মারা যাওয়া মাহমুদুর রহমানই হারিছ চৌধুরী কি না, নিশ্চিত নয় পুলিশ
সংবাদমাধ্যমে হারিছ চৌধুরীর মৃত্যুর খবর প্রকাশের পর এখন তাঁর খোঁজখবর শুরু করেছে পুলিশ। পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, ইন্টারপোলের রেড নোটিশভুক্ত এই আসামি জীবিত না মৃত, সে সম্পর্কে তাঁরা আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো কিছু জানেন না।
পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (মিডিয়া অ্যান্ড অপারেশনস) হায়দার আলী খান প্রথম আলোকে বলেন, তথ্যপ্রমাণ ছাড়া হারিছ চৌধুরীর মৃত্যুসংবাদ সম্পর্কে আনুষ্ঠানিকভাবে বলা যায় না। তিনি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। এর বাইরে তাঁর বিরুদ্ধে আরও বেশ কিছু মামলা রয়েছে। মামলাগুলোর তদন্তকারী কর্মকর্তাদের হারিছ চৌধুরী সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী মারা গেছেন বলে চলতি বছরের শুরুর দিকে খবর ছড়িয়ে পড়ে।
গত ১১ জানুয়ারি হারিছ চৌধুরীর চাচাতো ভাই সিলেট জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি ও কানাইঘাট উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আশিক উদ্দিন চৌধুরী ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন। এতে তিনি হারিছ চৌধুরী ও তাঁর ছবি যুক্ত করে লেখেন, ‘ভাই বড় ধন, রক্তের বাঁধন’।
পরদিন আশিক উদ্দিন চৌধুরী প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, প্রায় সাড়ে তিন মাস আগে যুক্তরাজ্যে হারিছ চৌধুরী মারা গেছেন। তাঁর দাফন যুক্তরাজ্যেই হয়েছে।
১৫ জানুয়ারি মানবজমিন পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়, হারিছ চৌধুরী করোনায় সংক্রমিত হয়ে ঢাকায় মারা গেছেন। প্রবাসী মেয়ে সামিরা চৌধুরী বলেন, তাঁর বাবা গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে মারা যান।
হারিছ চৌধুরী মারা গেছেন কি না, মারা গেলে তাঁর মৃত্যু লন্ডনে না ঢাকায়—এ নিয়ে অস্পষ্টতার মধ্যে ৬ মার্চ মানবজমিন আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ‘হারিছ নয়, মাহমুদুর রহমান মারা গেছেন’ শিরোনামের এই প্রতিবেদনে বলা হয়, হারিছ চৌধুরী দীর্ঘ ১৪ বছর দেশেই আত্মগোপনে ছিলেন। তিনি তাঁর নাম-পরিচয় বদল করেন। নতুন নাম নেন ‘মাহমুদুর রহমান’। এই নামেই তিনি নতুন জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট করেন। তিনি প্রায় ১১ বছর ঢাকার পান্থপথে ছিলেন। নিজেকে একজন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক বলে পরিচয় দিতেন। ৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে মৃত্যুর পর তাঁকে সাভারে দাফন করা হয়।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর হারিছ চৌধুরীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। একই বছরের ২৯ অক্টোবর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় হারিছ চৌধুরীর ৭ বছরের কারাদণ্ডের পাশাপাশি ১০ লাখ টাকা জরিমানা হয়। সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যা মামলার একজন আসামি তিনি। ইন্টারপোলের রেড নোটিশের তালিকায় এখনো তাঁর নাম রয়েছে। এমন একজন ব্যক্তির ১৪ বছর ধরে আত্মগোপনে থাকার বিষয়ে আদতে পুলিশের কাছে কোনো নিশ্চিত তথ্য নেই।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, হারিছ চৌধুরীর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর পুলিশ সদর দপ্তরের এনসিবি শাখা থেকে তাঁর সম্পর্কে তথ্য জানা প্রয়োজন বলে জানানো হয়।
এনসিবি শাখা ইন্টারপোলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। রেড নোটিশভুক্ত কোনো আসামির পরোয়ানা প্রত্যাহারের কথা ইন্টারপোলের কাছে এনসিবিকেই জানাতে হয়।
