনিটে আশিক পরিচয়ে তাঁকে মুঠোফোনে কল দিয়ে মামলা থেকে মারুফ রেজা ওরফে সাগর, সোহেল শাহরিয়ার, মারুফ আহমেদ ওরফে মনসুর ও আশরাফ তালুকদারের নাম বাদ দেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হয়। ফারহানা তখন ওই ব্যক্তিকে বলেন, তিনি মামলায় কারও নাম উল্লেখ করেননি। তখন মুঠোফোনের অপর প্রান্ত থেকে বলা হয় ‘বেশি ফালাফালি করিস না। ফালাফালি করলে প্রাণে মেরে ফেলব।’ এটা না করলে আরও অনেক লাশ পড়বে বলেও হুমকি দেওয়া হয়।
জানতে চাইলে ওয়ার্ড কাউন্সিলর মারুফ আহমেদ বলেন, এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে তিনি অবগত নন। এ বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না।
গত বছরের ১ এপ্রিল ফারহানা ইসলাম (ডলি) শাহজাহানপুর থানায় আরেকটি জিডি করেন। এতে বলা হয়, ১ এপ্রিল বিকেলে এক ব্যক্তি তার মুঠোফোনে কল দিয়ে জানতে চান, ডলি বলছেন? এ সময় কলারের পরিচয় জানতে চাইলে অপর প্রান্ত থেকে ফারহানার বাসার ঠিকানা জানতে চাওয়া হয়। পরে কলার বলেন, তিনি দুবাই থেকে তমাল বলছেন। পুলিশের কাছে তাঁর নাম বলাটা ভালো হয়নি।
ফারহানা জানান, গত বছরের ২৫ ও ৩০ মার্চ একই নম্বর থেকে ফোন করে তাঁর বাসার ঠিকানা জানতে চাওয়া হয়েছিল। এ অবস্থায় তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার সঞ্জিত কুমার রায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়সহ আমরা বিষয়টি নিয়ে অবগত আছি। ওনার নিরাপত্তার বিষয়ে থানা-পুলিশকে বলা হয়েছে। ডিবিও নিরাপত্তার দিকটি নজরদারি করছে। মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে। তদন্ত শেষে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।’
সম্প্রতি ফারহানা ইসলাম ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের প্রধানের কাছে মামলার সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং সঠিক তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আবেদন করেছেন। এতে বলা হয়, জাহিদুল হত্যা মামলায় ইতিমধ্যে অনেক আসামিকে ডিবি গ্রেপ্তার করেছে। তাঁদের কয়েকজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন। এখনো মামলাটির অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হয়নি। এতে মামলাটি দীর্ঘায়িত হচ্ছে। তদন্ত প্রতিবেদন জমা না পড়ায় আসামিরা জামিনে মুক্ত হচ্ছেন এবং নিজেও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
জাহিদুল হত্যা মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ডিবির মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার রাজীব আল মাসুদ। জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার সঙ্গে মামলার আসামি জামিনে মুক্ত হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। ফারহানা ইসলামকে হুমকির ঘটনায় করা জিডির বিষয়ে তিনি জানেন না। এ ব্যাপারে ফারহানা ইসলাম লিখিত অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেবেন।
শাহজাহানপুর থানায় নিরাপত্তা চেয়ে ফারহানা ইসলামের করা তিন জিডির বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি মনির হোসেন শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, তিন জিডির তদন্ত চলছে। ফারহানা ইসলামের বাসার সামনে পুলিশের পাহারা না থাকার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, তিনি (ফারহানা) কোথাও যেতে চাইলে সঙ্গে পুলিশ দেওয়া হয়।
ফারহানা ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘জাহিদুল (টিপু) হত্যার পর এক মাস পুলিশ নিরাপত্তা দিয়েছিল। এরপর পুলিশ বাসার সামনে থেকে সরে যায়। তখন থেকে শুরু হয় একের পর হত্যার হুমকি। এরপর শাহজাহানপুর থানায় তিনটি ও মতিঝিল থানায় একটি জিডি করি। কিন্তু পুলিশের নিরাপত্তা আর পাইনি। এরপরও অনেক হুমকি আসে। কিন্তু প্রতিকার না পাওয়ায় থানায় আর জিডি করতে যাইনি।’
ফারহানা ইসলাম বলেন, ওয়ার্ড কাউন্সিলর হিসেবে নিরাপত্তা ছাড়াই তাঁকে চলাচল করতে হচ্ছে। তবে সন্তানসহ তাঁর প্রতিটি মুহূর্ত কাটে ভয় ও আতঙ্কে। এ অবস্থায় সার্বক্ষণিক পুলিশ চান তিনি। ফারহানা বলেন, তিনি নিজেও আওয়ামী লীগ করেন। কিন্তু দলীয় লোকদের কাছ থেকে প্রাণনাশের হুমকি পাওয়াটা কষ্টের পাশাপাশি হতাশারও।
ফারহানা ইসলাম জানান, তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করার জন্য আবেদন করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে মনের কষ্টের কথা তিনি বলতে চান।