রাজধানীর ধানমন্ডির বাসিন্দা রওনক খান মহামারির শুরুর দিকে করোনায় সংক্রমণের আতঙ্কে ছিলেন। ছয় মাসে সেই আতঙ্ক কিছুটা দূর হয়েছে। কিন্তু এখন তাঁর দুশ্চিন্তা টিকা নিয়ে। টিকার পরীক্ষা (ট্রায়াল) সফল হবে কি না, সফল হলে কবে টিকা উৎপাদন শুরু হবে—এসব বিষয়ে তাঁর প্রশ্ন যেমন আছে, সঙ্গে আছে উদ্বেগ। গতকাল শুক্রবার তিনি এই প্রতিবেদকের কাছে জানতে চান, ‘বাংলাদেশে টিকা আসবে কবে? টিকা আমরা পাব কীভাবে? আদৌ পাব তো?’
রওনক খানের প্রশ্নের মধ্যে টিকা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আছে। পাশাপাশি আছে টিকা না পাওয়ার আশঙ্কার কথা, কিছুটা হতাশা। এই আকাঙ্ক্ষা, এই আশঙ্কা ও এই হতাশা বহু মানুষের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের অনেক দেশেই। বাংলাদেশ টিকা সংগ্রহ, কেনা এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কারা টিকা পাবে, সে ব্যাপারে কাজ শুরু করেছে।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সফল ও কার্যকর টিকা তৈরি হওয়ার পর প্রথম সংকট দেখা দিতে পারে টিকার প্রাপ্যতা নিয়ে। সব দেশ টিকা উৎপাদন করতে পারবে না। কিছু দেশের টিকা উৎপাদন করার সক্ষমতা আছে। বিশ্বের সব দেশের সব মানুষের জন্য টিকা উৎপাদন করা ওষুধ কোম্পানিগুলোর পক্ষে এক-দুই বছরে সম্ভব হবে না। তাই প্রশ্ন উঠেছে করোনার টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে কারা অগ্রাধিকার পাবে। এই অগ্রাধিকার কে ঠিক করবে, কীভাবে ঠিক করবে?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি ন্যায়সংগত পন্থায় টিকা বিতরণের বা বরাদ্দের কথা বলছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, আর্জেন্টিনা, সিঙ্গাপুর, নরওয়ে, নেদারল্যান্ডসের ১৯ জন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও নীতিবিদ বলেছেন, ন্যায়সংগতভাবে টিকা বিতরণের কথা বলা হলেও কোন কাঠামো বা ফ্রেমওয়ার্কের মাধ্যমে কাজটি করা হবে, তা বলা হচ্ছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নেতৃত্বে কোভ্যাক্সের (কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন গ্লোবাল অ্যাকসেস) মাধ্যমে যেভাবে টিকা বিতরণের কথা বলা হচ্ছে, তা ত্রুটিপূর্ণ বলে তাঁরা দাবি করছেন। এ বিষয়ে তাদের লেখা ‘আ ইথিকাল ফ্রেমওয়ার্ক ফর গ্লোবাল ভ্যাকসিন অ্যালোকেশন’ শীর্ষক প্রবন্ধ ৩ সেপ্টেম্বর সায়েন্স সাময়িকীতে ছাপা হয়েছে। প্রবন্ধে তারা অগ্রাধিকার ঠিক করতে নতুন প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন।
‘টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে হবে। যার দরকার তিনি যেন টিকা পান।’নিজামুল হক নাসিম, বিচারপতি
তবে মানুষের টিকা পাওয়ার ব্যাপারে বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে হবে। যার দরকার তিনি যেন টিকা পান।’
গত বছর ডিসেম্বরের শেষে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে নতুন করোনাভাইরাস প্রথম শনাক্ত হয়। এরপর দ্রুতই এই ভাইরাস বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।
আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি মৃত্যু বাড়তে থাকে। নতুন এই সংক্রমণ নিরাময়ে কার্যকর কোনো ওষুধ নেই, আবিষ্কৃতও হয়নি। আবার এই সংক্রমণ সহজে শেষ হয়ে যাবে না। এর প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হিসেবে টিকার কথাই ভাবা হচ্ছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় ২০০ টিকা তৈরির কাজ চলছে। চীন, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন টিকা তৈরির ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে। টিকাগুলো সফল ও কার্যকর কি না, তা জানতে মানুষের শরীরে পরীক্ষামূলক ব্যবহার বা ট্রায়াল শুরু হয়েছে। অন্যদিকে রাশিয়া দাবি করেছে, তারা ইতিমধ্যে টিকা তৈরি করে ফেলেছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যার প্রয়োজন তাকে টিকা দেওয়া নিশ্চিত করাও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
বৈশ্বিক উদ্যোগ
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, দ্য গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমুনাইজেশন (গ্যাভি) ও কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপিয়ার্ডনেস ইনোভেশনস (সিইপিআই) যৌথভাবে কোভ্যাক্স উদ্যোগ গড়ে তুলেছে। বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন, গ্লোবাল ফান্ডসহ অনেক প্রতিষ্ঠান এই উদ্যোগে অর্থায়ন করছে। কোভ্যাক্সের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান থেকে টিকা কিনে উন্নয়নশীল দেশের মানুষের জন্য দেওয়া হবে।
এ ধরনের দেশগুলোর সব মানুষের জন্য টিকা সরবরাহ করতে পারবে না কোভ্যাক্স। এ ক্ষেত্রে কারা অগ্রাধিকার পাবে—এ প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক ফেরদৌসী কাদরি বলেন, ‘ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। এই তালিকায় আছে স্বাস্থ্যকর্মী, সামনের সারির কর্মী, বয়স্ক জনগোষ্ঠী এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভোগা মানুষ।’ ফেরদৌসী কাদরি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার টিকাবিষয়ক বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য।
