চট্টগ্রামে নির্বাচনে বারবার অস্ত্র প্রদর্শন, অস্ত্রধারীরা ‘বহাল তবিয়তে’

চট্টগ্রাম নগরের পাথরঘাটা এলাকায় অস্ত্র হাতে প্রতিপক্ষকে তাড়া করছেন আ স ম সাইফুদ্দিন আহমেদফাইল ছবি

তিন বছর আগে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) নির্বাচন ঘিরে সহিংসতায় গুলিতে দুজন নিহত হন। নির্বাচনের আগে ও নির্বাচনের দিন ওই দুজনের নিহত হওয়ার ঘটনায় ব্যবহৃত অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি। জামিনে রয়েছেন সব আসামি। শেষ হয়নি মামলার তদন্ত। এ ছাড়া ওই নির্বাচনের দিন পিস্তল উঁচিয়ে প্রতিপক্ষকে গুলি করা নগর ছাত্রলীগের সেই নেতাকেও ধরতে পারেনি পুলিশ।

সবশেষ গতকাল রোববার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নগরের পাহাড়তলী বিশ্ববিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রের সামনে নৌকা ও স্বতন্ত্র—দুই প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের সময় পিস্তল উঁচিয়ে গুলি করতে দেখা যায় শামীম আজাদ ওরফে ব্ল্যাক শামীম নামের এক যুবককে।

তিনি নিজেকে ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে পরিচয় দেন। নগর যুবলীগের সহসভাপতি ও ১৩ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ওয়াসিম উদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত শামীম। এখনো তাঁকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।

অস্ত্রধারীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকলে এ ধরনের ঘটনা আরও বাড়বে।
আখতার কবির চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক, সুজন চট্টগ্রাম

এ চারটিসহ ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত ছয় বছরে প্রকাশ্যে নির্বাচনকেন্দ্রিক সাতটি অস্ত্রবাজি ও খুনের ঘটনা ঘটেছে। আর অন্যান্য অস্ত্রবাজির ঘটনা ঘটেছে পাঁচটি। এই ১২ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে পেশাদার সন্ত্রাসীর পাশাপাশি যুবলীগ ও ছাত্রলীগের পদধারী নেতা রয়েছেন।

গতকালের পিস্তল উঁচিয়ে গুলি করার ঘটনা ছাড়া আগের ১১টি ঘটনার মধ্যে ৯টির ক্ষেত্রে মামলা হয়েছে। এসব মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ২২ জন। তাঁরা সবাই জামিনে। এর মধ্যে নির্বাচনী সহিংসতায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ১৫ জন। বাকি ৭ জন অন্য ঘটনার। গত চসিক নির্বাচনের দিন পিস্তল উঁচিয়ে প্রতিপক্ষকে গুলি করা নগর ছাত্রলীগের সেই নেতাকে এখনো ধরতে পারেনি পুলিশ। যে দুটি ক্ষেত্রে মামলা হয়নি, সেসব ঘটনার অস্ত্র উদ্ধারও হয়নি। দুর্বৃত্তদের প্রদর্শিত অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে পিস্তল, শটগান, এলজি (লাইটগান) ও বন্দুক।

এদিকে গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় নগরের ১৬ থানায় মামলা হয়েছে ৩০টি। এর আগের বছর ২০২২ সালে অস্ত্র উদ্ধারের মামলা হয়েছিল ১১৪টি। আর জেলার ১৭ থানায় মামলা হয়েছে ১২০টি।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিচারাধীন মামলাগুলোর নিষ্পত্তি হচ্ছে ধীরগতিতে। ১৪ বছর আগের অস্ত্র মামলাও এখনো ঝুলে থাকায় শাস্তির বাইরে রয়েছেন অস্ত্রধারীরা।

চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় প্রথম আলোকে বলেন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে পুলিশের নিয়মিত অভিযান অব্যাহত আছে। গ্রেপ্তারও হচ্ছে। জামিনে থাকা আসামিদের নজরদারিতে রেখেছে পুলিশ।

নৌকা ও ফুলকপি প্রতীকের অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষের সময় এক যুবক পিস্তল উঁচিয়ে গুলি ছুড়ছেন। রোববার সকাল সাড়ে ১০টায় চট্টগ্রামের পাহাড়তলী ডিগ্রি কলেজ কেন্দ্রে
ছবি: সংগৃহীত

