১০ কাঠার প্লট বাগাতে সবই করেছেন সদ্য বিদায়ী বিদ্যুৎ–সচিব
একাধিক নিয়ম ভেঙে রাজধানীর পূর্বাচলের আকর্ষণীয় জায়গায় ১০ কাঠার একটি প্লট নিয়েছেন সদ্য বিদায়ী বিদ্যুৎ–সচিব ড. সুলতান আহমেদ। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান থাকাকালে গত বছরের ডিসেম্বরে প্লটটি তিনি নেন। ঠিক এর এক দিন পরে তিনি সচিব হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগে যোগ দেন। রাজউক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিদ্যুৎ সচিব হিসেবে আজ রোববার ছিল তাঁর শেষ কর্মদিবস।
রাজউকের তিনজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর রাজউকের ১৩/২০১৯তম সাধারণ সভায় পূর্বাচলের ৫ নম্বর প্রকল্পের ১০৩ সেক্টরের ০৩৩ নম্বরের ১০ কাঠার প্লটটি প্রথমে বাতিল করেন। এ প্লটটির মালিক ধানমন্ডির বাসিন্দা শায়খ মানযুর আহমেদ। এরপর ওই বোর্ডসভায় মানযুর আহমেদের প্লটটি রাজউকের চেয়ারম্যান নিজের নামে নেওয়ার প্রস্তাব করলে বোর্ড তা অনুমোদন দেয়।
অথচ একই বোর্ড সভায় সরকারের একজন সচিবের আবেদন থাকলেও প্লট খালি নেই এমন বিবেচনায় বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। এর আগের বোর্ড সভায় সরকারের একজন প্রতিমন্ত্রীর আবেদনও একই যুক্তিতে বাতিল করা হয়। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীসহ অন্তত ১২ জন সাংসদের আবেদনপত্র বাতিল করে দিয়েছে রাজউকের বোর্ড সভা, কারণ কোনো প্লট খালি নেই এ যুক্তিতে। কিন্তু নিজের নামে প্লট নেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি অন্যের প্লট বাতিল করে তা নিজের নামে একই বোর্ডসভায় অনুমোদন নিয়েছিলেন।
এ ঘটনার ঠিক দুদিন পরে গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর সুলতান আহমেদ বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব হিসেবে যোগ দেন। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এর আগেও ১৩(ক) ধারার অপব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে রাজউকের চেয়ারম্যানদের বিরুদ্ধে। গত ১০ বছরে অন্তত দুজন রাজউক চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অনিয়মের কারণে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য গত ৮ আগস্ট থেকে ২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিদ্যুৎ–সচিব সুলতান আহমেদের মুঠোফোনে একাধিক কল ও দুটি খুদে বার্তা দিয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। এরপর তাঁর সচিবালয় কার্যালয়ে গিয়ে দেখা করার চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। এরপর গত ১৮ আগস্ট বিদ্যুৎ–সচিবের সরকারি ই–মেইলের মাধ্যমে প্রশ্ন পাঠানো হলেও তিনি কোনো জবাব দেননি। সর্বশেষ গত ৩০ সেপ্টেম্বর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ তথ্য কর্মকর্তা মীর আসলামউদ্দিনের ই–মেইলে বিদ্যুৎ–সচিবের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিষয়ে বিদ্যুৎ–সচিবের বক্তব্য চাওয়া হয়। ওই মেইলেও বিদ্যুৎ–সচিবকে যুক্ত রাখা হয়েছিল। মীর আসলামউদ্দিনের ই–মেইল পেয়েছেন মুঠোফোনে এই প্রতিবেদককে জানালেও এটিরও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
রাজউকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পূর্বাচলে প্রায় ২৪ হাজার প্লট রয়েছে। এসব প্লটের মালিকদের নামে বরাদ্দও হয়ে গেছে। কিন্তু তারপরও বিভিন্ন সময় সরকারের ওপর মহলের চাপে প্লট দিতে বাধ্য হয়েছে রাজউক। আবার রাজউকের কর্মকর্তারাও নামে–বেনামে প্লট নিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে রাজউকের নকশা যেমন মাঠ, খোলা জায়গা কমিয়ে ওই সব প্লট দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া একটি প্লট একাধিক ব্যক্তিকে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া একের প্লট অন্যকে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়েছে রাজউক আইনের ১৩(ক) ধারা।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজউকের আইন অনুযায়ী দুভাবে লটারি ছাড়া প্লট দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। আইনের বহুল আলোচিত ১৩(ক) ধারা অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রীর সম্মতিপত্র প্রথমে যাবে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে। এরপর যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব, সচিব হয়ে মন্ত্রীর নোটিশটিতে স্বাক্ষর নিতে হবে। এরপর নোটিশটি একটি চিঠি আকারে (যার আলাদা স্মারক নম্বর থাকবে) রাজউকে পাঠানো হবে। রাজউকের বোর্ডসভা কোনো প্লট খালি সাপেক্ষে ১৩(ক) আইনের অধীনে কাউকে প্লট বরাদ্দ দিতে পারে।
প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন ছাড়াও এই আবেদন গৃহায়ণমন্ত্রীর কাছে কেউ করতে পারেন। সে ক্ষেত্রেও একই প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে হবে। বিদ্যুৎ–সচিব সুলতান আহমেদের ক্ষেত্রে এসব প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়নি।
গৃহায়ণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ১২ ডিসেম্বর রাজউকের চেয়ারম্যান সুলতান আহমেদ একটি আবেদন করেন পূর্বাচলে প্লট পেতে। তিনি আবেদনে বলেন, তিনি ও তাঁর পরিবারের কোনো সদস্যের ঢাকা শহরে সরকার বা রাজউক কর্তৃক বাস্তবায়িত আবাসিক প্রকল্পে কোনো প্লট বরাদ্দ পাননি। রাজউকে যোগদানের পর অদ্যাবধি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে রাজউকের দাপ্তরিক ও দৈনন্দিন কার্যক্রমে স্বচ্ছতা, গতিশীলতা এবং জবাবদিহি নিশ্চিতকরণে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁর যথাযথ নির্দেশনা ও গৃহীত পদক্ষেপে রাজউকের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজউকের বিভিন্ন আবাসিক প্রকল্পে হারানো নথি ও জালিয়াতির মাধ্যমে নেওয়া বহু প্লট উদ্ধার করা গেছে।
এই চিঠিতে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেন তৎকালীন পূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম। এই চিঠি পরবর্তী সময়ে মন্ত্রণালয়ের নোটিশ আকারে অনুমোদন না নিয়ে সরাসরি রাজউকের বোর্ডে জমা দিয়ে তিনি আরেকজনের প্লট কেটে নিজের নামে অনুমোদন নেন।
রাজউকের কর্মকর্তারা বলেন, সুলতান আহমেদ চেয়ারম্যান হিসেবে যে বোর্ডে ১০ কাঠার প্লট নিজের নামে নেন, ওই বোর্ডেই ১৩(ক) আইনে আরও আবেদন ছিল। তাঁদের দেওয়া হয়নি। কারণ, কোনো প্লট ফাঁকা নেই। তা ছাড়া নিজের নামে উত্তরা থার্ড ফেজে তিনি ১ হাজার ৬৫৪ বর্গফুটের রাজউকের একটি ফ্ল্যাট নিয়েছেন।