এর পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ সদর দপ্তর চিঠি পাঠায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত (সিআইডি) বিভাগকে। সিআইডির তত্ত্বাবধানে এখন বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে। এতে যুক্ত আছে সিলেট জেলা পুলিশ।
সিআইডির সংশ্লিষ্ট শাখার একটি দায়িত্বশীল সূত্র প্রথম আলোকে বলে, মধ্য জানুয়ারিতে হারিছ চৌধুরীর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ে। তারপর সিআইডি তাঁর মৃত্যুসনদের খোঁজ করতে শুরু করে। তবে এই সনদ তারা খুঁজেছে যুক্তরাজ্যসহ আরও কয়েকটি দেশে। তাদের স্থির বিশ্বাস, ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে অভিযান শুরু করলে হারিছ চৌধুরী দেশ ছেড়ে চলে যান। তারা বিভিন্ন সূত্রে জানতে পেরেছে, হারিছ চৌধুরী দেশে নেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাঁকে নিজ চোখে দেখেছেন দাবি করা লোকজনও আছে।
‘মাহমুদুর রহমান’ নামের যে ব্যক্তির কথা গণমাধ্যমের খবরে এসেছে, তাঁকে ২০১৩ সালে পাসপোর্ট ইস্যু করা হয়। পাঁচ বছর পর একই নামে পাসপোর্ট নবায়ন হয়। এই পাসপোর্ট নম্বর পরীক্ষা করে গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে সিআইডির এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, মাহমুদুর রহমান নামে ইস্যু হওয়া পাসপোর্টের বিপরীতে কোনো দেশ ভ্রমণের তথ্য নেই।
ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন সরদার গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা জানতে পেরেছেন, সাভারের একটি মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে ‘মাহমুদুর রহমান’ নামের এক ব্যক্তিকে ৪ সেপ্টেম্বর দাফন করা হয়। এই ব্যক্তিই হারিছ চৌধুরী কি না, তা তাঁরা নিশ্চিত নন।
এখন একটু একটু মিল পাচ্ছেন
পান্থপথের যে ভবনে ‘মাহমুদুর রহমান’ থাকতেন, সেখানকার বাসিন্দারা বিভিন্ন সময় হারিছ চৌধুরীর ছবি দেখেছেন। মোটা গোঁফ, চোখে কালো সানগ্লাস, পরনে হাফ শার্ট বা স্যুট-টাই ছাড়া হারিছ চৌধুরীর কোনো ছবির কথা তাঁরা কেউ মনে করতে পারেন না।
তবে ‘প্রফেসর মাহমুদুর রহমান’ নামের যে ব্যক্তি পান্থপথের ১২ তলা ভবনের একটি অ্যাপার্টমেন্টে এসে উঠেছিলেন, তাঁর ছিল লম্বা পাকা দাড়ি। তিনি পরতেন পায়জামা-পাঞ্জাবি।
পান্থপথের যে ভবনে ‘মাহমুদুর রহমান’ থাকতেন, সেখানকার তত্ত্বাবধায়ক সাইফুল ইসলাম ও নিরাপত্তারক্ষী আবদুল কাদেরের সঙ্গে গতকাল কথা হয়। তাঁরা গত তিন বছর ধরে এই ভবনে কাজ করছেন।
সাইফুল ও কাদের জানান, ১২ তলা ভবনে ৩৩টি ফ্ল্যাট রয়েছে। ‘মাহমুদুর রহমান’ প্রথমে ভবনের ১১ তলায় ও পরে ৮ তলায় থাকতেন। তিনি বাসায় একাই থাকতেন। বাজারসদাই নিজেই করতেন। প্রথমে একজন খণ্ডকালীন নারী গৃহপরিচারিকা তাঁর বাসায় কাজ করতেন। পরে তিনি মাদ্রাসাপড়ুয়া একটি ছেলেকে নিয়ে আসেন। তাঁর বাসায় মেহমান তেমন একটা আসতেন না। তিনি বলতেন, স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। মেয়েরা গুলশানে থাকেন। তবে গত বছরের আগস্টের শেষভাগে বাসায় তাঁর মেয়ে আসেন।
সাইফুল বলেন, একদিন ভোররাতের দিকে অসুস্থ অবস্থায় ‘মাহমুদুর রহমান’কে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ৪ বা ৫ সেপ্টেম্বর তাঁর ফ্ল্যাটের একটি বাল্ব ফিউজ হয়ে গেছে শুনে তিনি আটতলার বাসায় যান। গিয়ে শোনেন, ‘মাহমুদুর রহমান’ মারা গেছেন। তারপরও মাস দুই-এক তাঁর মেয়ে এই ফ্ল্যাটে ছিলেন।
জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্টের ছবি দেখে এখন ভবনটির তত্ত্বাবধায়ক-নিরাপত্তারক্ষীরা বলছেন, মারা যাওয়া মাহমুদুর রহমানের সঙ্গে এখন তাঁরা হারিছ চৌধুরীর চেহারার একটু একটু মিল পাচ্ছেন।