নির্বাচনী সহিংসতায় খুন, অস্ত্রবাজি

২০২১ সালের ১২ জানুয়ারি চসিকের নির্বাচনী প্রচারণায় দুই পক্ষের সংঘর্ষে গুলিতে আজগর আলী নামের এক মহল্লা সরদার নিহত হন। একই বছরের ২৭ জানুয়ারি চসিক নির্বাচনের দিন দুই পক্ষের সংঘর্ষে গুলিতে আলাউদ্দিন নামের এক দিনমজুর নিহত হন। এ দুটি ঘটনার ভিডিও পুলিশ উদ্ধার করলেও অস্ত্রধারীকে শনাক্ত করতে পারেনি। গ্রেপ্তার সবাই জামিনে আছেন। নগর গোয়েন্দা পুলিশ মামলাটি তদন্ত করছে।

নিহত আজগর আলীর ছেলে সেজান মাহমুদ গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, গুলি করে বাবাকে হত্যা করা হয়েছে। গুলিটি এখনো উদ্ধার হয়নি। কে গুলি করেছে, পুলিশ তা-ও বের করতে পারেনি।

চসিক নির্বাচনের দিন পাথরঘাটা এলাকায় গুলি ছুড়তে থাকা পিস্তল হাতে যুবকের ছবি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর নাম আ ফ ম সাইফুদ্দিন। তিনি চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সহসভাপতি। ওই দিন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের সময় একটি গলিতে কালো প্যান্ট ও জ্যাকেট পরা সাইফুদ্দিনকে গুলি ছুড়তে দেখা যায়। পুলিশ তাঁকে এখনো খুঁজে পায়নি।

গত চসিক নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতা ও অস্ত্রবাজির ঘটনার ব্যাপারে নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (গণমাধ্যম) স্পিনা রানী প্রামাণিক প্রথম আলোকে বলেন, এটি তিন বছর আগের ঘটনা। বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেবে পুলিশ।

২০২২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি সবচেয়ে বড় অস্ত্রবাজির ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার খাগরিয়া ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে। প্রকাশ্যে গোলাগুলির এ ঘটনা দেশব্যাপী আলোড়ন তোলে। এ সময় অস্ত্রধারী অন্তত ৯ জনের হাতে পৃথক আগ্নেয়াস্ত্র দেখা গেছে। দুই চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীর অনুসারীরা প্রকাশ্যে গোলাগুলিতে লিপ্ত হন। চিহ্নিত অস্ত্রধারীদের মধ্যে সাতজন ছিলেন নৌকার প্রার্থী আকতার হোসেনের অনুসারী। দুজন ছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. জসিম উদ্দিনের পক্ষের।

এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে সাতকানিয়া থানায় মামলা করে। এতে স্বতন্ত্র প্রার্থী জসিম উদ্দিনকে প্রধান আসামি দেখানো হলেও আসামি তালিকায় ছিলেন না আকতার হোসেন। পরে পুলিশ মোহাম্মদ কায়েস, নাছির উদ্দিন, আবু আজাদসহ ৯ অস্ত্রধারীকে গ্রেপ্তার করে। তাঁরা সবাই এখন জামিনে।

চসিক নির্বাচনের দিন পাথরঘাটা এলাকায় গুলি ছুড়তে থাকা পিস্তল হাতে যুবকের ছবি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর নাম আ ফ ম সাইফুদ্দিন। তিনি চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সহসভাপতি। ওই দিন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের সময় একটি গলিতে কালো প্যান্ট ও জ্যাকেট পরা সাইফুদ্দিনকে গুলি ছুড়তে দেখা যায়। পুলিশ তাঁকে এখনো খুঁজে পায়নি।

একই বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি চন্দনাইশ পৌরসভা নির্বাচনে গাছবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের সামনে দুপুরে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আবদুর রহিম ও আওয়ামী লীগ সমর্থক মো. সেলিম নামের দুই কাউন্সিলর পদপ্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের একপর্যায়ে গোলাগুলি হয়। কেন্দ্রের পাশে ছিলেন গাছবাড়িয়া সরকারি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র হাবিবুর ইসলাম। গুলিতে তিনি গুরুতর আহত হয়ে মারা যান। এ ঘটনায় তাঁর মা ছকিনা খাতুন চন্দনাইশ থানায় মামলা করেন।

আদালতের নির্দেশে মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনে (পিবিআই) আসে। পরে তারা চন্দনাইশ পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রহিম উদ্দিনসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে। আসামিরা জবানবন্দিতে স্বীকার করেন, চন্দনাইশে ভোটকেন্দ্র দখলে অস্ত্রধারীদের টাকার বিনিময়ে ভাড়ায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

পিবিআই চট্টগ্রাম জেলা পরিদর্শক শফিউল আলম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। পুলিশের এই কর্মকর্তা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ভোটকেন্দ্র দখল করতে রহিম অস্ত্রসহ ২০ হাজার টাকা এবং অস্ত্র ছাড়া ১০ হাজার টাকা করে প্রায় ৪০ জনকে নিয়ে যান চন্দনাইশে। ১১ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে আদালতে। তাঁদের মধ্যে ছয়জন পলাতক। অন্যরা জামিনে।

