প্রায় সাড়ে তিন বছর আগে শুল্ক না দিয়েই রাজধানীর কমলাপুরের অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ডিপো (আইসিডি) থেকে দুই কনটেইনার পণ্য ১০টি কাভার্ড ভ্যানে ভরে নেওয়া হয়েছিল। এতে সরকার হারিয়েছিল ১৫ লাখ টাকার রাজস্ব। এই ঘটনা তদন্ত করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) বলেছে, কমলাপুর কাস্টম হাউসেরই চার কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট এই টাকা মেরে দিয়েছিলেন।
এই জালিয়াতিতে জড়িত নয়জনকে অভিযুক্ত করে গত ২০ এপ্রিল ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে সিআইডি। সেখানে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও কাস্টমস কর্মকর্তা–কর্মচারীদের যোগসাজশের বিষয়টি বিস্তারিত উঠে এসেছে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের দিন ২০১৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর ১০টি কাভার্ড ভ্যানে করে আইসিডি থেকে মালামাল সরানোর ঘটনায় আইসিডির নিরাপত্তা পরিদর্শক সৈয়দ হোসাইন মোহাম্মদ বাদী হয়ে একটি মামলা করেন।
ওই মামলায় সিআইডির দেওয়া অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, কাস্টমসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মামুন হোসাইন, আইসিডির সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মোয়াজ্জেম হোসেন, উচ্চমান বহি সহকারী জাহাঙ্গীর আলম ও মোহাম্মদ আখতারের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সহযোগিতায় চক্রটি আইসিডির মতো সুরক্ষিত জায়গা থেকে শুল্ক না দিয়েই পণ্য খালাস করিয়ে নেয়।
এ ঘটনায় আইসিডির অভিযুক্ত চার কর্মকর্তা-কর্মচারী পলাতক। তাঁদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির জন্য আদালতের কাছে আবেদন করেছে সিআইডি।
সিআইডির তদন্ত অনুযায়ী, আইসিডি থেকে মালামাল চুরির (আইনের ভাষায়) সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট মেসার্স করোনা অ্যাসোসিয়েটসের মালিক কাজী সাইফুল ইসলাম, প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা সাইদুর রহমান চৌধুরী এবং কর্মচারী ইয়াসিন মিয়া, আমিনুল ইসলাম ও শরীফ। এদের মধ্যে শুধু শরীফ এখন কারাগারে আছেন। বাকিরা জামিনে।
জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আকতার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, কমলাপুর আইসিডির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহযোগিতায় মেসার্স করোনা অ্যাসোসিয়েটসের কাজী সাইফুলের নেতৃত্বে চক্রের সদস্যরা জাল কাগজপত্র তৈরি করে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে শুল্ক না দিয়েই ১০ কাভার্ড ভ্যান পণ্য সরিয়ে নেয়। এতে সরকার অন্তত ১৫ লাখ টাকা রাজস্ব হারায়।
তবে আসামিপক্ষের আইনজীবী জাকির হোসেন খান প্রথম আলোকে বলেন, কমলাপুরের আইসিডি থেকে দুই কনটেইনারের মালামাল শুল্কায়ন ছাড়া সরিয়ে নেওয়ার ঘটনায় তাঁর মক্কেলরা কেউ জড়িত নন। কাজী সাইফুলসহ অন্যরা পরিস্থিতির শিকার।
জালিয়াতি যেভাবে
সিআইডির অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, আইসিডি থেকে যে মালামাল সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল, সেই মালামালের প্রকৃত মালিক জান্নাত এন্টারপ্রাইজের মিজানুর রহমান। পেশায় তিনি একজন আমদানিকারক। চীন থেকে চারটি কনটেইনারে করে খেলনা জাতীয় মালামাল চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে কমলাপুরের আইসিডিতে আসে ২০১৮ সালের ২১ ডিসেম্বর। এরপর যথাযথ প্রক্রিয়ায় দুই কনটেইনারের মালামালের শুল্কায়ন প্রক্রিয়া শেষ করে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট মেসার্স করোনা অ্যাসোসিয়েটস।