ফেরদৌসী কাদরি বলেন, টিকার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের সুনাম আছে। করোনার টিকার ব্যাপারে বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্যাভির সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। এই বিষয়গুলো টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে এগিয়ে রাখতে সহায়তা করবে।
বাংলাদেশের প্রস্তুতি
বাংলাদেশ একাধিক উৎস থেকে টিকা পাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। বাংলাদেশ রাশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করে জেনেছে, ওই দেশের প্রতিটি টিকা কিনতে খরচ হবে ৮৫০ টাকা। আর গ্যাভির কাছ থেকে পেতে প্রতি টিকার পেছনে খরচ হবে ২৭ টাকা। আগামী বছরের জুন-জুলাইয়ের আগে সেই টিকা পাওয়া যাবে না। ২৮ আগস্ট পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সভার কার্যবিবরণীতে এসব তথ্য আছে।
বাংলাদেশে চীনের সিনোভ্যাক কোম্পানির টিকার পরীক্ষা শুরু হতে যাচ্ছে। সেই পরীক্ষা সফল হলে বাংলাদেশ ১ লাখ ১০ হাজার টিকা বিনা মূল্যে পাবে। কোভ্যাক্স থেকে কত টিকা পাওয়া যাবে, তা এখনো নিশ্চিত নয়। এ ছাড়া ভারতের কাছ থেকে টিকার সহায়তা পাবে। কত টিকা পাবে, তার নিশ্চয়তা নেই। এ ছাড়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ ওষুধ ব্যবসায়ীরাও টিকা কেনার উদ্যোগ নিচ্ছে।
বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের জন্য কীভাবে টিকার অগ্রাধিকার ঠিক করা হবে, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। দেশে টিকার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কাজটি করে ইন্টার এজেন্সি কো–অর্ডিনেশন কমিটি (আইসিসি)। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি ছাড়াও বড় বড় এনজিও এবং দাতাদের প্রতিনিধি আইসিসির সদস্য।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইসিসির একজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, করোনা টিকার যাবতীয় বিষয় ঠিক করার জন্য ১৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি কারিগরি কমিটি তৈরির প্রস্তাব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। ওই কমিটি কোভ্যাক্সের টিকা আনা, অগ্রাধিকার নির্ধারণ, বাণিজ্যিকভাবে টিকা আমদানি—এসব বিষয়ে সরকারকে নীতি পরামর্শ দেবে। ওই সরকারি কর্মকর্তা বলেন, টিকার কারণে যাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কোনো অবনতি না হয়, তার ব্যাপারেও সরকার সতর্ক আছে। খুব শিগগির কমিটি চূড়ান্ত করাসহ কৌশলপত্র তৈরির কাজ শেষ হবে।
সরকারের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশে মাইনাস ১৫ ডিগ্রি তাপমাত্রায় টিকা রাখার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু করোনার কোনো টিকা সংরক্ষণের জন্য মাইনাস ৮০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় রাখা দরকার হতে পারে। সে ক্ষেত্রে টিকা আনলে বাংলাদেশের টিকা ব্যবস্থাপনাকে ঢেলে সাজানোর দরকার হতে পারে।
প্রাথমিকভাবে প্রতিটি দেশের ৩ শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়া হবে। এরপর আস্তে আস্তে ২০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনা হবে।
১৯ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের প্রস্তাব
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, প্রাথমিকভাবে প্রতিটি দেশের ৩ শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়া হবে। এরপর আস্তে আস্তে ২০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনা হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতে বহু মানুষ ঝুঁকির মধ্যে থাকবে।
ওই ১৯ জন বিশেষজ্ঞ বলছেন, সুষ্ঠু অগ্রাধিকার নির্ধারণের জন্য তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রথমত, দেখতে হবে করোনার টিকা পেয়ে মানুষ যেন লাভবান হয়, ক্ষতি কমানো সম্ভব হয়। টিকা দেওয়ার মাধ্যমে কতখানি রোগগ্রস্ততা কমানো ও মৃত্যু কমানো যায়, তার হিসাব করতে হবে। মহামারির কারণে হাসপাতালের ওপর যে চাপ পড়েছে টিকা দেওয়ার মাধ্যমে তা যেন কমে, এর মাধ্যমে যেন দারিদ্র্য বা স্কুল বন্ধ রাখার মতো সমস্যাগুলো দূর হয়।
দ্বিতীয়ত, টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে সুবিধাবঞ্চিতদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। নৈতিকতা ও বৈশ্বিক স্বাস্থ্য চিন্তার এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। সেই কারণে বিভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন ধরনের সুবিধাবঞ্চিত গোষ্ঠীর মূল্যায়ন হওয়া দরকার। দেখতে হবে সবচেয়ে দরিদ্র কারা বা কোন গোষ্ঠীর মধ্যে গড় আয়ু কম, এরা যেন টিকা পায়।
তৃতীয়ত, দেখতে হবে লিঙ্গ, জাতি বা ধর্মের কারণে কেউ যেন টিকা পাওয়া থেকে বঞ্চিত না হয়। এ ক্ষেত্রে কোনো দেশের কোনো জনগোষ্ঠীর মানুষ বেশি টিকা পেলেও তা বৈষম্য সৃষ্টি করবে না যদি তা সব মানুষের জন্য সুফল বয়ে আনে।
বিশেষজ্ঞরা তাদের ধারণাকে বলছেন ‘সুষ্ঠু অগ্রাধিকার মডেল’ (ফেয়ার প্রায়োরিটি মডেল)। এটি বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সরকার, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও টিকা উৎপাদনকারীদের।