ন্যায়বিচার পেতে আইনগত সহায়তা চান যাবজ্জীবন পাওয়া সবুজ
প্রতিবছরের ২৮ এপ্রিল জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস পালিত হয়। দিবসটির অন্যতম লক্ষ্য দরিদ্র-অসহায় জনগণের ন্যায়বিচারে সহজ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা।
২০১২ সালে রাজধানীর গুলশান এলাকায় নিজ বাসায় খুন হন ব্যবসায়ী ফজলুল হক। এই হত্যা মামলায় গৃহকর্মী সবুজকে ২০১৫ সালে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন বিচারিক আদালত।
বিচারিক আদালতের কাছে সবুজ দাবি করেছিল, জন্মসনদ অনুযায়ী সে অপ্রাপ্তবয়স্ক। বয়স নিয়ে সবুজের আবেদন নাকচ করেন আদালত। ফলে সবুজের প্রকৃত বয়স কত, তা আর যাচাই–বাছাই করা হয়নি।
অবশ্য খুনের পর গ্রেপ্তার সবুজের বয়স কোথাও ১৯, কোথাও ২০, আবার কোথাও ২১ বছর উল্লেখ করেছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা।
দেশের জ্যেষ্ঠ পাঁচজন ফৌজদারি আইনজীবী বলছেন, কোনো আসামি যদি আদালতে নিজেকে অপ্রাপ্তবয়স্ক দাবি করে, তবে তার তদন্ত হওয়া জরুরি।
সবুজের বয়স
মামলার নথিপত্র অনুযায়ী, ২০১২ সালের ২৮ জুলাই দিবাগত রাতে ফজলুল হক খুন হন। মামলার এজাহারে কোনো আসামির নাম ছিল না।
ফজলুল হক খুনের অভিযোগে ২৯ জুলাই গৃহকর্মী সবুজকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে ঢাকার আদালতে তোলা হয়। প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) পুষ্পেন দেবনাথ মামলায় সবুজের বয়স দেখান ১৯ বছর।
মামলার দ্বিতীয় তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) পরিদর্শক মাহবুবুর রহমান আদালতে দেওয়া প্রতিবেদনে সবুজের বয়স দেখান ২০ বছর।
মামলার তৃতীয় তদন্ত কর্মকর্তা র্যাবের তৎকালীন এএসপি মোহাম্মদ রেজাউল কবির মামলার কাগজপত্রে সবুজের বয়স দেখান ২১ বছর। তবে র্যাবের দেওয়া অভিযোগপত্রে সবুজের বয়স ২০ বছর দেখানো হয়।
২০১৪ সালের ১৭ জুন মামলায় সবুজের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। বিচার চলাকালে সবুজের নিজের নিয়োগ করা কোনো আইনজীবী ছিলেন না। রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী শাহাবুদ্দিন আহমেদ আসামি সবুজের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন।
তিনি নিজ খরচে ওকালতনামায় স্বাক্ষর নিয়ে সবুজের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন।
আইনজীবী শাহাবুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বিনা পয়সায় আমি সবুজের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেছি। সবুজের একজন খালাতো ভাই দুই-একবার আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন।’
অভিযোগ গঠনের এক মাসের মাথায় ২০১৪ সালের ১৬ জুলাই সবুজের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আদালতে লিখিত আবেদন দিয়ে বলেন, জন্মসনদে আসামির জন্ম তারিখ লেখা রয়েছে ১৯৯৮ সালের ৩ জানুয়ারি। সে অনুযায়ী, আসামি অপ্রাপ্তবয়স্ক।
বয়স নির্ধারণে তদন্ত হয়নি
আইনজীবী শাহাবুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘জন্মসনদ অনুযায়ী, ঘটনার সময় সবুজ অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিল। তবে তাকে প্রাপ্তবয়স্ক দেখিয়ে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। সবুজের বয়স নিয়ে আদালতে আবেদন করা হলে, তা নাকচ হয়।’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘কেউ যদি আদালতে নিজেকে অপ্রাপ্তবয়স্ক দাবি করে, সে ক্ষেত্রে উচিত, তার বয়স নির্ধারণের জন্য তদন্তের ব্যবস্থা করা।’