তবে অপর দুটি কনটেইনারের মালামালের শুল্কায়ন প্রক্রিয়ায় জালিয়াতির আশ্রয় নেয় এই সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট। কনটেইনারের মালামাল সরিয়ে নিতে জাল ব্যাংক চালানের কাগজপত্র, জাল অ্যাসেসমেন্ট (মূল্যায়ন) নোটিশ তৈরি করে। আইসিডি দপ্তর থেকে দুই কনটেইনারের মালামাল খালাসের কাগজপত্র নেওয়া হয়। কিন্তু বাকি দুটি কনটেইনারের মালামাল শুল্ক না দিয়ে ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে ১০টি কাভার্ড ভ্যানে করে নিয়ে যাওয়া হয়।
সিআইডির তদন্তে বলা হয়, ওই সব কাগজপত্রে যেসব স্বাক্ষর ছিল, সেগুলো সঠিক বলে স্বীকার করেছেন এএসআই মোয়াজ্জেম হোসেন ও উচ্চমান বহি সহকারী জাহাঙ্গীর আলম। এই ঘটনায় আইসিডির গঠিত তদন্ত কমিটির কাছে তাঁরা স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। এ ছাড়া আইসিডির উচ্চমান বহি সহকারী মোহাম্মদ আখতার ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার জন্য মালামাল সরবরাহের স্লিপ দিয়ে আইনবহির্ভূত কাজ করেন বলে তাদের তদন্তে উঠে আসে।
এই মালামাল সরবরাহের সব কাগজপত্র জমা ছিল মোহাম্মদ আখতারের কাছে। পরে জিজ্ঞাসাবাদে আখতার বলেছেন, সেই ফাইল চুরি হয়ে গেছে। তবে এ নিয়ে থানায় কোনো সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেননি তিনি।
সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট মালামাল নেওয়ার যে আবেদন করেন, তাতে স্বাক্ষর করেছিলেন এএসআই মোয়াজ্জেম ও উচ্চমান বহি সহকারী জাহাঙ্গীর। এই দুজনই কনটেইনার দুটির চাবি মেসার্স করোনা অ্যাসোসিয়েটসের কর্মকর্তা সাইদুর রহমানের হাতে তুলে দেন বলে সিআইডির তদন্তে বেরিয়ে এসেছে।
অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, এই খেলনাসামগ্রীর আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান জান্নাত এন্টারপ্রাইজের মালিক মিজানুর রহমান পণ্য খালাসের জন্য করোনা অ্যাসোসিয়েটসের মালিক কাজী সাইফুলকে ১৫ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। কিন্তু কাজী সাইফুল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকে পণ্য খালাসের ভুয়া কাগজপত্র সরবরাহ করে আইসিডি কর্মকর্তা–কর্মচারীদের সঙ্গে মিলে এই টাকা হাতিয়ে নেন।
শুল্ক জালিয়াতির মাধ্যমে আইসিডি থেকে পণ্য খালাস করে জান্নাত এন্টারপ্রাইজের গুদামে নিয়েই রাখা হয়। তবে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে পণ্য খালাসের ঘটনা জানার পর সেই মালামাল আবার জব্দ করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। এ ঘটনায় উচ্চ আদালতে যায় জান্নাত এন্টারপ্রাইজ। আদালত তাদের পণ্য ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন।
জান্নাত এন্টারপ্রাইজের মালিক মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি পণ্য খালাসের জন্য করোনা অ্যাসোসিয়েটসকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম। তারা কোন প্রক্রিয়ায় পণ্য খালাস করেছে, আমি সেসবের কিছুই জানি না। এই প্রতারণার সঙ্গে আমি কোনোভাবেই জড়িত নই।’