শয্যার আশায় রোগী ও স্বজনের ছোটাছুটি

ঢাকার হাসপাতালগুলোতে অন্য জেলা থেকে সংকটাপন্ন করোনা রোগী বেশি আসছেন। করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত আইসিইউ শয্যাও শেষ হয়ে আসছে। আইসিইউ না পেয়ে নারায়ণ নামের এই রোগীকে নেওয়া হচ্ছে অন্য হাসপাতালে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
ফাইল ছবি।

তিন দিন ধরে রাজধানীর নন্দীপাড়ার বাসিন্দা পেয়ারা বেগমের জ্বর, শ্বাসকষ্ট। সিলিন্ডারের অক্সিজেন ছাড়া শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল ষাটোর্ধ্ব এই নারীর। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে বের হন স্বজনেরা। প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ও পরে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেসে নেওয়া হয়। কিন্তু নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) শয্যা খালি না থাকায় দুই জায়গার কোথাও তাঁকে ভর্তি করানো যায়নি।

সেখান থেকে পেয়ারাকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সটি বেলা আড়াইটায় পৌঁছায় সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। পেয়ারার ছেলে অলি হোসেন হাসপাতালের ভেতরে গিয়ে ভর্তির বিষয়ে খোঁজ নেন। কিন্তু আইসিইউ শয্যা ফাঁকা না থাকায় তাঁকে ভর্তি করা যায়নি। এরপর তাঁকে নিয়ে পরিবারের সদস্যরা ছোটেন মহাখালীতে ডিএনসিসি করোনা হাসপাতালের উদ্দেশে। শেষ পর্যন্ত সেখানে ভর্তি করানো সম্ভব হয়।

মাকে নিয়ে হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত অলি হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাসপাতালের পরিস্থিতি কতটা খারাপ, তা নিজেরা না এলে বুঝতাম না। আইসিইউ নাই বলে হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে দিচ্ছে।’

গতকাল বেলা আড়াইটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে দেখা যায়, কিছুক্ষণ পরপর করোনা শনাক্ত বা করোনার উপসর্গযুক্ত রোগী নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স আসছে। দেড় ঘণ্টায় হাসপাতালে এমন রোগী আসেন ৮ জন। তাঁদের মধ্যে চারজনকে ভর্তি করা হয়। আর চারজনকে ফেরত পাঠানো হয়।

ফিরে যাওয়া রোগীদের একজন সাভারের মোহাম্মদ হোসেন আলী। শ্বাসকষ্টের সমস্যা দেখা দেওয়ায় প্রথমে স্থানীয় একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকে। নমুনা পরীক্ষায় তাঁর করোনা ধরা পড়ে। শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়ায় চিকিৎসকেরা তাঁকে আইসিইউ সুবিধা আছে, এমন হাসপাতালে ভর্তি করাতে বলেন। পরে আনা হয় সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। তাঁর ছেলে আনোয়ার হোসেন বলেন, আইসিইউ ফাঁকা নেই, তাই এখানে তাঁর বাবাকে ভর্তি করানো যায়নি।

গতকাল সকালে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল শ্যামলী এলাকার বাসিন্দা করোনায় আক্রান্ত আবদুল মান্নানকে। দুপুরের দিকে তাঁর শ্বাসকষ্টের সমস্যা তীব্র হয়ে ওঠে। এ সময় তাঁর জন্য হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলার প্রয়োজন দেখা দেয়। কিন্তু হাসপাতালে এই সেবা দেওয়ার মতো পরিস্থিতি (জরুরি অক্সিজেন দরকার এমন রোগী বেশি) তখন না থাকায় স্বজনেরা দ্রুত তাঁকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান।

