শিক্ষামন্ত্রী হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় দখল
মহিবুল হাসানের বাবা প্রয়াত এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী মেয়র থাকার সময় ২০০১ সালে যাত্রা শুরু করে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়।
২০১৮ সালে শিক্ষা উপমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি কবজায় নেন মহিবুল হাসান।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের অর্থায়ন ও জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বেসরকারি প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়। পাঁচ বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয়টি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর পরিবার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি দখলের চেষ্টা শুরু হয় ২০১৫ সাল থেকে।
মহিবুল হাসানের বাবা প্রয়াত এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রামের টানা তিনবারের মেয়র (১৯৯৪ থেকে ২০১০) এবং নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। তিনি মেয়র থাকার সময় ২০০১ সালে নগরের প্রবর্তক মোড়ে যাত্রা শুরু করে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়। ২০১৫ সালের মেয়র নির্বাচনে তিনি দলের মনোনয়নবঞ্চিত হন।
নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় নিয়ে দুজনের মধ্যে বিরোধ শুরু হয়। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে মারা যান মহিউদ্দিন চৌধুরী। ২০১৮ সালে শিক্ষা উপমন্ত্রীর দায়িত্ব পান মহিবুল হাসান চৌধুরী। পরের বছর বিশ্ববিদ্যালয়টি পুরোপুরি কবজায় নিয়ে নেন তিনি।
এখনো মহিবুল হাসান চেয়ারম্যান। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন বিশ্ববিদ্যালয়টি ফেরত চেয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে।
এদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিশ্ববিদ্যালয়টি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ৫ সেপ্টেম্বর চিঠি দিয়েছে সিটি করপোরেশন। সংস্থাটির কর্মকর্তারা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণ, জায়গা ক্রয় এবং শিক্ষক, কর্মকর্তা–কর্মচারীদের বেতন–ভাতা পরিশোধসহ বিভিন্ন খাতে ৪৩ কোটি টাকা খরচ করেছে সিটি করপোরেশন। কিন্তু মহিবুল হাসান চৌধুরী মন্ত্রিত্বের দাপট ও ক্ষমতা দেখিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি নিয়ন্ত্রণে নেন।
বেসরকারি এই বিশ্ববিদ্যালয়টি লাভজনক অবস্থায় আছে। ২০২২ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত ইউজিসির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, চট্টগ্রামের প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব জমির পরিমাণ ২ দশমিক ৭৪ একর। বার্ষিক আয় ৪৩ কোটি ৯৭ লাখ টাকা এবং ব্যয় হয়েছে ৩৩ কোটি ১৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ বছরে গড়ে মুনাফা ১০ কোটি টাকার বেশি।
প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ১০টি বিভাগের অধীনে অধ্যয়নরত আছেন সাড়ে আট হাজার শিক্ষার্থী। শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন প্রায় সাড়ে তিন শ। চট্টগ্রাম নগরের জিইসি মোড়, দামপাড়া, প্রবর্তক মোড় ও হাজারী গলি এলাকায় প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস রয়েছে।
সিটি করপোরেশনের দাবি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানার বিষয়ে উপাচার্য ও রেজিস্ট্রারের মন্তব্য জানতে গত মঙ্গলবার নগরের জিইসি মোড়ের প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে যান এই প্রতিবেদক। অসুস্থতার কারণে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন উপাচার্য অনুপম সেন। পরে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও একই কথা জানান তিনি। আর রেজিস্ট্রার ইফতেখার মুনিরও সাক্ষাৎ দেননি। আর ৫ আগস্টের পর আত্মগোপনে চলে যান সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী। তাঁর বিরুদ্ধে হত্যাসহ একাধিক মামলা হয়েছে।
সংস্থাটির কর্মকর্তারা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণ, জায়গা ক্রয় এবং শিক্ষক, কর্মকর্তা–কর্মচারীদের বেতন–ভাতা পরিশোধসহ বিভিন্ন খাতে ৪৩ কোটি টাকা খরচ করেছে সিটি করপোরেশন। কিন্তু মহিবুল হাসান চৌধুরী মন্ত্রিত্বের দাপট ও ক্ষমতা দেখিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি নিয়ন্ত্রণে নেন।
সিটি করপোরেশনের টাকায় বিশ্ববিদ্যালয়
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ২০০১ সালে ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বিজনেস ও টেকনোলজি নামের একটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করত। ২০০১ সালের ৮ মে সিটি করপোরেশনের ১০ম সাধারণ সভায় প্রতিষ্ঠানটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তৎকালীন মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০১ সালের ৫ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন ও পরিচালনার জন্য সাময়িক অনুমতি দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণ, জায়গা কেনা এবং বেতন–ভাতা পরিশোধসহ বিভিন্ন খাতে প্রায় ৪৩ কোটি টাকা খরচ করেছে সিটি করপোরেশন।
এর মধ্যে ২০১৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জায়গা কিনতে ২১ কোটি টাকা দিয়েছিল চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংরক্ষিত তহবিলের জন্য ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট সাড়ে চার কোটি টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে হস্তান্তর করে সিটি করপোরেশন। এর আগে ২০০১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে রূপালী ব্যাংকের আন্দরকিল্লায় শাখায় ৫০ লাখ টাকার তিন মাসের স্থায়ী আমানত হিসাব খোলে সিটি করপোরেশন।