এর আগে ২০১৮ সালের ২৯ মার্চ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের গোসাইলডাঙ্গা ওয়ার্ডের উপনির্বাচনে ভোটকেন্দ্রের বাইরে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদপ্রার্থী বিবি মরিয়মের পক্ষে চার যুবক প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দিয়ে কেন্দ্রে প্রভাব বিস্তার করেন। ওই ভিডিও ছড়িয়ে পড়লেও বিজয়ী বিবি মরিয়ম দাবি করেন, অস্ত্রধারীদের তিনি চেনেন না।

অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে পুলিশের নিয়মিত অভিযান অব্যাহত আছে। গ্রেপ্তারও হচ্ছে। জামিনে থাকা আসামিদের নজরদারিতে রেখেছে পুলিশ।
কৃষ্ণ পদ রায়, পুলিশ কমিশনার, চট্টগ্রাম মহানগর

২০১৮ সালের ৩০ মার্চ প্রথম আলোয় অস্ত্রধারীদের ছবিসহ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওই চার অস্ত্রধারীর মধ্যে রাকিব হায়দার এম ই এস কলেজের ছাত্র, তাঁর হাতে ছিল পিস্তল। অস্ত্রধারী আরেক যুবক মাহমুদুর রশিদ ওরফে বাবু, তিনি নগর ছাত্রলীগের সদস্য। বাকি দুজনের পরিচয় শনাক্ত হয়নি।

ওই অস্ত্রধারীদের গ্রেপ্তারে কোনো অগ্রগতি নেই। এ বিষয়ে বন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনজুর কাদের মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনায় এখনো মামলা হয়নি।

সন্ত্রাসীদের অস্ত্র প্রদর্শন

২০২১ সালের ১১ জুন চট্টগ্রামের বাকলিয়া কালা মিয়া বাজার আবদুল লতিফ হাটখোলা রোডে বড় মৌলভিবাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে ‘বিনা মূল্যে কবর দেওয়া হয়’ লেখা সাইনবোর্ড লাগাতে গেলে স্থানীয় সাইফুল্লাহ মাহমুদের পরিবারের ওপর আক্রমণ চালান সেখানকার মো. এয়াকুব বাহিনীর লোকজন। দুই পক্ষের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হন চারজন।

প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্র জানায়, ঘটনার দিন এয়াকুব ও তাঁর সহযোগী জাহেদুল ও মো. ওয়াসিমের হাতে ছিল পিস্তল, মহিউদ্দিনের হাতে ছিল একনলা বন্দুক, এলজি ছিল আলী আকবর ও মো. নেজামের হাতে। অস্ত্রধারীরা পেশাদার সন্ত্রাসী। পুলিশ জানায়, জায়গা দখলসহ আধিপত্য বিস্তারে তাঁরা ভাড়াটে সন্ত্রাসী হিসেবে ব্যবহৃত হন।

এ ঘটনায় করা মামলায় পুলিশ অস্ত্রধারীদের মধ্যে আলী আকবর, এয়াকুব ও জাহেদুলকে গ্রেপ্তার করে। অন্যরা আত্মসমর্পণ করেন। পরে পুলিশ এয়াকুব, আলী আকবর ও জাহেদুলের কাছ থেকে অস্ত্র উদ্ধার করেন। কিন্তু মহিউদ্দিন, নেজাম ও ওয়াসিমের কাছ থেকে অস্ত্র উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ।

এ ঘটনার করা মামলার বাদী সাইফুল্লাহ মাহমুদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনার দিন মোট ছয়টি অস্ত্র প্রদর্শিত হয়েছিল। পুলিশ তিনটি উদ্ধার করলেও বাকি তিনটি পারেনি। এই কারণে আমরা এখনো আতঙ্কে রয়েছি।’

২০২১ সালের ২৩ জুন চাক্তাই রাজাখালী বিশ্বরোড এলাকায় ট্রাকস্ট্যান্ডে চাঁদাবাজি নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে বাগ্‌বিতণ্ডা হয়। এর জেরে ৩৫ নম্বর বকশিরহাট ওয়ার্ড যুবলীগের নেতা পরিচয় দানকারী মহিউদ্দিন জনিকে অস্ত্র হাতে প্রতিপক্ষ মো. সায়েমকে শাসাতে দেখা গেছে সিসি ক্যামেরার ফুটেজে। এ ঘটনায়ও মামলা হয়নি।