সুপ্রিম কোর্টের অপর আইনজীবী এসএম শাহজাহান প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোর্টে আনার পর কেউ যদি নিজেকে শিশু দাবি করে, তখন কোর্টের পবিত্র দায়িত্ব হলো, এটা নিশ্চিত হওয়া যে সে শিশু কি না। এটা নিশ্চিত করতে হবে। কেউ যদি এটা নিশ্চিত না করেন, এড়িয়ে যান, কিন্তু দেখা যায় যে আসলে সে শিশু, তাহলে এটা আইনের লঙ্ঘন।
কারণ, আসামি শিশু হলে বিচার ভিন্ন হবে। আইন ও প্রক্রিয়া ভিন্ন হবে। এ ক্ষেত্রে আপিল শুনানিতে তা তুলতে হবে। এটা উচ্চ আদালতের দেখার দায়িত্ব রয়েছে।’
২০১৫ সালের ১৪ মে সবুজকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৪।
আইনগত সহায়তা চান
বিচারিক আদালতের রায়ের দুই বছর পর দণ্ডিত সবুজের পক্ষে উচ্চ আদালতে বিলম্ব মার্জনা চেয়ে আপিল করা হয়। এতে সহায়তা করেন আইনজীবী দেওয়ান আবদুন নাসের। আবেদন শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। এই পর্যায়ে সবুজের কোনো আইনজীবী নেই বলে জানিয়েছেন তাঁর খালাতো ভাই হান্নান।
হান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি একটি প্রতিষ্ঠানে পিয়ন পদে চাকরি করি। সবুজের মা মানসিক ভারসাম্যহীন। হাইকোর্টে মামলা চালাতে অনেক কাগজপত্র তুলতে হয়। আইনজীবী বাবদ খরচ আছে। কিন্তু খরচ দেওয়ার লোক সবুজের নেই। তিনি উচ্চ আদালতে ন্যায়বিচার পেতে আইনগত সহায়তা চান।’
আইনজীবী দেওয়ান আবদুন নাসের প্রথম আলোকে বলেন, ‘গরিব-অসহায় হিসেবে সবুজ সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটির সহায়তা পেতে পারেন।’
সবুজের ঘটনাটি নজরে আনার পর সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটির সমন্বয়ক রিপন পৌল স্কু প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলার কাগজপত্র যাচাই–বাছাই সাপেক্ষে সবুজকে আইনগত সহায়তা দেওয়া যেতে পারে।’
মামলা ও রায়
সবুজের গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ায়। তাঁর বাবা বেঁচে নেই। মা বেঁচে আছেন। তবে তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন বলে জানা গেছে। সবুজের খালু একসময় ব্যবসায়ী ফজলুল হকের বাসার বাগান পরিচর্যার দায়িত্বে ছিলেন। খালুর হাত ধরে সবুজ ফজলুল হকের বাসায় কাজে যোগ দেয়।
মামলার কাগজপত্রের তথ্য অনুযায়ী, ফজলুল হকের গুলশানের বাসাটি দুই তলাবিশিষ্ট। ২০১২ সালের ২৮ জুলাই রাত ১০টার দিকে খাওয়াদাওয়া শেষে দোতলায় নিজের কক্ষে ঘুমাতে যান তিনি। পরদিন সকালে তাঁকে বিছানায় রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। তাঁর গলায় জখমের চিহ্ন ছিল।
ফজলুল হকের স্ত্রী শামসুন্নাহার মামলায় বলেন, স্বামী ঘুমানোর পর তিনি দোতলার আরেকটি কক্ষে ঘুমান। কাছাকাছি আরেকটি কক্ষে ছিলেন ছেলে আজহারুল হক ও তাঁর স্ত্রী সাবিকুন্নাহার। চার নারী গৃহকর্মী খোরশেদা, কোহিনুর, আম্বিয়া ও লাইজু দোতলার একটি কক্ষে ঘুমান। গৃহকর্মী সবুজ, গাড়িচালক শাহাদাৎ ও আনোয়ার নিচতলায় ঘুমান। বাসার পাহারায় ছিলেন নিরাপত্তারক্ষী সুমন। পরদিন সকালে ফজলুল হককে তাঁর শোয়ার ঘরে মশারির ভেতর রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। তাঁর গলায় ছিল জখমের চিহ্ন। বিছানা রক্তে ভেজা। ফজলুল হকের ব্যক্তিগত ড্রয়ার ছিল খোলা। কাগজপত্র ছিল এলোমেলো।
