করোনায় মৃত্যু বাড়ছে যেসব কারণে
করোনার ডেল্টা বা অমিক্রন, ক্ষতির দিক থেকে কেউ কারও চেয়ে কমজোরি নয়—এ বিশ্বাস রাখা উচিত বলে পরামর্শ জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেনের। এ অসচেতনতার অভাব মৃত্যুর কারণ হচ্ছে বলেও মনে করেন তিনি।
দেশে করোনা সংক্রমণের গতি কিছুটা কমলেও দিন দিন বাড়ছে মৃত্যু। এর পেছনে অন্তত ছয়টি কারণ আছে বলে মনে করছেন করোনার চিকিৎসার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত চিকিৎসক, বিশেষজ্ঞ ও জনস্বাস্থ্যবিদেরা। তাঁরা বলছেন, আরও এক সপ্তাহের বেশি মৃত্যুর এ ঊর্ধ্বগতি থাকবে। তারপর এ প্রবণতা কমতে পারে।
চার সপ্তাহ ধরে করোনায় মৃত্যু বাড়ছেই। ১০ থেকে ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে করোনায় মৃত্যু হয়েছিল ৪২ জনের। পরের সপ্তাহে অর্থাৎ ১৭ থেকে ২৩ জানুয়ারি মারা যান ৭৯ জন। মৃত্যুর এ হার তার আগের সপ্তাহের চেয়ে ৮৮ শতাংশ বেশি। ২৪ থেকে ৩০ জানুয়ারি মারা যান ১৪০ জন। এ সংখ্যাও তার আগের সপ্তাহের চেয়ে ৭৭ শতাংশ বেশি।
জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, টিকা না থাকা এসব মৃত্যুর একটি বড় কারণ। দেখা গেছে যেসব ব্যক্তি মারা যাচ্ছেন, তাঁদের উল্লেখযোগ্য অংশ টিকার একটি ডোজও নেননি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গত সোমবারের (৭ ফেব্রুয়ারি) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ৩১ জানুয়ারি থেকে ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এ এক সপ্তাহে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান ২২৬ জন। এর মধ্যে ১৬১ জন বা ৭১ শতাংশই কোনো টিকা নেননি। ৬৫ জন বা ২৮ শতাংশের বেশি ব্যক্তি টিকা পেয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে আবার প্রথম ডোজ পেয়েছিলেন ২৫ জন আর ৪০ জন দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছিলেন। তবে তৃতীয় ডোজ পাননি কেউ।
জনস্বাস্থ্যবিদ ও সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘মৃত্যুর সংখ্যা এখন একটু বেশি। তবে এ সংখ্যা কিন্তু এর আগে ২০০–এর ঘরেও আমরা দেখেছি। সে তুলনায় এ সংখ্যা বেশি নয়। তবে এবার তারপরও যে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে, তার পেছনে একটি বড় কারণ টিকা না থাকা।’
গত ২৪ থেকে ৩০ জানুয়ারি যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের ৭৬ দশমিক ৪ শতাংশ রোগীর বয়স ৫১ থেকে ৯০ বছরের বেশি। পরের সপ্তাহে অর্থাৎ ৩১ জানুয়ারি থেকে ৬ ফেব্রুয়ারি সময়ে ৫১ থেকে ৯০ বছরের বেশি বয়সীদের মৃত্যুর হার ৮৪ দশমিক ৬ শতাংশ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ প্রায় ২৮ শতাংশ মারা গেছেন ৬১ থেকে ৭০ বছর বয়সীরা।
বেশি বয়সী রোগীদের কোমর্বিডিটি বা নানা ধরনের পার্শ্ব অসুখ মৃত্যুর একটি কারণ বলে মনে করেন খুলনা মেডিকেল কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল ডা. মেহেদি নেওয়াজ। তিনি এ কলেজের করোনা প্রতিরোধসংক্রান্ত কমিটির প্রধান সমন্বয়কারী। ডা. মেহেদি নেওয়াজ বলছিলেন, ‘আমরা দেখেছি বেশির ভাগ রোগীর কোমর্বিডিটি আছে। আর এ কারণে মৃত্যু ঘটছে।’
হয়তো অনেকে দেখছেন সাধারণ সর্দি–কাশি হলে ঠিক হয়ে যাচ্ছে। তাই অনেকে টেস্ট করছেন না। কিন্তু যাঁদের জটিল সমস্যা আছে, তাঁদের তো এসব বিষয় হেলাফেলা করলে চলবে না। তখন এ গা ছাড়া ভাব ভয়ানক পরিণতি ডেকে আনছেঅনিরুদ্ধ ঘোষ, অধ্যাপক, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ৩১ জানুয়ারি থেকে ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যে ২২৬ জনের মৃত্যু হয়েছে, তাঁদের মধ্যে প্রায় ৫২ শতাংশের কোমর্বিডিটি ছিল। এর আগের সপ্তাহে মৃতদের মধ্যে কোমর্বিডিটির হার ছিল ৬১ দিশমিক ৪ শতাংশ। ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপ এ দুইয়ের সমস্যা সবচেয়ে বেশি। গেল সপ্তাহে মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে ৪৯ শতাংশের বেশি ব্যক্তির ডায়াবেটিস ছিল। ৬৮ শতাংশের বেশি মানুষের ছিল উচ্চ রক্তচাপ। এর আগের সপ্তাহে মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে ডায়াবেটিস ছিল ৬১ শতাংশের এবং উচ্চ রক্তচাপ ছিল ৬৫ শতাংশের বেশি রোগীর। অন্য অসুখগুলোর মধ্যে প্রথমের দিকে আছে কিডনিজনিত রোগ। গেল সপ্তাহে মৃতদের ৩১ শতাংশের বেশি রোগীর কিডনিজনিত রোগ ছিল। আর যেসব অসুখ আছে, তার মধ্যে হৃদ্রোগ ও বক্ষব্যাধি প্রধান।
অমিক্রন ডেল্টা চেয়ে কমজোরি, এমন একটা ধারণা জনমনে থাকা অসুখ দ্রুত বেড়ে যাওয়া এবং মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ার কারণ বলেও মনে করছেন চিকিৎসকদের অনেকে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক অনিরুদ্ধ ঘোষ বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘হয়তো অনেকে দেখছেন সাধারণ সর্দি–কাশি হলে ঠিক হয়ে যাচ্ছে। তাই অনেকে টেস্ট করছেন না। হয়তো এভাবে সুস্থও হচ্ছেন। কিন্তু যাঁদের জটিল সমস্যা আছে, তাঁদের তো এসব বিষয় হেলাফেলা করলে চলবে না। তখন এ গা ছাড়া ভাব ভয়ানক পরিণতি ডেকে আনছে।’
সোমবার সকাল আটটা থেকে গতকাল মঙ্গলবার সকাল আটটা পর্যন্ত দেশে মোট ৪৩ মৃত্যুর মধ্যে চট্টগ্রামে মৃত্যু হয় ১১ জনের।
করোনার ডেল্টা বা অমিক্রন, ক্ষতির দিক থেকে কেউ কারও চেয়ে কমজোরি নয়—এ বিশ্বাস রাখা উচিত বলে পরামর্শ জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেনের। এ অসচেতনতার অভাব মৃত্যুর কারণ হচ্ছে বলেও মনে করেন তিনি।
করোনার প্রতিরোধে জরুরি স্বাস্থ্যবিধি মানার হার আগের চেয়ে কম বলে মনে করছেন ডা. অনিরুদ্ধ ঘোষ। তাঁর মত, সচেতনতার অভাবে এ গা ছাড়া ভাব ক্ষতি ডেকে আনছে।
আর এ অসচেতনতার কারণে করোনার তীব্রতা বেড়ে গেলে শেষ মুহূর্তে রোগী নিয়ে আসা হচ্ছে মৃত্যুর আরেকটি কারণ, এমনটাই মনে করছেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজর মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আজিজুল হক আজাদ। শুরুতেই যদি রোগীদের জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা এবং প্রয়োজন হলে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়, তবে এ মৃত্যু কম হতে পারত।
পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়লে হাসপাতালে রোগী নিয়ে আসার প্রবণতা দেশে করোনা সংক্রমণের শুরু থেকেই ছিল বলে মন্তব্য করেন মুশতাক হোসেন। আর সেটা এখনো রয়ে গেছে।
রাজশাহী মেডিকেলে সাম্প্রতিক সময়ে করোনায় যেসব রোগী মারা যাচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ গ্রামের বলে জানান এই হাসপাতালের ডা. আজিজুল হক। তিনি বলেন, গ্রামাঞ্চলে করোনার স্বাস্থ্যবিধির ঢিলেঢালা ভাব আছে। আবার প্রয়োজনমতো চিকিৎসা নেওয়ার ক্ষেত্রেও গাফিলতি লক্ষ করা যায়। স্বাস্থ্য পরিকাঠামোরও সীমাবদ্ধতা আছে। তাই প্রত্যন্ত এলাকায় রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে গেলে তাদের নিয়ে আসা হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রেও শুরুতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে ক্ষতি রোধ করা যেত, মনে করেন এই চিকিৎসক।
এখন যাঁরা মারা যাচ্ছেন, তাঁদের অনেকেই দুই সপ্তাহ আগের রোগী বলে মনে করেন আইইডিসিআরের উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন। এখন সংক্রমণপ্রবণতা কম হলেও আগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মৃত্যু ঘটছে। তবে সংক্রমণ পরিস্থিতি এখন কিছুটা নিম্নমুখী। এ অবস্থায় আরও এক সপ্তাহের বেশি সময়ের পর মৃত্যুর সংখ্যা কমতে পারে, মনে করছেন মুশতাক হোসেন।