চীনে করোনা: উহান চাইয়ো, চঙ্গুয়া চাইয়ো
জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহ। সময়টা ছিল উৎসবের। বসন্ত উৎসব শুরু হবে। গোটা দেশ প্রস্তুত। এমন সময় হঠাৎ সবকিছু থেমে গেল। নতুন একটা ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে। বেইজিং সব সময় ব্যস্ত শহর। শুধু বছরের এই সময়টা সব ফাঁকা হয়ে যায়। কিন্তু এবারের বিষয়টা ভিন্ন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নোটিশগুলো দেখে মনে হচ্ছিল, জীবন হয়তো অন্য কোথায়। কারণ বেইজিংয়ের অবস্থা তেমন আশঙ্কাজনক ছিল না। কিন্তু জীবনযাপন চিত্রের ভয়াবহ পরিবর্তন করতে হয়েছে।
২৭ জানুয়ারিতে আমার দুই ব্রাজিলীয় বন্ধু দেশে চলে যায়। গভীর বন্ধুত্ব থাকার কারণে আমিও সেদিন এয়ারপোর্টে বিদায় জানাতে গিয়েছিলাম। বিষয়টা এখন হিলোসিনেশনের মতো লাগে আমার। সেদিন অনেক বিদেশিকে দেখেছিলাম বেইজিং ছেড়ে চলে যেতে। মজার বিষয় হলো যখম তাঁরা ইমিগ্রেশনে যান, তখন তাঁদের শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করার পর জিজ্ঞাসা করছিল গত দুই মাসে উহানে ভ্রমণ করেছিলেন কি না? আমি পাশে দাঁড়িয়ে ঘটনা দেখছি। উত্তরে বললেন, হ্যাঁ গিয়েছিলাম। তারপর তাঁদের ভেতরের ডেস্কে নিয়ে যান। পরে জানতে পারলাম, তাঁদের এক শিক্ষকের বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। তাঁরা এখন ব্রাজিলে সুস্থ আছেন। তাঁদের শিক্ষকও সুস্থ আছেন। আসলে বিশ্বব্যাপী ধারণা হয়েছে যে চীনা মানুষের সংস্পর্শে এলেই এ ভাইরাসটি হবে। এটি ভুল। কারণ করোনা থেকে সুস্থ হয়ে ফেরা মানুষের সংখ্যাটাও পজেটিভ মাত্রার।
করোনার সময়ে চীনে যে বিষয়টি সব থেকে বেশি উৎসাহ দিয়েছে, গণচীনের মানুষের মানসিক দৃঢ়তা। আমার বিশ্ববিদ্যালয় অজানা কারণে তখন লকডাউন করেনি। প্রয়োজনে বের হতাম। আশপাশের মানুষ সচেতনতামূলক পদক্ষেপগুলো অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেছেন। এমনকি তাঁরা বসন্ত উৎসবের দিনগুলোতে আতশবাজিও ফুটিয়েছে। উহান শহর পুরোপুরি লকডাউন ছিল। সেখানকার বিল্ডিংগুলোর জানালা থেকে ভেসে এসেছে আশাবাদী চারটি শব্দ—উহান চাইয়ো, চঙ্গুয়া চাইয়ো (উহান এগিয়ে চলো, চীন এগিয়ে চলো)।
মজার বিষয় হলো উহানের হাসপাতালগুলোতে নিয়মিত চিকিৎসাসেবা দেওয়ার পাশাপাশি তারা বিনোদনমূলক সেবার ব্যবস্থা করেছিল। যেমন নাচ, গান, শারীরিক ব্যায়াম ইত্যাদি। এতে রোগীদের শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি মনোবল দৃঢ় হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতেও নিয়মিত আশাবাদমূলক খবর প্রকাশ করা হতো।
করোনার মতো মহামারির সময়ে যে বিষয়টা সবচেয়ে বেশি দেখা দেয় সেটা হলো দুচিন্তা। দিনের পর দিন ঘরে বসে থাকাটাও সহজ বিষয় নয়। কিন্তু এ সময় ইন্টারনেট একটা বিশেষ পজিটিভ মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। আমরা খুব সহজে ভিডিও কলের মাধ্যমে কাছের মানুষের সঙ্গে দূরত্বের অভাব মেটাতে পারি। আমার গত তিন মাসে সব থেকে উপকারী জিনিস ছিল সামাজিক যোগাযোগ। চীন ও চীনের বাইরের বন্ধু ও কাছের মানুষের সঙ্গে সর্বক্ষণ যোগাযোগ করেছি। এতে মানসিক একঘেয়েমি দূর হয়ে যায়। বাংলদেশে যাঁরা কোয়ারেন্টিনে বন্দী আছেন, তাঁদের জন্য সময়টা সুখময় করতে, বই পড়া ও যাঁর যা শখ আছে, সেটায় সময় দেওয়া একটা বড় মাধ্যম হবে।
এখন বসন্ত চলছে। নতুন ফুল ফুটছে চারপাশে। চীনের মতো বাংলাদেশের মানুষের মাঝে আশার ফুল ফুটুক। পাশাপাশি সব নিয়মাবলি মেনে দ্রুত জীবনের আহ্বানে ফিরে আসুক সবাই।
* লেখক: ভিজিটিং ফেলো, ইন্টারন্যাশনাল জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন ডিপার্টমেন্ট, কমিউনিকেশন ইউনিভার্সিটি অব চায়না, বেইজিং, চীন।