মামলার কাগজপত্র বলছে, ঘটনার পর বাসায় চিকিৎসক ডেকে নিয়ে আসে সবুজ। খবর পেয়ে গুলশান থানা-পুলিশ ও পুলিশের অপরাধ ও তথ্য বিভাগের (সিআইডি) ক্রাইমসিন ইউনিটের সদস্যরা ঘটনাস্থলে যান। সন্দেহভাজন হিসেবে সবুজ ও সুমনকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। ঘটনার পরদিন স্ত্রী শামসুন্নাহার বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করে গুলশান থানায় মামলা করেন। খুনে জড়িত সন্দেহে সবুজ ও সুমনকে গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ।
সবুজ ও সুমনকে একাধিকবার রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। খুনের ৩৮ দিনের মাথায় হত্যায় ব্যবহৃত ছুরি ও লুণ্ঠিত ৫০ হাজার টাকা সবুজের দেখানো স্থান থেকে উদ্ধার করা হয় বলে আদালতকে জানায় ডিবি।
খুনের ঘটনায় আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় সবুজ। এতে সবুজ খুনের ঘটনায় জড়িত তিনজনের নাম প্রকাশ করে। অবশ্য সবুজের স্বীকারোক্তি সঠিক নয় বলে ডিবি আদালতে প্রতিবেদন দেয়।
২০১৩ সালের ৩০ জানুয়ারি সবুজের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় ডিবি। তবে আদালত ডিবির দেওয়া অভিযোগপত্র গ্রহণ করেনি। কারণ, ঘরের করিডরে পড়ে থাকা রক্ত কার ছিল, সে ব্যাপারে অভিযোগপত্রে কোনো তথ্যের উল্লেখ ছিল না।
আদালতের আদেশে বলা হয়, ঘটনার দিন করিডরে পাওয়া রক্তের সঙ্গে সবুজ বা ফজলুল হকের রক্তের কোনো মিল পাওয়া যায়নি। এই রক্তের উৎস সম্পর্কে তদন্ত কর্মকর্তা কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দেননি।
মামলাটি আবার তদন্তের জন্য র্যাবকে নির্দেশ দেন আদালত। আদালতের আদেশে মামলার তদন্তভার নেয় র্যাব। করিডরে পাওয়ার রক্তের উৎস জানতে ১৪ জনের ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু কারও রক্তের সঙ্গে মিল পাওয়া যায়নি।
আদালতে জমা দেওয়া ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরির (এনএফডিপিএল) প্রতিবেদনে বলা হয়, করিডরে পাওয়া রক্ত ও উদ্ধার হওয়া ছুরির বাঁটে লেগে থাকা রক্ত এক অজ্ঞাত ব্যক্তির।
করিডরে পাওয়া রক্তের উৎস বের না করেই র্যাব ২০১৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি আদালতে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয়।
বিচার চলাকালে ছুরিসহ সব আলামত রাষ্ট্রপক্ষ আদালতে উপস্থাপন করে। তবে এনএফডিপিএলের প্রতিবেদন আদালতে উপস্থাপন করা হয়নি।
রায়ে বিচারক বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্য অনুযায়ী, এই মামলায় প্রত্যক্ষদর্শী কোনো সাক্ষী নেই। মামলার সাক্ষী হিসেবে ফজলুল হকের স্ত্রী, ছেলে ও পুত্রবধূ সাক্ষ্য দিয়েছেন। সবুজের দেখানো স্থান থেকে হত্যায় ব্যবহৃত ছুরি জব্দ করা হয়েছে।
বিচারক রায়ে বলেন, আইনের স্বীকৃত নীতিমালা হলো, শুধু আত্মীয় হলেই সাক্ষীকে অবিশ্বাস করা যায় না। দেখতে হবে, সাক্ষী কতটুকু বিশ্বাসী। মামলার তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য ও তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনায় স্পষ্ট হয়েছে যে সবুজের দেখানো স্থান থেকে আলামত (ছুরি ও টাকা) উদ্ধার করা হয়েছে। আলামত উদ্ধারের ব্যাপারে আসামিপক্ষ থেকে বিপরীত কোনো বিশ্বাসযোগ্য বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়নি।