আঁচল ফাউন্ডেশনের জরিপ
৮৪% শিক্ষার্থী মানসিক সমস্যায়
তাঁদের মধ্যে সরকারি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীই বেশি। বড় প্রভাব রেখেছে মুঠোফোন, কম্পিউটারে বেশি সময় কাটানো।
করোনাকালে দেশের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের ৮৪ শতাংশের বেশি মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। তাঁদের ৪ ভাগের ৩ ভাগ শিক্ষার্থী পড়ালেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। এ সময় গ্রামে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি দেখা গেছে। মানসিক সমস্যা বেশি হয়েছে নারী শিক্ষার্থীদের।
বেসরকারি সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের এক জরিপে এই চিত্র উঠে এসেছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর করোনা মহামারির প্রভাব খতিয়ে দেখতে ‘করোনায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মানসিক বিপর্যয়’ শিরোনামে জরিপটি করেছে তারা। গত ১২ থেকে ২৬ সেপ্টেম্বর পরিচালিত জরিপে সারা দেশের ৯২টি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ হাজার ৫৫২ শিক্ষার্থীর বক্তব্য নেওয়া হয়। এ বিষয়ক বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন তাঁরা। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরাও রয়েছেন। শিক্ষার্থীদের প্রায় ৬১ শতাংশ নারী। তৃতীয় লিঙ্গের ছিলেন ১ জন। শিক্ষার্থীদের বয়স ছিল ১৮ থেকে ২৮ বছর। এর মধ্যে বেশির ভাগই ছিলেন ১৮ থেকে ২৩ বছর বয়সী।
আমাদের অনেক শিক্ষক ও অভিভাবকের মধ্যে দেড় বছরের পড়াশোনা দেড় মাসে করিয়ে ফেলার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এতে হিতে বিপরীত হবে।
আগামীকাল রোববার বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস সামনে রেখে এই জরিপ করেছে আঁচল ফাউন্ডেশন। তাদের এই জরিপকে বর্তমান সময়ের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে দেখছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মাহাজাবীন হক। তিনি গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, এ জরিপ বৈশ্বিক এক প্রবণতাকেই তুলে ধরেছে। করোনার কারণে সারা বিশ্বে তরুণদের মধ্যে নানা বিষয় নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। তাদের স্বাভাবিক জীবন ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তাই এ বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়া জরুরি।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। বিষয়টি জরিপ পরিচালনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ জানিয়েছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘তরুণদের আত্মহননের এ চিত্র আমাদের ভাবিয়েছে। তাই আমরা এবার মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর করোনার প্রভাব দেখার চেষ্টা করেছি। ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা, একাকিত্ব, করোনায় মৃত্যুভয়, সেশনজট ও বিয়ের জন্য পীড়াপীড়ির মতো বিষয় স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে বলে আমাদের জরিপে উঠে এসেছে।’
জরিপের ফল
জরিপে দেখা গেছে, ৮৪ দশমিক ৬ শতাংশ শিক্ষার্থী বিষণ্নতাসহ নানা মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। এঁদের মধ্যে সরকারি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীই বেশি। করোনার এই দেড় বছরে গ্রামে থাকা শিক্ষার্থীদের ৮৬ দশমিক ২ ভাগ মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। মানসিক সমস্যায় ভোগা নারী শিক্ষার্থীর হার পুরুষের চেয়ে ৭ শতাংশ বেশি। অঞ্চল ভিত্তিতে সবচেয়ে বেশি মানসিক সমস্যায় সিলেটের শিক্ষার্থীরা।
এসব শিক্ষার্থীর একটি বড় অংশ নিয়মমতো ঘুমাতে যান না। তাঁরা মুঠোফোন, ল্যাপটপ ও কম্পিউটারের সামনে বেশি সময় কাটান। যাঁরা পর্দার সামনে বেশি থাকেন, তাঁদেরই বিষণ্নতায় ভোগার হার বেশি। যাঁরা দিনে সাত ঘণ্টার বেশি সময় পর্দার সামনে কাটিয়েছেন, তাঁদের অধিকাংশই বিষণ্নতায় ভুগছেন। করোনাকালে অনলাইনে ক্লাস হয়েছে। এই ক্লাস নিয়ে অসন্তুষ্ট বেশির ভাগ শিক্ষার্থী।
দেশে করোনা সংক্রমণ কমায় দেড় বছর পর গত মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো খুলেছে। মেডিকেল কলেজগুলো খুলেছে আরও আগে। চলতি মাসেই দেশের আরও ২২টি বিশ্ববিদ্যালয় খুলছে। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়া উচিত বলে মনে করেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পরপরই শিক্ষার্থীদের ওপর পড়াশোনার ব্যাপক চাপ দেওয়া একেবারে উচিত হবে না। আমাদের অনেক শিক্ষক ও অভিভাবকের মধ্যে দেড় বছরের পড়াশোনা দেড় মাসে করিয়ে ফেলার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এতে হিতে বিপরীত হবে।’
এই মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ, শুরুতে কিছুদিন পাঠ্য বিষয়ের পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রমকে প্রাধান্য দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের বিনোদনমূলক কাজে অংশ নিতে দিতে হবে।