ট্রাস্টি বোর্ডে যাঁরা
বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ট্রাস্টি বোর্ডের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি মহিবুল হাসান চৌধুরীর পরিবারের কাছে। বোর্ডে সদস্য হিসেবে আছেন মহিবুলের মা ও ছোট ভাই। আছেন বিতর্কিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম ও তাঁর ভাই আবদুস সামাদ। আছেন বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক অনুপম সেন, নাট্যব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ, সাবেক সংসদ সদস্য সাবিহা মুছা, আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া প্রমুখ। আগে পদাধিকার বলে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হতেন মেয়র, এখন মহিবুল হাসান নিজেই।
২০১১ সালের ২২ মে তৎকালীন মেয়র মোহাম্মদ মনজুর আলমকে চেয়ারম্যান করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হয়েছিল। এতে সদস্য ছিলেন সদ্য বিদায়ী মেয়র হিসেবে এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীও। মোহাম্মদ মনজুর আলম যত দিন মেয়রের দায়িত্বে ছিলেন, তত দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ড বা পরিচালনা নিয়ে এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে কোনো বিরোধ ছিল না। তবে চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন মেয়রের দায়িত্ব নেওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা নিয়ে বিরোধ শুরু হয়। একপর্যায়ে নিয়ন্ত্রণে নেন মহিউদ্দিন চৌধুরী ও তাঁর পরিবার।
এরই ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করার সময় ২০১৫ সালে ১৪ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) একটি চিঠি দিয়েছিল। এরপরেই আরেক সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজের বলে দাবি করেন এবং ইউজিসির চিঠি চ্যালেঞ্জ জানিয়ে হাইকোর্টে রিট করেন।
২০১৫ সালের ২৬ জুলাই মেয়রের দায়িত্ব নিয়েছিলেন আ জ ম নাছির উদ্দীন। একই বছরের ১৪ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, সহ–উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষের প্যানেল প্রস্তাব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে মেয়রকে চিঠি দিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। তবে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে সিটি করপোরেশনের সম্পৃক্ততা ও হস্তক্ষেপ কেন অবৈধ নয় জানতে চেয়ে ২০১৫ সালের ৯ ডিসেম্বর হাইকোর্টে রিট করেছিলেন সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। ওই রিট আবেদনে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, গত ১৪ জুলাই সিটি করপোরেশনকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করার চিঠি দিয়ে মঞ্জুরি কমিশন বেআইনি কাজ করেছে। পরে চিঠি বাতিল করে নিয়েছিল ইউজিসি।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সিটি করপোরেশনের দেওয়া চিঠিতে বলা হয়েছে, করপোরেশনের উদ্যোগে ও অর্থায়নে ২০০১ সালে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন এবং বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা–সংক্রান্ত ট্রাস্ট দলিল অনুযায়ী, সিটি করপোরেশনের মেয়র পদাধিকার বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।
এরই ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করার সময় ২০১৫ সালে ১৪ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) একটি চিঠি দিয়েছিল। এরপরেই আরেক সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজের বলে দাবি করেন এবং ইউজিসির চিঠি চ্যালেঞ্জ জানিয়ে হাইকোর্টে রিট করেন। ২০১৬ সালে মামলাটি খারিজ হয়ে যায়। এই রায়ের বিরুদ্ধে মহিউদ্দিন চৌধুরী আপিল বিভাগে সিভিল পিটিশন দায়ের করলে তা–ও খারিজ করে দেন আদালত। এভাবে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের মাধ্যমেও বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ সিটি করপোরেশনের হাতেই ন্যস্ত আছে।
সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, সিটি করপোরেশনের নিয়ন্ত্রণে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়টি নিয়মতান্ত্রিক ও আইনগতভাবে কর্তৃত্বে নেওয়ার সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় মহিবুল হাসান চৌধুরীর। তবে ২০১৯ সালে শিক্ষা উপমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর মহিবুল হাসান চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয়টি অন্যায়ভাবে দখল করেন এবং নিজে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হয়েছেন।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় যাতে আবার সিটি করপোরেশন নিয়ন্ত্রণে নেয়, সে জন্য শিক্ষার্থীরা চিঠি দিয়েছেন। এই অবস্থায় সিটি করপোরেশনের নেতৃত্ব গঠিত ট্রাস্টি বোর্ডের অধীনে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ চেয়েছে সংস্থার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানা ফেরত পেতে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (বিশ্ববিদ্যালয়-১ অধিশাখা) নুরুন আক্তার মুঠোফোনে বলেন, এ ধরনের চিঠি পেয়েছেন কি না, তা মনে করতে পারছেন না।
ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের পরিচালক মো. ওমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিংবা সিটি করপোরেশনের কাছ থেকে তাঁরা কোনো চিঠি পাননি। এ ধরনের চিঠি পেলে তাঁরা আলোচনা করবেন।