মহামারি নিয়ে স্বস্তিতে থাকার সময় আসেনি
করোনা সংক্রমণ কমে আসছে, সঙ্গে মৃত্যুও। তবু মানুষ স্বস্তিতে নেই। সম্ভাব্য সব পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকার পরামর্শ জনস্বাস্থ্যবিদদের।
গতকাল রোগী শনাক্তের হার ছিল ১২.০৭। এক মাস আগে এটা ছিল দ্বিগুণের বেশি।
মৃত্যুও কমে এসেছে। টানা বেশ কয়েক দিন মৃত্যু দুই শর ওপরে ছিল।
করোনা মহামারি নিয়ে মানুষের মধ্যে আশা ও শঙ্কা—দুটোই দেখা যাচ্ছে। দৈনিক রোগী শনাক্তের হার ও মৃত্যু কমে আসার কারণে মানুষের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি লক্ষ করা যাচ্ছে। অন্যদিকে ভাইরাসটির নতুন কোনো ধরন বা ভেরিয়েন্টের আবির্ভাবে পরিস্থিতি আবারও বদলে যায় কি না, সেই আশঙ্কাও দেখা যাচ্ছে অনেকের মধ্যে।
সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আরোপ করা প্রায় সব বিধিনিষেধ উঠে গেছে। হাটে–বাজারে মানুষের ভিড়। রাস্তায় যানজট। অফিস–আদালত প্রায় স্বাভাবিক। আন্তর্জাতিক যাতায়াতে কড়াকড়ি উঠে যাচ্ছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গেও যোগাযোগ স্বাভাবিক হতে চলেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া আর প্রায় সবকিছুই খোলা। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কবে চালু হবে, তা এখনো নিশ্চিত নয়।
জনস্বাস্থ্যবিদ ও ভাইরাসবিজ্ঞানীরা করোনাভাইরাসটির গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো উপসংহারে পৌঁছাতে পারছেন না। গত রোববার নিয়মিত স্বাস্থ্য বুলেটিনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক মোহাম্মদ রোবেদ আমিন বলেছিলেন, স্বস্তিতে থাকার কোনো সুযোগ নেই। টানা দুই বা তিন সপ্তাহ রোগী শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে থাকলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আছে বলে ধরে নেওয়া যায়। তবে সেই পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়নি।
গতকাল নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার ছিল ১২ দশমিক শূন্য ৭। অর্থাৎ ১০০ ব্যক্তির নমুনা পরীক্ষায় ১২ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। এক মাস আগে এটা ছিল দ্বিগুণের বেশি। ২৪ জুলাই শনাক্তের হার ছিল ৩৩। তারপর থেকে শনাক্তের হার কম হতে দেখা গেছে। সরকারি এই পরিসংখ্যান বলছে, সংক্রমণ কমে আসছে।
করোনায় মৃত্যু দেশের মানুষকে যে ভীতিকর পরিস্থিতিতে ফেলেছিল, সেই অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে করোনায় গতকাল আরও ৯৪ জনের মৃত্যুর তথ্য দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। টানা বেশ কয়েক দিন মৃত্যু দুই শর ওপরে ছিল। ৫ ও ১০ আগস্ট সর্বোচ্চ ২৬৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল। প্রতিদিন মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল, মাস শেষ হতে সেটা অনেকটাই দূর হয়েছে।
শনাক্ত বেড়ে যাওয়ার সমান্তরালে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে রোগীর চাপ বাড়তে থাকে। কোন হাসপাতালে সাধারণ শয্যা খালি আছে, হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা পাওয়া যাবে কি না, অক্সিজেন সরবরাহ আছে কি না—এসব প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দেয়। শনাক্ত ও মৃত্যু কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে এসব প্রশ্ন আপাতত সেভাবে আলোচনায় নেই। গতকাল সারা দেশে ১১ হাজার ১২টি সাধারণ শয্যা ও ৬৩৬টি আইসিইউ শয্যা খালি ছিল। হাসপাতালে করোনা রোগীর চাপ নেই।
বেশিসংখ্যক মানুষকে টিকার আওতায় আনতে হবে। হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহ বাড়াতে হবে। মাস্ক পরা প্রত্যেক মানুষের অভ্যাসে পরিণত করতে হবে।আবু জামিল ফয়সাল, জনস্বাস্থ্যবিদ
পেছনের কারণ
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরীন প্রথম আলোকে বলেন, পরিস্থিতির উন্নতিতে বেশ কিছু কারণ আছে। দেড় বছরের বেশি সময়ে বহু মানুষের মধ্যে সংক্রমণ ঘটে গেছে, অনেকের শরীরেই অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে বলে ধারণা করা যায়। ১ থেকে ১৪ জুলাই এবং ২৩ জুলাই থেকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত দেশব্যাপী বিধিনিষেধ সংক্রমণ কমাতে ভূমিকা রেখেছে। করোনার টিকা কিছু মানুষকে সুরক্ষা দিচ্ছে। সংখ্যায় কম হলেও অনেকে স্বাস্থ্যবিধি মানছেন, মাস্ক পরছেন।