জানা গেছে, ৫ নম্বর প্রকল্পের ১০৩ সেক্টরের ০৩৩ নম্বরের ১০ মালিক ব্যবসায়ী মানযুর আহমেদ দুটি কিস্তি পরিশোধ করেছেন। তৃতীয় কিস্তি পরিশোধের জন্য তাঁকে তিনবার তাগাদাপত্র দিতে হবে। এরপর অর্থ জমা না দিলে তাঁর প্লট বাতিলের শুনানির জন্য ডাকা হবে। এরপরও যদি তিনি হাজির না হন, রাজউকের ডাকে সাড়া না দেন, তাহলেই কেবল বোর্ডসভা চাইলে তাঁর প্লট বাতিল করতে পারে। কিন্তু এই ব্যবসায়ীর ক্ষেত্রে দ্বিতীয় দফার টাকা পরিশোধের জন্য দুটি চিঠি দেওয়া হয়। তৃতীয় চিঠি না দিয়ে প্লট বাতিল করে সেটি সুলতান আহমেদের নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়।
এদিকে বিদ্যুৎ–সচিবের নামে বরাদ্দকৃত প্লটটির বরাদ্দ প্রক্রিয়া স্থগিত রাখার জন্য প্লটের আগের মালিক শায়খ মানযুর আহমেদের ছেলে শায়খ মাসউদ আহমেদ সংস্থাটির এস্টেট ও ভূমি শাখা বরাবর একটি আবেদন করেছেন। গত ১২ মার্চ দাখিল করা ওই আবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, ২০১২ সালে মানযুর আহমেদ মারা যাওয়ার পর প্লটের সংশোধিত বরাদ্দপত্রের জন্য আবেদন করা হলেও রাজউক সাড়া দেয়নি। তাই এ বিষয়টি অনিষ্পন্ন রেখে প্লটের বরাদ্দ বাতিলের সিদ্ধান্ত আইনসিদ্ধ হতে পারে না।
জানতে চাইলে মাসউদ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বরাদ্দ বাতিলের খবর পেয়ে আমরা রাজউকের এস্টেট শাখায় যোগাযোগ করি। পরে সেখানকার একজন কর্মকর্তা রাজউকে থাকা ওই প্লটের পুরোনো কাগজপত্র যাচাই করে দেখেন। কিন্তু তিনি কোনো অসংগতি পাননি।’ এখন রাজউকে থাকা ওই নথি গায়েব হয়ে যেতে পারে এমন আশঙ্কা ব্যক্ত করে মাসউদ আহমেদ বলেন, ‘আমরা নথিগুলো ফটোকপি করে নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের সেই সুযোগ দেননি স্টোরকিপার। এমনকি ছবিও তুলতে দেননি।’
২০১৯ সালের ২৬ ডিসেম্বরের যে বোর্ডসভায় বিদ্যুৎ–সচিব প্লটের বরাদ্দ নেন, সেখানে সদস্য হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রাজউকের বর্তমান চেয়ারম্যান সাঈদ নূর আলম। প্লটটির বরাদ্দ বাতিল হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘না দেখে (কাগজপত্র) বলতে পারছি না।’ এ ছাড়া প্লটটি সুলতান আহমেদকে বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে অনিয়মের অভিযোগ প্রসঙ্গে তাঁর ভাষ্য, ‘এ জন্যই বলছি, যথাযথ প্রক্রিয়ায় প্লটটি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে কি না, তা আমাকে দেখে বলতে হবে।’ অথচ তিনি নিজে ওই বোর্ডসভায় উপস্থিত ছিলেন।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, এই সুযোগ তো তিনি (সুলতান আহমেদ) নিতে পারেন না। এটার মধ্যে স্বার্থের দ্বন্দ্ব আছে। এমন একটা সিদ্ধান্তে তিনি নিজেকে জড়িয়েছেন, যা তাঁর নিজ স্বার্থসংশ্লিষ্ট। এটা কোনো প্রশাসনিক, গণতান্ত্রিক চর্চার মধ্যে পড়ে না। আর পরিষ্কারভাবে এটা অনিয়ম। কারণ, শেষ পর্যন্ত যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে, তা বিধিভঙ্গের মাধ্যমে হয়েছে। ব্যক্তির পরিচয় ও অবস্থানের ঊর্ধ্বে থেকে, বিভাগের বাইরে দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে এর তদন্ত করা উচিত।