আরও পড়ুন

এর আগে ওই বছরের ২৭ জানুয়ারি সিটি নির্বাচনের দিনও রাজাখালী ফায়ার সার্ভিসের সামনে নির্বাচনী প্রতিপক্ষকে অস্ত্র হাতে তাড়া করতে দেখা যায় মহিউদ্দিনকে। ওই ঘটনার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। পরে র‍্যাব তাঁকে একটি আগ্নেয়াস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করে। বর্তমানে জামিনে আছেন তিনি।

বকশিরহাট ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি মান্না বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, মহিউদ্দিন যুবলীগের কেউ নন। দলের নাম ভাঙানোর কারণে এর আগে তাঁকে সতর্ক করা হয়েছিল।

এ ছাড়া ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি স্কুলছাত্র আদনান ইসফার খুনে ব্যবহার হওয়া অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি। একই বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি এক কিশোরকে গুলি করতে যাওয়ার পথে পুলিশের তল্লাশিতে পড়ে একটি কিশোর গ্যাং। তারা সেখানে পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলিও করে। গ্রেপ্তার তিন কিশোর পরে আদালতে জবানবন্দিতে বলে, মো. ফারুক ওরফে টোকাই ফারুক নামের যুবলীগের নামধারী এক নেতা অস্ত্রটি তাদের দিয়েছিলেন। পরে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে।

২০২১ সালের ৩০ আগস্ট চট্টগ্রামের চন্দনাইশে শোক দিবসের কর্মসূচিতে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘাত হয়। এর একপর্যায়ে সেখানে অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি ছোড়েন কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাবেক সদস্য গিয়াস উদ্দিন ওরফে সুজন। গুলি ছোড়ার ভিডিও পরে বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। চার দিন পর ৪ সেপ্টেম্বর র‍্যাব রিভলবার, পিস্তলসহ গিয়াস উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে। মামলাটির বিচারকাজ চলছে।

প্রকাশ্যে অস্ত্রধারীরা একে একে জামিনে বেরিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, জামিনে থাকা অস্ত্রধারীরা এলাকায় কাউকে হুমকি দিলে কিংবা তাদের কারণে কেউ ভীত থাকলে বাদী কিংবা ভুক্তভোগী আদালতে জামিন বাতিলের আবেদন করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে জামিন বাতিলের জন্য রাষ্ট্রপক্ষ জোরালো আবেদন করবে আদালতে।

‘অস্ত্রধারীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে’

১৪ বছর আগে উদ্ধার হওয়া অস্ত্র মামলার বিচারও এখনো শেষ হয়নি। জামিনে বেরিয়ে গেছেন আসামি। ২০০৯ সালের ৫ জুন নগরের খুলশী ডেবারপাড় এলাকায় একটি এলজি, দুটি কার্তুজসহ আবুল শেখ নামের এক সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ ঘটনায় করা মামলায় তদন্ত শেষে পুলিশ একই বছরের ২১ জুলাই অভিযোগপত্র দেয়। ২০১০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি এই মামলার প্রথম সাক্ষ্য শুরু হয়। এত বছরে সাক্ষ্য হয় মাত্র ছয়জনের। আগামী বছরের ৯ জানুয়ারি পরবর্তী তারিখ রয়েছে পঞ্চম অতিরিক্ত চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতে।

জানতে চাইলে ওই আদালতের সরকারি কৌঁসুলি আরশাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, মামলাটি দ্রুত শেষ করার চেষ্টা রয়েছে।

একই অবস্থা ছয় বছর আগের আরেকটি মামলারও। ২০১৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি নগরের খুলশী আমবাগান এলাকায় একটি দেশীয় একনলা বন্দুক, কিরিচ, রামদাসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ ঘটনায় করা মামলাটি বর্তমানে চতুর্থ অতিরিক্ত চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন। ৩৫ সাক্ষীর মধ্যে হয়েছে শুধু বাদীর। সর্বশেষ গত ১৭ সেপ্টেম্বর সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য থাকলেও হয়নি। মামলার আসামিদের মধ্যে পাঁচজন জামিনে, পলাতক রয়েছেন আনোয়ার হোসেন নামের এক আসামি।

শুধু এ দুটি মামলা নয়, চট্টগ্রাম আদালতে অস্ত্র উদ্ধারের ৪ হাজার ২৮৫টি মামলা বিচারাধীন। গত বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত নিষ্পত্তি হয়েছে ৭৫টি।
নির্বাচনকেন্দ্রিক অবৈধ অস্ত্রধারীদের ‘কদর’ বেড়ে যায় বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘অস্ত্রধারীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকলে এ ধরনের ঘটনা আরও বাড়বে।’

আরও পড়ুন