গত বছরও আগস্টের দিকে সংক্রমণ ও মৃত্যু কমে এসেছিল। গত বছরের ১৫ আগস্ট এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছিলেন, টিকা ছাড়াই করোনা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, কিন্তু সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসেনি। এ বছরের মার্চ মাস থেকে ধীরে ধীরে সংক্রমণ বাড়তে থাকে। জুলাই মাসে তা ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।
এমন ঘটনা শুধু যে বাংলাদেশে দেখা গেছে, তা নয়। সংক্রমণ কমে আসার পর অনেক দেশেই আবার বাড়তে দেখা গেছে। অতি সম্প্রতি ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রে সংক্রমণ বাড়ছে এমন খবর দিয়েছে বিশ্ব গণমাধ্যম।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও সংক্রমণ হ্রাস–বৃদ্ধির খবর দিয়ে চলেছে। সংস্থাটি বলছে, প্রায় দুই মাস সংক্রমণ বৃদ্ধির পর ১৬ থেকে ২২ জুলাই সারা বিশ্বে সংক্রমণ পরিস্থিতি স্থিতিশীল আছে। আগের সপ্তাহের তুলনায় এই সপ্তাহে ভারতে শনাক্ত বেড়েছে ১০ শতাংশ। শ্রীলঙ্কাতেও সংক্রমণ বেড়েছে।
তবু কেন ঝুঁকি
এ বছরের এপ্রিলে ভারতে করোনার নতুন ধরন ‘ডেল্টা’ ছড়িয়ে পড়ার খবর পাওয়া যায়। দেশটিতে রোগী শনাক্তের হার ও মৃত্যু দ্রুতগতিতে বেড়ে যায়। ডেল্টা ধরন নিয়ে সারা বিশ্বেই উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে।
এই উদ্বেগ বাংলাদেশে দেখা দিলেও নতুন এই ধরনের সংক্রমণ রোধ করা যায়নি। ৫ মে ভারত থেকে আসা ৫৫ বছর বয়সী এক পুরুষের শরীরে ডেল্টা ধরন শনাক্ত হয়। এরপর ধীরে ধীরে দেশে শনাক্তের হারও বাড়তে থাকে, সঙ্গে মৃত্যুও।
ইতিমধ্যে পেরুতে শনাক্ত হওয়া করোনার ল্যামডা ধরন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন তা অন্য দেশেও যেতে পারে। যেমন চীনের উহান থেকে ভাইরাসটি ২০২০ সালের শুরুতে সারা বিশ্বে ছড়িয়েছিল। শুধু বিদেশ থেকে ভাইরাসের আগমন ঘটবে, বিষয়টি এমন নয়। উপযুক্ত পরিবেশ পেলে যেকোনো স্থানে ভাইরাসের রূপান্তর ঘটতে থাকে, উদ্ভব হতে পারে নতুন ভেরিয়েন্টের।
স্বস্তির সময় আসেনি
মহামারি নিয়ে মানুষ দ্বিধায় আছে। মহামারির শুরুর দিকে ধারণা করা হয়েছিল, দেশে সংক্রমণ, মৃত্যু অনেক বেশি হবে, হাসপাতালে শয্যার সংকট দেখা দেবে, সরকারের পক্ষে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হবে। পরিস্থিতি ওই পর্যায়ে যায়নি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দাবি, সময়মতো পদক্ষেপের কারণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ছিল।
তখন কিছু অনুমান, ধারণার কথাও শোনা গিয়েছিল। কেউ বলেছিলেন, বাংলাদেশের মানুষের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বেশি। কেউ বলেছিলেন, বাংলাদেশের মানুষ রোদে থাকে বেশি, শরীরে ভিটামিন ডি–এর প্রাচুর্য আছে। কেউ বলেছিলেন, বাংলাদেশের অনেক মানুষের বিসিজি টিকা নেওয়া আছে। অনেকের ধারণা ছিল, বাংলাদেশের আবহাওয়া করোনাভাইরাসের প্রকোপ বৃদ্ধির সহায়ক নয়। কেই বলেছিলেন, শীতকালে সংক্রমণ কমবে; কেউ বলেছিলেন, বাড়বে। এসব ছিল নিছক অনুমান, পেছনে বিজ্ঞান ছিল না। এ বছরের মার্চ থেকে সংক্রমণ বাড়তে থাকলে সব ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়।
সামনে শীতকাল। তখন সংক্রমণ পরিস্থিতি কেমন হয়, তা নিয়ে অনেকে আশঙ্কায় আছে। আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরীন বলেন, ‘কিছু দেশে শীতকালে ইনফ্লুয়েঞ্জা বাড়ে, বাংলাদেশে গরমকালে। করোনার প্রকোপ হ্রাস–বৃদ্ধির সঙ্গে মৌসুমি আবহাওয়ার সম্পর্ক আছে কি না, তা বলার সময় এখনো আসেনি।’
তবে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা জোরদার করার পাশাপাশি ব্যক্তিগত সুরক্ষার বিষয়কে আবারও সামনে আনার পক্ষে জনস্বাস্থ্যবিদেরা। তাঁরা সীমান্তে নজর দেওয়ার ব্যাপারে জোর দিয়েছেন। জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ‘ডেল্টা ভেরিয়েন্ট মোকাবিলা থেকে আমাদের কিছু শিক্ষা হয়েছে। ভবিষ্যতে ওই শিক্ষা কাজে লাগাতে হবে। বেশিসংখ্যক মানুষকে টিকার আওতায় আনতে হবে। হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহ বাড়াতে হবে। মাস্ক পরা প্রত্যেক মানুষের অভ্যাসে পরিণত করতে হবে।’