রাজধানীতে করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত সরকারি হাসপাতালে একটি শয্যা পেতে এখন রীতিমতো যুদ্ধ করতে হচ্ছে। ফাঁকা শয্যার আশায় রোগীকে নিয়ে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটতে হচ্ছে স্বজনদের। রোগীর অক্সিজেনের চাহিদা থাকলে তাঁকে ভর্তি করাতে বেগ বেশি পেতে হচ্ছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরের বাসিন্দা জাকির হোসেনের (৬৫) শ্বাসকষ্ট। তাঁর পরিবার গতকাল সকালে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেয়। ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করাতে না পেরে জাকিরকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে আসেন পরিবারের সদস্যরা। কিছুক্ষণ ছোটাছুটি করেও সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি করাতে পারেননি।

জাকির হোসেনের ছোট ছেলে মাহফুজ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সকাল আটটায় রওনা দিয়েছি। দুই সিলিন্ডার অক্সিজেন ছিল অ্যাম্বুলেন্সে। এক সিলিন্ডার শেষ। আরেক সিলিন্ডার যেকোনো সময় শেষ হয়ে যাবে। অক্সিজেন লাগবে বলে হাসপাতালে ভর্তি নিচ্ছে না।’ পরে এক স্বজনের সঙ্গে ফোনে পরামর্শ করে তাঁরা অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ছোটেন কুর্মিটোলা হাসপাতালে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত সরকারি হাসপাতাল রয়েছে ১৬টি। এগুলোর মধ্যে ৩টি হাসপাতালে আইসিইউ নেই। বাকি ১৩টি হাসপাতালের মধ্যে ৮টিতেই গতকাল কোনো আইসিইউ শয্যা ফাঁকা ছিল না। বাকি ৫টি হাসপাতালে ফাঁকা ছিল ১৬টি আইসিইউ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, রাজধানীর সরকারি হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য সাধারণ শয্যা রয়েছে ৩ হাজার ৮৩৮টি। এগুলোর মধ্যে ১ হাজার ৯৯টি শয্যাতে গতকাল রোগী ভর্তি ছিল। এসব সাধারণ শয্যার মধ্যে ৫০১টি শয্যাই ফাঁকা ছিল ডিএনসিসি করোনা হাসপাতালে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য প্রায় ২৬৩টি সাধারণ শয্যার মধ্যে ২৫৪টিতে গতকাল রোগী ভর্তি ছিল। হাসপাতালের ১০টি আইসিইউ শয্যা অনেক দিন ধরেই সার্বক্ষণিক পূর্ণ থাকছে। হাসপাতালে ভর্তি হতে আসা অর্ধেকের বেশি সংকটাপন্ন রোগী ঢাকার বাইরে থেকে আসা।

কুমিল্লার বরুড়া থেকে করোনার উপসর্গ নিয়ে এই হাসপাতালে গতকাল দুপুরে আসেন নাসিমা সুলতানা (৫৭)। তাঁর ভাতিজি সুমাইয়া আকতার বলেন, জ্বর ছিল দুদিন। জ্বর চলে যাওয়ার পর শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। কুমিল্লায় ডাক্তার দেখানো হয়েছিল। তাঁরা ঢাকায় নিয়ে যেতে বলেছেন।

সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, করোনার উপসর্গযুক্ত রোগীদের জন্য আলাদা ওয়ার্ড রয়েছে। উপসর্গ ও শনাক্ত করোনা রোগীদের জন্য মোট শয্যা প্রায় ৪০০। উপসর্গযুক্ত ব্যক্তিদের ওয়ার্ডে নারীদের জন্য কিছু শয্যা ফাঁকা রয়েছে। কিন্তু করোনা শনাক্ত ওয়ার্ডে নারীদের শয্যা ফাঁকা নেই। অন্যদিকে উপসর্গযুক্ত পুরুষদের জন্য শয্যা ফাঁকা নেই।

সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপাধ্যক্ষ ও করোনা চিকিৎসার সমন্বয়কারী শাহাদাত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, কিছুদিন আগেই ১০০ শয্যা বাড়ানো হয়েছে। শয্যা বাড়ানোর দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে সেগুলোও ভরে যাচ্ছে।